জঙ্গিদের যোগসূত্র শুধু বক্তব্যে, তথ্য–প্রমাণ মিলছে না

ঢাকা থেকে শাহরিয়ার শরীফ
2015.05.04
BD-islamist ব্লগার ওয়াশিকুর হত্যার পরে জনতার হাতে আটক হয় জিকরুল্লাহ ও আরিফুল নামে দুই তরুণ। পুলিশ হেফাজতে থাকা অবস্থায় গত ৩০ মার্চ তোলা ছবি।
বেনার নিউজ

গত ২ মে জিহাদিদের ফোরামে একটি ভিডিওবার্তা পোস্ট করা হয়। সেখানে ওই গ্রুপের নেতা অসীম ওমর দাবি করেন, তাঁর সংগঠনের লোকজনই অভিজিৎকে হত্যা করেছে। এই পর্যন্তই। এই হত্যাকাণ্ডের বিষয়ে আর কোনো সূত্র নেই পুলিশের কাছে।

বিজ্ঞান মনস্ক লেখক ও ব্লগার অভিজিৎ রায় হত্যার পর থেকেই এই হত্যার সঙ্গে জঙ্গিদের যোগসূত্র রয়েছে বলে গণমাধ্যমে বক্তৃতা-বিবৃতি দেন পুলিশের কর্মকর্তারা। এরপরে আরেক ব্লগার ওয়াশিকুর রহমান হত্যার পরেও জঙ্গিদের যোগসাজশের কথা জানানো হয় পুলিশের পক্ষ থেকে।

গত ২১ এপ্রিল সাভারের আশুলিয়ায় ব্যাংকে ডাকাতদের হামলায় আটজন নিহত হওয়ার পরদিনই এই ঘটনার সঙ্গে জঙ্গিদের সম্পৃক্ততার কথা জানান দেয় পুলিশ। এখন পর্যন্ত এসব কোনো ঘটনারই যুৎসই প্রমাণ পাওয়ার কথা জানানো হয়নি পুলিশের পক্ষ থেকে।

তথ্য প্রমাণ না পাওয়ার আগেই ঢালাওভাবে জঙ্গিদের দোষারোপ নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। আসলে এসবের সঙ্গে জঙ্গিরাই জড়িত না বিশেষ কোনো উদ্দেশ্য নিয়ে শুধুমাত্র বক্তব্য-বিবৃতিতে তাদের জড়ানো হচ্ছে তা নিয়েও সন্দেহ তৈরি হয়েছে।এখন এটিকে কেউ রাজনীতিক ভাবে ব্যবহার করছে কিনা খতিয়ে দেখতে হবে।

“ডাকাতির ঘটনায় জঙ্গিদের জড়িত থাকার বিষয়ে কোনো কংক্রিট প্রমাণ মেলেনি, তবুও দাবি করা হচ্ছে জঙ্গিরা জড়িত। জঙ্গি উত্থানের বিষয়টিকে রাজনৈতিকভাবে ব্যবহারের সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে,” বেনারকে জানান বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব পিস অ্যান্ড সিকিউরিটি স্টাডিজ এর প্রেসিডেন্ট মেজর জেনারেল (অব.) মুনীরুজ্জামান।

ওই নিরাপত্তা বিশ্লেষকের মতে, জঙ্গিদের যে উত্থান হচ্ছে এতে কোনো সন্দেহ নেই। তাদের উত্থান পর্বটি পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে।    

২১ এপ্রিল রাজধানীর অদূরে পোশাক কারখানা অধ্যুষিত আশুলিয়ার কাঠগড়া বাজারে কমার্স ব্যাংকের শাখায় ডাকাতেরা হানা দেয়। ডাকাতেরা যুগপৎ ভাবে গুলি, গ্রেনেড ও ছুরি চালায়। এতে আটজন নিহত হন ও এরা ১৫ জন গুরুতর আহত হন। পরে জনতা তিন ডাকাতকে ধরে ফেলে, এদের একজন জনতার পিটুনিতে মারা যায়।

এই ঘটনার পরদিনই সাভার থানার মিলনায়তনে সংবাদ সম্মেলন করে পুলিশের ঢাকা রেঞ্জের ডিআইজি এস এম মাহাফুজুল হক নুরুজ্জামান ঘটনার জন্য জামায়াত-শিবিরকে দায়ী করে বলেন, ঘটনার বিশ্লেষণ করে তাঁর মনে হয়েছে ডাকাতি নয়, তাদের মূল উদ্দেশ্য ছিল হত্যা আর নাশকতা। জামায়াত-শিবিরের কর্মীরা এ ঘটনার সঙ্গে জড়িত। গ্রেপ্তার হওয়া বোরহান শিবিরের কর্মী উল্লেখ করে তিনি জানান, তার পুরো পরিবারই জামায়াতের সঙ্গে যুক্ত।

এরপর আবার ২৪ এপ্রিল ওই ডাকাতির ঘটনার জন্য জঙ্গিদের দায়ী করেন ডিআইজি নুরুজ্জামান। ওই দিন ঢাকা মহানগর পুলিশের মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে ডাকাতির জন্য জঙ্গিদের দায়ী করে ডিআইজি বলেন, ‘গ্রেপ্তার দুজন একসময় ইসলামি ছাত্রশিবির করলেও বর্তমানে জঙ্গি সংগঠনের সঙ্গে জড়িত। রাজনৈতিক অস্থিরতা সৃষ্টি এবং সংগঠনের তহবিল গঠনের জন্য তারা ব্যাংকে ডাকাতি করে।’

ওই ডাকাতির ঘটনায় দায়ের করা মামলায় এখন পর্যন্ত ছয়জনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। এদের মধ্যে ঘটনাস্থল থেকে দুজনকে গ্রেপ্তার করা হয়।

পুলিশ জানিয়েছে, গ্রেপ্তার দুজনের কাছ থেকে তথ্য নিয়ে বাকী চারজনকে গ্রেপ্তার করা হয়। এই চারজনের মধ্যে ওই ব্যাংকের এক নিরাপত্তারক্ষীও রয়েছে।

“গ্রেপ্তার ব্যক্তিরা জঙ্গি সংগঠন আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের (এবিটি) সদস্য। জিজ্ঞাসাবাদে তারা পুলিশকে বলেছেন, এবিটির কারাবন্দী নেতাদের ছাড়াতে তহবিল গঠনের জন্য তারা ব্যাংক ডাকাতির চেষ্টা করেছিলেন,” বেনারকে জানান মামলার তদন্ত কর্মকর্তা আশুলিয়া থানার পরিদর্শক (তদন্ত) দীপক চন্দ্র সাহা।

তবে তারা আনসারউল্লাহ বাংলা টিমের কোনো পর্যায়ের-কোনো ইউনিটের সদস্য, তাদের পদ কী, সংগঠনের তারা কদিন ধরে যুক্ত, তাদের নেতা কে ইত্যাদি বিষয়ে পুলিশ কিছুই জানায়নি।এমনকি গণমাধ্যমের সামনে তাঁদের কথা বলতে দেওয়া হয়নি। উল্লেখ্য, বিভিন্ন সময় পুলিশ আসামিদের গণমাধ্যমের সামনে হাজির করে।

একই ভাবে গত ৩০ মার্চ রাজধানীতে ব্লগার কন্যাশিশুর রহমান হত্যা মামলায় গ্রেপ্তার তিনজনকে জঙ্গি সংগঠনের সদস্য হয়েছে ঘোষণা করেছে পুলিশ। এদের মধ্যে দুজনকে হত্যাকাণ্ডের ঘটনাস্থল থেকেই গ্রেপ্তার করা হয়। এই তিনজনকে পুলিশ দফায় দফায় হেফাজতে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করলেও তারা আসলে কোন সংগঠনের সদস্য তা এখনো নিশ্চিত করতে পারেনি। তবে পুলিশ ধারণা করছে তারাও আনসারউল্লাহ বাংলা টিমের সদস্য।

“ওয়াশিকুর হত্যায় জড়িতরা কোন সংগঠনের সদস্য তা এখনো স্পষ্ট হয়নি। তবে ধারণা করা হচ্ছে, এরা আনসারউল্লাহ বাংলা টিম বা একই মতাদর্শের কোনো জঙ্গি সংগঠনের স্লিপার সেলের সদস্য। স্লিপার সেল হচ্ছে জঙ্গি সংগঠনগুলোর গোপন ও বিচ্ছিন্ন ছোট দল,” বেনারকে জানান এই মামলার তদন্তকারী কর্তৃপক্ষ ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশের যুগ্ম কমিশনার মনিরুল ইসলাম।

একইভাবে বিজ্ঞানমনস্ক লেখক ও ব্লগার অভিজিৎ রায়কে হত্যার পরেও জঙ্গি সংগঠনের দিকে আঙুল তুলে পুলিশ।গত ২৬ ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসিতে অভিজিৎ রায়কে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। এর দুই ঘণ্টা পরেই দায় স্বীকার করে ‘আনসার বাংলা সেভেন’ নামের একটি আইডি থেকে টুইট করা হয়।

তবে এই নামের ওই সংগঠনটির অস্তিত্ব আদৌ আছে কী না, সে বিষয়ে পুলিশ এখনো বিশেষ কিছু জানাতে পারেনি। তবে পুলিশ ধারণা দেয় যে, আনসারউল্লাহ বাংলা টিমের মতো কোনো সদস্য বা আনসারউল্লাহর কোনো শাখা এ ঘটনা ঘটিয়েছে।

সর্বশেষ গত ৩ মে সাইট ইন্টেলিজেন্স গ্রুপ নামের ওই ওয়েবসাইটের বরাত দিয়ে এএফপি বলেছে, গত ২ মে জিহাদিদের ফোরামে একটি ভিডিওবার্তা পোস্ট করা হয়। সেখানে ওই গ্রুপের নেতা অসীম ওমর দাবি করেন, তাঁর সংগঠনের লোকজনই অভিজিৎকে হত্যা করেছে। এই পর্যন্তই। এই হত্যাকাণ্ডের বিষয়ে আর কোনো সূত্র নেই পুলিশের কাছে। ওই ভিডিও বার্তা প্রকাশের পরে আবার আনসারউল্লাহ বাংলা টিমের সঙ্গে আল কায়েদার যোগসূত্র দেখছে পুলিশ।

“বাংলাদেশের কয়েকটি জঙ্গি সংগঠন আল কায়েদাকে অনুসরণ করে বলে তাঁদের কাছে তথ্য রয়েছে। আনসার উল্লাহ বাংলা টিমের কেউ আল কায়দার সঙ্গে যুক্ত হয়ে অভিজিৎ রায়কে হত্যা করেছে কি না, তা  তদন্ত করে দেখা হচ্ছে,” জানান ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের যুগ্ম কমিশনার মনিরুল ইসলাম।

এর আগে ২০১৩ সালের ১৪ জানুয়ারি রাতে হামলার শিকার হন ব্লগার আসিফ মহিউদ্দিন। হামলাকারীরা পেছন থেকে তাঁর ঘাড়ে ও পিঠে কুপিয়ে ফেলে যায়। মারাত্মক আহত হলেও তিনি বেঁচে যান। এর এক মাস পর আরেক ব্লগার রাজীব হায়দারকে রাজধানীর পল্লবীতে একই কায়দায় চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করা হয়।

পরবর্তী সময়ে তদন্ত করে ডিবি জানায়, রাজীব হত্যায় ‘আনসারুল্লাহ বাংলা টিম’ নামে নতুন একটি জঙ্গি সংগঠন জড়িত। এ ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগে আনসারুল্লাহর প্রধান মুফতি মুহাম্মদ জসীম উদ্দিন রাহমানীসহ সাতজনকে গ্রেপ্তারও করা হয়। তাঁদের বিরুদ্ধে গত বছরের ২৯ জানুয়ারি আদালতে অভিযোগপত্র দেয় পুলিশ।

ওই মামলাটি এখন বিচারাধীন। তবে আনসারউল্লাহর প্রধান রাহমানি গ্রেপ্তারের পরেও এ ধরনের তৎপরতা বন্ধ হয়নি। এ বিষয়ে ডিবি কর্মকর্তারা বলেন, জসীমউদ্দীনের পরে আনসারউল্লাহর হাল ধরেছেন তামিম আল আদনানী। তাকে খুঁজছে গোয়েন্দারা।

মুনীরুজ্জামান বলেন, “জঙ্গিরা এখন শুধু বাংলাদেশের ভেতরেই নয়, আঞ্চলিক পরিমণ্ডলেও যোগাযোগ স্থাপন করছে, কার্যক্রম বিস্তার ঘটাচ্ছে। ভারতের বর্ধমানে, বালুরমাঠে বিস্ফোরণের ঘটনা এর প্রমাণ। যেটার সঙ্গে জেএমবি ও অন্য জঙ্গি সংগঠন জড়িত বলে প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে।”

তাঁর মতে, “বাংলাদেশে জঙ্গিদের উত্থানের কারণ হিসেবে বলা যেতে পারে, এখন বিভাজনের রাজনীতি ও বিরাজ নীতিকরণের একটা প্রক্রিয়া চলছে। যার কারণে একটা রাজনৈতিক শূন্যতা সৃষ্টি হচ্ছে। রাজনৈতিক শূন্যতা তৈরি হলে অন্য শক্তি ঢুকে পড়ার চেষ্টা করবে এটাই স্বাভাবিক, অন্য সব দেশেও এমন হয়।”

“কিন্তু আমাদের নেতৃস্থানীয়রা এই বিষয়টা উপলব্ধি করতে পারছেন না। আমাদের ভুলের কারণে আমরা তাদের (জঙ্গিদের) জায়গা করে দিচ্ছি। যত বেশিদিন এ রকম চলবে জঙ্গিদের অবস্থান তত শক্তিশালী হবে,” মনে করেন মুনীরুজ্জামান।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।