৪৪ বছর পর যুদ্ধাপরাধের দায়মুক্ত হচ্ছে বাংলাদেশ
2015.04.13

দীর্ঘ ৪৪ বছর ধরে স্বামী হত্যার বিচারের জন্য অপেক্ষা করেছেন হাসেন বানু, হাফেজা খাতুন, দিলমনি ও করফুলি বেগম। একই গ্রামের বিচারপ্রার্থী এমন বিধবার সংখ্যা ছিল ৫৭। এখন তাঁদের মধ্যে বেঁচে আছেন ৩১ জন।
১১ এপ্রিল বাংলাদেশের কুখ্যাত যুদ্ধাপরাধী মুহাম্মদ কামারুজ্জামানের ফাঁসি কার্যকর হওয়ার পর দেশবাসীর দৃষ্টি ছিল ওই গ্রামটির দিকে। শেরপুর জেলার নালিতাবাড়ী উপজেলার কাকরকান্দি ইউনিয়নের সোহাগপুর নামের ওই গ্রামটি ‘বিধবাপল্লী’ নামেই পরিচিতি পেয়েছে ওই ব্যক্তির নৃশংসতা ও নিষ্ঠুরতার কারণেই।
একাত্তরে মহান মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ২৫ জুলাই আলবদর, রাজাকার ও পাকিস্তানি বাহিনী নির্বিচার হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছিল গ্রামটিতে। সেখানকার প্রায় সব পুরুষ মানুষকে (১৮৭ জন) হত্যা করে গ্রামটিকে পরিণত করা হয়েছিল বিধবাপল্লিতে।
মানবতাবিরোধী অপরাধের জন্য কামারুজ্জামানের বিরুদ্ধে আনীত সাতটি অভিযোগের মধ্যে তৃতীয়টি ছিল সোহাগপুরের এই হত্যাযজ্ঞ ও নারী ধর্ষণ। এসব অপরাধে তাঁকে মৃত্যুদণ্ডাদেশ দেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল।
বিভিন্ন নাটকীয় ঘটনা, উচ্চ আদালতে আপিল নিষ্পত্তিসহ আইনী প্রক্রিয়া শেষ করে ১১ এপ্রিল রাত সাড়ে দশটায় ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে ওই নরঘাতকের ফাঁসি কার্যকর করা হয়।
“এই কামারুজ্জামানের লাইগা ৪২ বছর ধইরা আমরা কষ্ট বুকে চাপা দিয়ে রইছি। আজ তার উচিত বিচার অইল। আমরা খুব খুশি অইছি,” মোবাইল ফোনে বেনারকে জানান করফুলি বেগম, যিনি স্বামীসহ পরিবারের আটজনকে হারিয়ে দুঃসহ স্মৃতি নিয়ে বেঁচে আছেন।
“এই দিনটার জন্য আল্লাহ আমারে বাঁচাইয়া রাখছিল,” জানালেন আরেক বিধবা হাফিজা খাতুন।
স্থানীয় সাংবাদিকরা জানিয়েছেন, একাত্তরে স্বামীহারা সোহাগপুরের বিধবা নারীদের চোখে দেখা গেছে আনন্দাশ্রু। দেশের বিভিন্নস্থানে মুক্তিযোদ্ধা সংসদ, একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি ও প্রজন্ম একাত্তরের মতো সংগঠনগুলো মিষ্টি বিতরণ করেছে। বিভিন্ন এলাকায় শহীদ মিনারে জড়ো হয়ে মানুষ উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেছে, হয়েছে আনন্দ মিছিলও।
গণজাগরণ মঞ্চ এবারের পয়লা বৈশাখে সোহাগপুরের বিধবাপল্লিতে বিজয় উৎসব করার ঘোষণা দিয়েছে।
“এটি মুক্তিকামী মানুষের বিজয়। ভবিষ্যতে এই দেশে মুক্তিযুদ্ধবিরোধী কোনো রাজনীতি চলতে দেওয়া হবে না,” বেনারকে জানান গণজাগরণ মঞ্চের মুখপাত্র ইমরান এইচ সরকার।
“আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আছে বলেই এসব যুদ্ধাপরাধীর বিচার হচ্ছে এবং হবে। এই বিচারের মাধ্যমে দলটি তার নির্বাচনী ইশতেহার পূরণ করেছে,” বেনারকে জানান ডা. নুজহাত চৌধুরী, যিনি মুক্তিযুদ্ধে শহীদ বুদ্ধিজীবী ডা. আলিম চৌধুরীর মেয়ে।
একাত্তরে কামারুজ্জামান বৃহত্তর ময়মনসিংহে আলবদরের প্রধান সংগঠক ছিলেন এবং তিনি আলবদরের গঠন, বাহিনীর সদস্যদের সশস্ত্র প্রশিক্ষণ দেওয়া প্রভৃতি বিষয়গুলো সমন্বয় করতেন।
সোহাগপুর গ্রামে হত্যাযজ্ঞ প্রসঙ্গে ট্রাইব্যুনাল তাঁর রায়ে বলেছিলেন, “এ হত্যাযজ্ঞ ও ধর্ষণের ঘটনাটি চরম হিংস্র প্রকৃতির। ওই ঘটনা এমনই পাশবিক প্রকৃতির, যেখানে শতাধিক নিরস্ত্র মানুষ তাঁদের জীবন ও সম্মান রক্ষা করতে পারেননি, মানবতাবোধের প্রতি ন্যূনতম মর্যাদা সেখানে দেখানো হয়নি।”
দুটি ফাঁসি কার্যকর, নয়টি বিচারাধীন: আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্যাইব্যুনাল গঠনের পর থেকে অনেকেই বলে আসছিল, এই বিচার আদৌ হবে না, এতদিন পর ন্যায়বিচার সম্ভব নয়। কিন্তু ১১ এপ্রিল দ্বিতীয় ফাঁসি কার্যকর হওয়ার পর থেকে সেই সংশয় কেটে গেছে।
এর আগে ২০১৩ সালের ১২ ডিসেম্বর ফাঁসি কার্যকর করা হয়েছিল জামায়াতের আরেক সহকারি সেক্রেটারি জেনারেল আবদুল কাদের মোল্লার।
“চলতি বছর আরও কয়েকটি মামলার আপিল নিষ্পত্তি হতে পার,” বেনারকে জানান অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম।
একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধের আরও নয়টি মামলা সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে বিচারাধীন। নিষ্পত্তির অপেক্ষায় থাকা এসব মামলার মধ্যে জামায়াতে ইসলামীর শীর্ষস্থানীয় পাঁচজনের, বিএনপির স্থায়ী কমিটির একজনের, জাতীয় পার্টির দুই নেতার এবং আওয়ামী লীগের ইউনিয়ন পর্যায়ের সাবেক এক নেতার বিরুদ্ধে মামলা রয়েছে।
এই নয়জনের মধ্যে আটজনকে মৃত্যুদণ্ডাদেশ এবং একজনকে আমৃত্যু কারাদণ্ডাদেশ দিয়েছেন ট্রাইব্যুনাল। এগুলোর মধ্যে জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদ ও বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাউদ্দিন কাদের (সাকা) চৌধুরীর আপিলের শুনানি শুরু হবে যেকোনো দিন।
আপিল বিভাগে মামলা বিচারাধীন অবস্থায় মারা গেছেন জামায়াতের সাবেক আমির গোলাম আযম ও বিএনপির নেতা আবদুল আলীম। এ দুটি আপিল নিষ্পত্তির আগেই ২০১৪ সালের ৩০ আগস্ট মারা যান ৮৪ বছর বয়সী আবদুল আলীম ও ২৩ অক্টোবর মারা যান গোলাম আযম। ফলে এ দুটি আপিলই বাতিল করা হয়েছে।
জামায়াতের আরেক নায়েবে আমির ও মুক্তিযুদ্ধকালে রাজাকার বাহিনীর প্রতিষ্ঠাতা এ কে এম ইউসুফ মারা যান ট্রাইব্যুনালে মামলা বিচারাধীন অবস্থায়। ২০১৪ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি ৮৯ বছর বয়সী ইউসুফ মারা যান।
ট্রাইব্যুনালের দেওয়া ফাঁসির সাজা কমিয়ে গত বছরের ১৭ সেপ্টেম্বর জামায়াতের নায়েবে আমির দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীকে আমৃত্যু কারাদণ্ড দেন আপিল বিভাগ। তবে পূর্ণাঙ্গ রায় এখনো প্রকাশিত হয়নি।
“সাঈদীর আপিলের পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশিত হলে তা পুনর্বিবেচনার (রিভিউ) আবেদন করা হবে কি না, এ বিষয়ে রাষ্ট্রপক্ষ সিদ্ধান্ত নেবে,” জানান মাহবুবে আলম।
মুজাহিদের বিরুদ্ধে মামলাটি ছাড়া আপিল বিভাগে জামায়াতের অন্য যে চারজন শীর্ষ নেতার আপিল বিচারাধীন রয়েছে তাঁরা হলেন দলটির আমির মতিউর রহমান নিজামী, নায়েবে আমির মুহাম্মদ আবদুস সুবহান, সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল এ টি এম আজহারুল ইসলাম ও কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদের সদস্য মীর কাসেম আলী।
ট্রাইব্যুনাল তাঁদের সবাইকে মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে ফাঁসির আদেশ দিয়েছেন।
আপিল নিষ্পত্তির তালিকায় রয়েছে জাতীয় পার্টির সাবেক নেতা সৈয়দ মো. কায়সারের বিরুদ্ধে মামলাটিও। সাবেক কৃষি প্রতিমন্ত্রী কায়সারকে ট্রাইব্যুনাল মৃত্যুদণ্ডাদেশ দেন। ওই রায়ের বিরুদ্ধে তিনি আপিল করেন।
জাতীয় পার্টির সাবেক সাংসদ পলাতক আবদুল জব্বারকে বয়সের বিবেচনায় আমৃত্যু কারাদণ্ড দিয়েছেন ট্রাইব্যুনাল। পলাতক থাকায় জব্বার এই রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করতে পারেননি। তবে রাষ্ট্রপক্ষ ওই রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করে জব্বারের ফাঁসি চেয়েছে।
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়া উপজেলার মোগড়া ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক মোবারক হোসেনের মামলাও আপিল নিষ্পত্তির অপেক্ষায়। মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে ট্রাইব্যুনাল তাঁকে ফাঁসির আদেশ দিলে তিনি খালাস চেয়ে আপিল করেন।
মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় দণ্ডাদেশপ্রাপ্ত আরও চার আসামি পলাতক রয়েছেন। তাঁরা হলেন জামায়াতের সাবেক রুকন (সদস্য) আবুল কালাম আযাদ, ফরিদপুরের নগরকান্দা পৌরসভার সাবেক মেয়র ও বিএনপির নেতা এম এ জাহিদ হোসেন, মুক্তিযুদ্ধকালে আলবদর নেতা চৌধুরী মুঈনুদ্দীন ও আশরাফুজ্জামান খান।
ট্রাইব্যুনাল রায়ে এঁদের সবাইকে মৃত্যুদণ্ডাদেশ দেন। পলাতক থাকায় তাঁরা রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করতে পারেননি, তাঁদের মৃত্যুদণ্ডও কার্যকর করা যায়নি।
“আপিল বিভাগে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলা নিষ্পত্তির জন্য আলাদা বেঞ্চ গঠন করতে হবে। আপিল বিভাগের ১১ জন বিচারপতির মধ্যে বর্তমানে সাতজন আছেন। অবিলম্বে বাকি চারজন বিচারপতি নিয়োগের ব্যবস্থা করতে হবে,” বেনারকে জানান একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির ভারপ্রাপ্ত সভাপতি শাহরিয়ার কবির।
যেভাবে ফাঁসি কার্যকর হলো:
ফাঁসি দেওয়ার পর নিয়মানুযায়ী, কামারুজ্জামানের দেহ প্রায় ২০ মিনিট ঝুলিয়ে রাখা হয়। এরপর কিছু প্রক্রিয়া শেষে কারাগারের চিকিৎসক তাঁকে মৃত ঘোষণা করেন।
এর আগে সন্ধ্যা সাতটার দিকে কামারুজ্জামানকে রাতের খাবার দেওয়া হয়। কিন্তু তিনি কিছুই খাননি। একজন কারারক্ষী তাঁকে গোসল করতে বলেন। গোসল সেড়ে নিজের সেলে নামাজ আদায় করেন। রাত ১০টার আগে কারা জামে মসজিদের ইমাম মাওলানা মনির হোসেন তাঁকে তওবা পড়ান।
রাত ১০টার পরে দুজন জল্লাদ কামারুজ্জামানের সেলে যান। একজন জল্লাদ কালো কাপড়ের যমটুপি পরিয়ে দেন। এ সময় তিনি নির্বাক ছিলেন। জল্লাদেরা যমটুপি পরিয়ে তাঁকে সেল থেকে ফাঁসির মঞ্চের নিয়ে আসেন।
মঞ্চে ওঠার আগে সবকিছু ঠিকঠাক আছে কি না কর্মকর্তারা দেখে নেন। রাত সাড়ে ১০টার কিছু আগে তাঁকে ফাঁসির মঞ্চে তোলা হয়। ঠিক সাড়ে ১০টার সময় হাতে থাকা লাল রুমাল ফেলে সংকেত দেন কারাগারের তত্ত্বাবধায়ক ফরমান আলী। সঙ্গে সঙ্গে ফাঁসির মঞ্চের লিভার টেনে ধরেন জল্লাদ। এতে ফাঁসি কার্যকর হয়ে যায়।
ফাঁসি কার্যকর হওয়ার পর কারাগারের ভেতরে লাশের ময়নাতদন্ত সম্পন্ন করা হয়। মৃতদেহ কারাগার থেকে নিয়ে যাওয়ার অনুমতি দেন তত্ত্বাবধায়ক ফরমান আলী। এর পরই লাশবাহী গাড়ি কারাগার থেকে বেরিয়ে যায়।
র্যাব–পুলিশের পাহারায় কামারুজ্জামানের মরদেহ পৌঁছায় তাঁর গ্রামের বাড়ি শেরপুরের বাজিতখিলা এলাকার কুমড়ি গ্রামে। সেখানে তাঁর প্রতিষ্ঠিত এতিমখানার পাশে একটি ধানক্ষেতে রাখা হয় এ দেশের অন্যতম সমালোচিত যুদ্ধাপরাধী কামারুজ্জামানের মরদেহ।
কারাগার সূত্র জানিয়েছে, কামারুজ্জামান বেঁচে থাকার শেষ সুযোগ রাষ্ট্রপতির প্রাণভিক্ষার আবেদন জানাননি।
“তিনি বেইমান-মুশরিকদের কাছে ক্ষমা চাইবেন না বলে জানিয়েছেন,” সাংবাদিকদের জানান কামারুজ্জামানের বড় ছেলে হাসান ইকবাল।
“প্রেসিডেন্টের কাছে প্রাণভিক্ষা না চাওযার বিষয়টি ছিল উনার ব্যক্তিগত। তিনি আমাদের কাছে শুধু আইনের বিধি-বিধান সম্পর্কে জানতে চেয়েছেন ,” বেনারকে জানান কামারুজ্জামানের আইনজীবী শিশির মনির ।
বিধবাপল্লীর এসব নারীরা গত চার দশকেরও বেশি সময় ধরে মানবেতর জীবনযাপন করেছেন। পিতা না থাকায় বেশিরভাগ পরিবারের সন্তানেরা লেখাপড়া শেখে নি।
“আমার দুই ছেলেমেয়ে রাঙামাটিতে বাসা–বাড়িতে কাজ করে। আমি সরকার ও বেসরকারি সংস্থা থেকে মোট এক হাজার ছয়শ টাকা (প্রায় ২০ ডলার) পাই। এর মধ্যে সরকারের সমাজসেবা অধিদপ্তর দেয় মাসে তিনশ টাকা, একটি বেসরকারি ব্যাংক দেয় মাসে এক হাজার টাকা এবং একটি বেসরকারি সংস্থা দেয় মাসে তিনশ টাকা,” মোবাইল ফোনে বেনারকে জানালেন বিধবা জোবায়দা বেওয়া । বিধবাপল্লীতে খোঁজখবর নিয়ে জানা যায়, প্রায় সব বিধবার আর্থিক অবস্থা প্রায় একইরকম।
এদিকে, কামারুজ্জামানের ফাঁসির প্রতিক্রিয়ায় জামায়াতে ইসলামী সোমবার সকাল-সন্ধ্যা হরতাল ডাকে। দেশের বিভিন্ন জেলায় প্রতিবাদ কর্মসূচি থাকলেও সারাদেশে প্রায় স্বাভাবিক অবস্থা বিরাজ করে। তবে রাজশাহী ও সিরাজগঞ্জে পৃথক ঘটনায় ২ শিবির কর্মি নিহত হয়েছে বলে গণমাধ্যম সূত্রে জানা গেছে।