আবারও বিদেশি নাগরিক হত্যার চেষ্টা
2015.11.18

বাংলাদেশে আবারও এক বিদেশি নাগরিককে গুলি করে হত্যার চেষ্টা করেছে দৃর্বৃত্তরা। ঢাকা ও রংপুরে দুই বিদেশিকে গুলি করে হত্যার দেড় মাসের মাথায় এবং যেদিন যুদ্ধাপরাধী সালাহউদ্দিন কাদের (সাকা) চৌধুরী ও আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদের ফাসিঁর দণ্ড পুনর্বিবেচনার (রিভিউ) রায় ঘোষণা হল, সেদিনই এ হত্যাচেষ্টা হয়।
এ ঘটনাকে দুই যুদ্ধাপরাধীর রায়কে কেন্দ্র করে দেশে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি তৈরির অপচেষ্টা বলে অভিযোগ তুলেছেন সংশ্লিষ্টরা।
দৃর্বৃত্ত হামলার শিকার পিয়েরো পারোলারি (৭৮) দিনাজপুরের সুইহারি ক্যাথলিক চার্চের ফাদার। পেশায় চিকিৎসক এ ইতালীয় নাগরিক শহরের সেন্ট ভিনসেন্ট হাসপাতালে কর্মরত ছিলেন।
বুধবার সকালে প্রতিদিনের মত ধর্মীয় প্রার্থনা সেরে চার্চ থেকে সাইকেল চালিয়ে ভিনসেন্ট হাসপাতালে যাওয়ার পথে হামলার শিকার হন পারোলারি।
দিনাজপুর কোতোয়ালি থানার ওসি এ কে এম খালেকুজ্জামান জানান, “সকাল পৌনে ৮টার দিকে শহরের মির্জাপুর বিআরটিসি ডিপোর সামনের সড়কে অজ্ঞাত পরিচয় দুর্বৃত্তরা পিয়েরো পারোলারিকে গুলি করে পালিয়ে যায়। পরে স্থানীয়রা তাকে হাসপাতালে নেয়।”
স্থানীয় সূত্র জানায়, গুরুতর অবস্থায় পারোলারিকে দিনাজপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়ার পর তার ঘাড়ে অস্ত্রোপচার হয়। পরে বিকেলে হেলিকপ্টারে করে তাকে পাঠানো হয় ঢাকায়।
এ ঘটনায় এখনও কাউকে শনাক্ত বা গ্রেফতার করতে পারেনি পুলিশ। এ বিষয়ে কোতোয়ালি থানার পরিদর্শক (তদন্ত) আবুল হাসনাত জানান, ‘হত্যাকারীদের এখনও শনাক্ত করা যায়নি।’
প্রত্যক্ষদর্শীদের বরাত দিয়ে পুলিশ জানিয়েছে, শহরের দিকে যাওয়ার সময় ফাদার পিয়েরোর পেছন পেছন একটি মোটরসাইকেলে তিনজন যাচ্ছিল। চালকের মাথায় হেলমেট ছিল, বাকি দুই আরোহীর গায়ে ছিল সাদা চাদর। ওই সময় ডিপো থেকে বিআরটিসির একটি বাস বের হয়ে যায় এবং মোটরসাইকেলের পেছনে বসা একজন গুলি করে। এরপর বাস ডিপোর পাশের একটি গলি দিয়ে হামলাকারীরা পালিয়ে যায়।
‘অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টির জন্য হামলা হতে পারে’
এ হামলার বিষয়ে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর তুরিন আফরোজ বলেন, “যেভাবে একটার পর একটা আঘাত আসছে, এরসঙ্গে যুদ্ধাপরাধীদের রায়ের বিষয়টি সম্পর্ক থাকতে পারে। বিষয়টি কোনভাবেই উড়িয়ে দেওয়া যায় না। একটি মহল দেশে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টি করার লক্ষ্যে এ কাজ করে থাকতে পারে”।
তিনি আরো বলেন, কারণ, যাদের রায় ঘোষণা হল তারা একজন জামায়াতের শীর্ষ নেতা আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ অন্যজন বিএনপি নেতা সালেহউদ্দিন কাদের চৌধুরি, যার পাকিস্তানি গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই কানেকশন আছে বলে সর্বজনবিদিত। তবে এ সবই আশঙ্কার কথা। বিষয়টি যেহেতু এখনও পুলিশের তদন্তাধীন রয়েছে। আশা করি আসল অপরাধীরা ধরা পড়বে।
মিল আছে তিন বিদেশির ওপর হামলার ঘটনায়
পৃথক পৃথক স্থানে হলেও তিন বিদেশি নাগরিকের ওপর হামলার ধরনে মিল আছে বলে মনে করছে পুলিশ। দিনাজপুরের ঘটনার মতই এর আগে রংপুরে ও ঢাকায় দুই বিদেশি হত্যাকাণ্ডেও হামলাকারী ছিল তিনজন এবং একইভাবে তারা পালিয়ে যাওয়ার জন্য মোটরসাইকেল ব্যবহার করেছিল।
দিনাজপুরের পুলিশ সুপার রুহুল আমিন বলেন, “এবারও মোটর সাইকেলে করে এ হামলা চালানো হয়েছে। তবে কারা করেছে এখনও জানা যায়নি। এ ঘটনায় সন্দেহভাজন কয়েকজনকে আটক করে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে।”
চিকিৎসা নেওয়ার পের আহত ফাদারের অবস্থা এখন কিছুটা স্থিতিশীল এবং কথা বলতে পারছেন বলে জানিয়েছেন সেন্ট ভিনসেন্ট হাসপাতালের চিকিৎসক ডা. অলিম্পিয়া।
ঢাকার গুলশানে ইতালীয় নাগরিক চেজারে তাভেল্লা এবং রংপুরে জাপানি নাগরিক হোশি কুনিও গুলিতে খুন হওয়ার দেড় মাসের মাথায় দিনাজপুরে এই ঘটনা ঘটল।
এরই মধ্যে গত অক্টোবরে পাবনার ঈশ্বরদীতেও একটি গির্জার ফাদারকে গলা কেটে হত্যার চেষ্টা হয়। এছাড়া ৩১ অক্টোবর ঢাকায় এক প্রকাশককে কুপিয়ে হত্যা এবং আরেক প্রকাশনীর অফিসে হামলা চালিয়ে তিনজনকে কুপিয়ে আহত করা হয়।
দুই বিদেশি হত্যাকাণ্ডের পর সিরিয়া ও ইরাক ভিত্তিক জঙ্গি গোষ্ঠী ইসলামিক স্টেটের (আইএস) নামে দায় স্বীকারের খবর এলেও সরকার বরাবরই বলেছে, এর কোনো ভিত্তি নেই।
বিএনপি-জামায়াতের দিকে ইংগিত করে খোদ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও বলেছেন, দেশকে অস্থিতিশীল এবং মানবতাবিরোধী অপরাধ মামলায় আদালতে দণ্ডিতদের রক্ষা করতে এসব হত্যাকাণ্ড চালানো হচ্ছে।
নীলাদ্রি হত্যাকাণ্ডে গ্রেপ্তার আরো তিন
এদিকে ব্লগার নীলাদ্রি চট্টোপাধ্যায় নিলয় হত্যাকাণ্ডে জড়িত সন্দেহে আরও তিনজনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। তাদেরকে ৫ দিনের রিমান্ডে নিয়েছে পুলিশ।
এ বিষয়ে ঢাকা মহানগর পুলিশের গণমাধ্যম শাখার অতিরিক্ত উপ কমিশনার এসএম জাহাঙ্গীর আলম বলেন, নিলয়কে ফেইসবুকে হুমকি দেওয়ার ঘটনায় একজন এবং হত্যাকাণ্ডের পর ইন্টারনেটে দায় স্বীকারকারী সন্দেহে দুজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
এই তিনজন হচ্ছেন- মুফতি মাওলানা আব্দুল গাফ্ফার, মরতুজা সাব্বির ফয়সল ও তারিকুল ইসলাম।
এক সংবাদ সম্মেলনে ঢাকা মহানগর পুলিশের মুখপাত্র মনিরুল ইসলাম বলেন, “নারায়ণঞ্জের সোনারগাঁ থেকে মঙ্গলবার গাফ্ফারকে গ্রেপ্তার করা হয়। তিনি ‘ইসলামের সৈনিক সত্যের লড়াকু’ নামে ফেইসবুক আইডি খুলে নিলাদ্রীকে উদ্দেশ করে “আইতাছি তোরে কোপামু চাপতি দিয়া” উল্লেখ করে হুমকি দেন। আর সাব্বির ও তারিকুল চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডের শিবির নেতা। মঙ্গলবার তাদের একজনকে নারায়ণগঞ্জ থেকে ও আরেকজনকে সীতাকুণ্ড থেকে গ্রেপ্তার করা হয়। তারাই আনসার আল ইসলাম নামে আইডি খুলে নিলয় হত্যার দায় স্বীকার করেন। এদের সকলের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।”
এর আগে কাউছার হোসেন ও কামাল হোসেন নামে দু’জনকে এ মামলায় গ্রেপ্তার দুই দফা রিমান্ডে নেয় পুলিশ। গত ৭ অগাস্ট রাজধানীর গোড়ানে নিজের বাসায় নিলয়কে কুপিয়ে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা।
ওই ঘটনায় নিলয়ের স্ত্রী আশামনি অজ্ঞাতপরিচয় চারজনকে আসামি করে খিলগাঁও থানায় একটি মামলা দায়ের করেন। মামলার তদন্তভার পরে যায় গোয়েন্দা পুলিশের হাতে। রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট কালেকটিভ নামে একটি বেসরকারি সংস্থায় কাজ করতেন ২৭ বছর বয়সী নিলয়। তবে ব্লগে সাম্প্রদায়িকতা ও মৌলবাদের বিরুদ্ধে লেখালেখিতে সক্রিয় ছিলেন তিনি।
ব্লগার অভিজিৎ রায়, ওয়াশিকুর রহমান বাবু ও অনন্ত বিজয় দাশের পর নিলয়কে হত্যার পরও দায় স্বীকার করে আল কায়দার ভারতীয় উপমহাদেশ শাখার নামে বিবৃতি আসে।
একই ধরনের জঙ্গি হামলায় গত ৩১ অক্টোবর জাগৃতি প্রকাশনীর স্বত্বাধিকারী ফয়সল আরেফিন দীপন নিহত হন। একইদিন প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান ‘শুদ্ধস্বর’ এও হামলার ঘটনা ঘটে। এতে প্রকাশক আহমেদুর রশীদ টুটুলের সঙ্গে আরও দুই ব্লগার আহত হন।