২ আইএস গ্রেফতার, আনসারুল্লাহ নিষিদ্ধ, জঙ্গি ইস্যু নিয়ে প্রশ্ন উঠছে
2015.05.26

কিছুদিন পর পর বাংলাদেশে জঙ্গি ধরা পড়ছে। গোয়েন্দা বা পুলিশ সদস্যরা এ কথা ফলাও করে প্রচার করছে। কিন্তু এরপর ঘটনাগুলো হারিয়ে যাচ্ছে।এই প্রেক্ষাপটে প্রশ্ন উঠেছে, এরা আসলেই জঙ্গি কিনা, কিংবা যেভাবে তাদের তুলে ধরা হচ্ছে, তাঁরা সেই মাপের জঙ্গি কিনা।
এ বিষয়ে পুলিশের বক্তব্য হচ্ছে, দেশে একের পর এক ঘটনা তো ঘটছেই।তারা কখনো নিজে দায়িত্ব স্বীকার করছে, কখনো পুলিশ তাদের সম্পৃক্ততা পাচ্ছে।
তবে জঙ্গি ইস্যুতে র্যাব–পুলিশের সাম্প্রতিক কিছু অভিযান নিয়ে প্রশ্ন উঠছে। এর সঙ্গে দেশি–বিদেশি রাজনীতির সম্পৃক্ততা থাকার কথাও শোনা যাচ্ছে।
জঙ্গি ধরতে ভারত-বাংলাদেশের গোয়েন্দাদের যৌথ তৎপরতার প্রতি ইঙ্গিত করে বিএনপির চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া সম্প্রতি বলেছেন, “আওয়ামী লীগ এখন জঙ্গি নিয়ে নাটক করছে। আলেমদের জঙ্গি বলে তারা বিদেশিদের ভয় দেখায়।”
বিএনপি–জামায়াতসহ বিরোধী জোট মনে করছে, জঙ্গি ইস্যুটি সরকার রাজনৈতিক স্বার্থে জিইয়ে রাখছে। যদিও ২০০১ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত জোট সরকারের সময়েই জঙ্গিবাদ মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে।
পর্যবেক্ষকেরা বলছেন, আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা জঙ্গিদের বিষয়ে একতরফা বর্ণনা দেন। কিন্তু অভিযুক্তকে বক্তব্য দেওয়ার সুযোগ দেওয়া হয় না। এতে সন্দেহ আরও ঘনীভূত হয়।
“এ ধরনের একপেশে বক্তব্য প্রচার করা উচিত নয়। জঙ্গিরা বিক্ষিপ্তভাবে তৎপর থাকতে পারে। কিন্তু যেভাবে ঘটনাগুলো প্রচার করা হচ্ছে তাতে সন্দেহ থেকেই যাচ্ছে,” জানান দেশের শীর্ষস্থানীয় কলাম লেখক সৈয়দ আবুল মকসুদ।
তাঁর মতে, বর্তমান সরকার জঙ্গিবাদ দমন করেছে, এতে সন্দেহ নেই। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে এ বিষয়টি নিয়ে একটি মহল বাড়াবাড়ি করছে। জঙ্গিবাদের কথা বলে কেউ কেউ কাজ দেখাচ্ছে, কেউবা রাজনৈতিক ফায়দা নিচ্ছে।
সর্বশেষ ২৫ মে জঙ্গি সংগঠন ‘ইসলামিক স্টেটের’ (আইএস) সদস্য সন্দেহে আমিনুল ইসলাম বেগ (৩৫) ও সাকিব বিন কামাল (৩০) নামের দুজনকে গ্রেপ্তার করেছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। ডিবি জানায়, ২৪ মে রাজধানীর উত্তরা ও লালমাটিয়ার নিজ বাসা থেকে তাঁদের গ্রেপ্তার করা হয়।
পুলিশ জানায়, গ্রেপ্তার হওয়া আমিনুল কোকাকোলা উৎপাদনকারী বহুজাতিক কোম্পানি ইন্টারন্যাশনাল বেভারেজ প্রাইভেট লিমিটেড (আইবিপিএল) বাংলাদেশের আইটি বিভাগের প্রধান। সাকিব একটি ইংরেজি মাধ্যম বিদ্যালয়ের শিক্ষক।
এ দুজনকে সন্ত্রাসবিরোধী আইনের মামলায় ১০ দিন করে রিমান্ডে নেওয়ার আবেদন জানিয়ে ঢাকা মহানগর মুখ্য হাকিম আদালতে পাঠানো হয়। শুনানি শেষে আদালত তাঁদের প্রত্যেকের তিন দিন করে রিমান্ড মঞ্জুর করেন।
“আমিনুল নিষিদ্ধঘোষিত জঙ্গি সংগঠন জামাআতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশের (জেএমবি) আঞ্চলিক সমন্বয়ক। আইএসের নির্দেশিত খিলাফত প্রতিষ্ঠাই তাঁর লক্ষ্য ছিল। এ জন্য তিনি বিভিন্নভাবে প্রচার, গোপনে অর্থ ও কর্মী সংগ্রহ, গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের হত্যার পরিকল্পনাসহ বিভিন্নভাবে আইএসের সমন্বয়ক হিসেবে কাজ করছিলেন,” জানান ডিবির যুগ্ম কমিশনার মনিরুল ইসলাম।
পুলিশের ওই কর্মকর্তা জানান, আইএসের মতাদর্শ ধারণ করে, এমন ২০ জনকে নির্বাচন করে আইএসের আদর্শ প্রচার করছিলেন আমিনুল। গ্রেপ্তার হওয়া সাকিব ওই ২০ জনের একজন।
মনিরুল ইসলাম আরও বলেন, গ্রেপ্তার হওয়া দুজনই উচ্চবিত্ত পরিবারের সন্তান। তাঁরা নিজেরাই উপার্জন করছেন। তাঁরা তথ্যপ্রযুক্তিতেও বেশ দক্ষ।
কিন্তু পুলিশের এসব বক্তব্যের ব্যাখ্যা গণমাধ্যম পায়নি। এর আগে বিভিন্ন সময় জঙ্গিরা গণমাধ্যমের সামনে বক্তব্য দেওয়ার সুযোগ পেত। সাংবাদিকেরা তাঁদের প্রশ্ন করতে পারত। কিন্তু সাম্প্রতিক বিভিন্ন ঘটনায় পুলিশ একতরফাভাবে জঙ্গি ইস্যুতে কথা বলছে।
“আমাদের বাঘের ভয় দেখানো হচ্ছে। যেভাবে বিচারহীনতার সংস্কৃতি চালু হয়েছে তাতে বাঘ এসেও কাউকে পাবে না,” সাম্প্রতিক সময়ে জঙ্গিদের কর্মকাণ্ড ও তাদের গ্রেপ্তার করা প্রসঙ্গে অনেকটা ব্যঙ্গ করে এ কথা বলেন নাগরিক উদ্যোগ নামে একটি সংগঠনের সভাপতি শরীফুজ্জামান শরীফ। তিনি বামধারার ছাত্রসংগঠন বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নের সাবেক সভাপতি।
শরীফুজ্জামান বলেন, “নাশকতাকারিরা ধরা পড়ছে না, নাশকতার চেষ্টা বা পরিকল্পনায় জড়িতদের ধরা হচ্ছে, আর বলা হচ্ছে জামায়াত বা জঙ্গি। যেকোনো সচেতন নাগরিক এর মর্ম বোঝে।”
তাঁর মতে, আন্তর্জাতিক অপপ্রচার ও দেশের ভেতর রাজনৈতিক উদ্দেশ্যেই জঙ্গি ইস্যুটির অপব্যবহার হচ্ছে। চূড়ান্ত বিচারে এ ধরনের কর্মকাণ্ড দেশের উন্নয়ন ও অগ্রগতির জন্য, মৌলবাদ ও সাম্প্রদায়িকতা মুক্ত দেশ গড়ার অন্তরায় বলে মনে করেন তিনি।
ডিবি সূত্র জানায়, গ্রেপ্তার হওয়া আমিনুল বরিশাল ক্যাডেট কলেজের ছাত্র ছিলেন। পরে মালয়েশিয়ার একটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কম্পিউটার বিজ্ঞান ও প্রকৌশল বিষয়ে লেখাপড়া করেছেন। দেশে কয়েকটি মোবাইল ফোন কোম্পানিতে চাকরি করার পর সর্বশেষ কোকাকোলায় আইটি বিভাগের প্রধান হিসেবে কর্মরত ছিলেন তিনি। তাঁর গ্রামের বাড়ি গোপালগঞ্জের বলাকড় এলাকায়। উত্তরার ১৪ নম্বর সেক্টরে থাকতেন তিনি।
তাঁর দেওয়া তথ্য অনুযায়ী সাকিবকে লালমাটিয়ার বাসা থেকে আটক করা হয়। সাকিব ঢাকার একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে একই বিষয়ে লেখাপড়া শেষ করে লালমাটিয়ার একটি ইংরেজি মাধ্যম বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করছিলেন। তাঁর বাড়ি চট্টগ্রাম শহরের সাবালঘাটা খাজা রোডে।
“আমিনুল ইসলাম বেগ গ্রেপ্তার হয়েছেন মর্মে গণমাধ্যমে খবর আসায় আমরা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে সর্বতোভাবে সহযোগিতা করার কথা জানিয়েছি,” ইন্টারন্যাশনাল বেভারেজ প্রাইভেট লিমিটেডের (আইবিপিএল) পাঠানো এক বিবৃতিতে ২৫ মে এ কথা বলা হয়েছে।
ডিবির কর্মকর্তাদের ভাষ্য, আইএস নিয়ে ইন্টারনেটে ব্যাপক পড়াশোনা করেছেন আমিনুল। আইএসের মতাদর্শ নিয়ে ইন্টারনেটে নিয়মিত লেখালেখিও করেন তিনি। আইএসের কয়েকজন সদস্যের সঙ্গে তিনি যোগাযোগও করতেন। দেশে আইএস নিয়ে তাঁর প্রচারণা ও উদ্বুদ্ধকরণ বিষয়ে ওই সদস্যদের অবহিত করতেন।
প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে আমিনুল জানান, যে ২০ জনকে তিনি আইএসের আদর্শে অনুপ্রাণিত করেছেন, তাঁদের মধ্যে দু-তিনজন ইতিমধ্যে আইএসে যোগ দিতে সিরিয়া গেছেন।
“নিষিদ্ধ সংগঠন জেএমবির সদস্য হলেও আন্তর্জাতির্ক সন্ত্রাসী সংগঠন আইএসের সঙ্গে গোপন যোগাযোগের মাধ্যমে বাংলাদেশে সংগঠন তৈরি, সদস্য সংগ্রহ ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড পরিচালনার কথা আসামীরা স্বীকার করেছে,” বেনারকে জানান ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা অপরাধতথ্য (উত্তর) বিভাগের উপ কমিশনার শেখ নাজমুল আলম।
গোপন সংগঠন ‘আনসারউল্লাহ’ নিষিদ্ধ!
গোপনে কাজ করা কথিত সংগঠন ‘আনসারউল্লাহ বাংলা টিম’কে নিষিদ্ধ করার উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। গত দুই বছর ধরে পুলিশ ও গোয়েন্দারা আনসারউল্লাহর তৎপরতা নিয়ে কাজ করলেও এখন পর্যন্ত এর সাংগঠনিক কাঠামো বা কর্মকাণ্ড সম্পর্কে সুস্পষ্ট কোনো তথ্য জানতে পারেনি।
ঢাকা মহানগর পুলিশ এখন পর্যন্ত এই সংগঠনের অন্তত ২০ জন নেতা-কর্মীকে গ্রেপ্তারের দাবি করলেও তারা সংগঠনের কোন পদধারী সেসব বিষয়ে জানাতে পারেনি। প্রশ্ন উঠেছে, যে সংগঠনের কোনো অস্তিত্ব নেই, কর্মসূচি নেই এবং কমিটি নেই সেটি নিষিদ্ধ করার গুরুত্ব কতখানি।
“পুলিশের পক্ষ থেকে এই সংগঠনটি উগ্র আখ্যা দিয়ে এবং তাদের বিভিন্ন নাশকতামূলক কর্মকাণ্ডের কথা উল্লেখ করে মন্ত্রণালয়কে চিঠি দেওয়া হয়েছে। এ কারণে মন্ত্রণালয় সংগঠনটি নিষিদ্ধ করার উদ্যোগ নিয়েছে,” জানান স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল।
এক প্রশ্নের জবাবে প্রতিমন্ত্রী বলেন, এটা সত্য যে গোপন সংগঠন এমনিতেই অবৈধ। তাই নিষিদ্ধ করা বা না করার মধ্যে খুব একটা তফাৎ নেই।
এর আগে ২০০৫ সালে বিএনপি–জামায়াত জোট সরকারের সময়ে আরও ছয়টি সংগঠনকে নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। এগুলো হলো-হরকাতুল জিহাদ আল ইসলাম, জাগ্রত মুসলিম জনতা বাংলাদেশ(জেএমজেবি), জামাআতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশ (জেএমবি), হরকাতুল জিহাদ আল ইসলামি বাংলাদেশ (হুজি বি), শাহাদাত আল হিকমাত ও হিযবুত তাহরির।
পুলিশের একাধিক কর্মকর্তা বলেছেন, জেএমবি বা হুজির মতো আনুষ্ঠানিক কোনো সাংগঠনিক কাঠামো নেই আনসারউল্লাহর। এদের মধ্যম পর্যায়ের নেতারা ছোট ছোট দলে ৪/৫ জন করে তরুণকে দীক্ষা দেন। এরপর তাদের দিয়ে খুনোখুনি করানো হয়।
ওই ছোট দলগুলোকে পুলিশ বলছে স্লিপার সেল। ওই দলের সদস্যরা তাদের নেতার পরিচয় সম্পর্কে কিছুই জানে না। ফলে তারা ধরা পড়লেও নেতারা ধরা পড়েন না।
২০১৩ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি ব্লগার আহমেদ রাজীব হায়দারকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। তদন্তে সেই খুনের সঙ্গে আনসারউল্লাহর সদস্যদের সংশ্লিষ্টতা খুঁজে পায় ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশ। এরপর আরও অন্তত আধ ডজন খুনের অভিযোগ ওঠে আনসারউল্লাহর বিরুদ্ধে। এসব খুনের ঘটনায় কয়েকজন গ্রেপ্তার হলেও এর মূল নেতারা ধরা পড়েননি।
গত ১২ মে সিলেটে ব্লগার অনন্ত বিজয় দাশকে কুপিয়ে হত্যার অভিযোগ ওঠে সংগঠনটির বিরুদ্ধে। সর্বশেষ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য, প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক উপদেষ্টা, গণজাগরণ মঞ্চের মুখপাত্রসহ ১০ জনকে প্রাণনাশের হুমকির অভিযোগও ওঠে সংগঠনটির বিরুদ্ধে।
এর আগে গত ২১ এপ্রিল আশুলিয়ার কাঠগড়া বাজারে কমার্স ব্যাংকে ডাকাতির সঙ্গেও আনসারউল্লাহ জড়িত ছিল বলে দাবি করেছিল পুলিশ। ওই ডাকাতির ঘটনায় এখন পর্যন্ত এক ডাকাতসহ নয়জন নিহত হয়েছেন।
“পুলিশের কাছে তথ্য আছে যে, আল কায়েদার কাঠামো, নীতি এবং কার্যপদ্ধতি অনুসরণ করে আনসারউল্লাহ। সশস্ত্র জিহাদের মাধ্যমে তারা শরিয়া ভিত্তিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে চান,” জানান ডিবির অতিরিক্ত উপকমিশনার (এডিসি) সাইফুল ইসলাম।
পুলিশের তথ্য অনুযায়ী, আনসারউল্লাহ বাংলা টিমের সাংগঠনিক কাঠামো বা ইমারার শীর্ষে রয়েছেন জসীম উদ্দিন রাহমানি। অপারেশনাল দায়িত্বে ইজাজ হোসেন নামে একজনের নাম শোনা যায়। ইজাজ বর্তমানে পাকিস্তানে রয়েছেন।
২০১৩ সালের আগস্ট মাসে জসীম উদ্দীন রাহমানি গ্রেপ্তার হয়। এরপর থেকে অনেকটা হাওয়ার ওপর ভাসছে ওই সংগঠন।