যাজক হত্যা চেষ্টায় ৫ জেএমবি সদস্য আটক, রংপুরে কুনিওর দাফন
2015.10.13

বাংলাদেশের পাবনার ঈশ্বরদীতে গির্জার যাজক লুক সরকারকে হত্যা চেষ্টা মামলায় গত কয়েকদিনে পাঁচ যুবককে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। এই পাঁচজনই নিষিদ্ধঘোষিত জঙ্গি সংগঠন জামাআতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশের (জেএমবি) সদস্য বলে পুলিশ জানিয়েছে। যাদের একজন আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিও দিয়েছেন। বাকি চার জনকে পাঁচদিনের রিমান্ড দিয়েছে আদালত। এরা সকলেই আগে জামায়াত-শিবিরের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন বলে পুলিশের দাবি।
গ্রেপ্তার যুবকেরা হলেন রাকিবুল হাসান ওরফে রাব্বি (২২), জিয়াউর রহমান ওরফে জিয়া (৩৫), আবদুল আলিম (৩৬), শরিফুল ইসলাম ওরফে তুলিব (২২) ও আমজাদ হোসেন (৩০)। এদের মধ্যে আমজাদের বাড়ি সিরাজগঞ্জ, বাকিচারজনই পাবনার সদর উপজেলার বাসিন্দা। ঢাকা ও রাজশাহী থেকে তিন দিনে তাদের আটক করা হয়। ঘটনায় জড়িত নিশ্চিত হওয়ার পর গতকাল সোমবার তাঁদের মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হয়।
এদিকে, নিহত জাপানি নাগরিক কুনিও হোশিকে মঙ্গলবার ভোররাতে রংপুরের মুন্সিপাড়া গোরস্থানে পুলিশের তত্বাবধানে দাফন করা হয়েছে।
একজনের স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি, বাকিরা রিমান্ডে
আটকের পর সোমবার দুপুরে পাঁচ ‘জেএমবি’ সদস্যকে পাবনার জ্যেষ্ঠ বিচারিক হাকিম আদালতে নেওয়া হলে সেখানে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন রাকিবুল। মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ও ঈশ্বরদী থানার ওসি বিমান কুমার দাশের আবেদনের প্রেক্ষিতে মঙ্গলবার বাকি চারজনকে ৫ দিনের রিমান্ড দিয়েছে আদালত।
ওসি বিমান কুমার বেনারকে বলেন, “অধিকতর জিজ্ঞাসাবাদের জন্য এই চারজনকে ১০ দিনের জন্য রিমান্ডে নেওয়ার আবেদন করেছিলাম। আটকৃতদের মধ্যে রাকিবুল হাসান ওরফে তাওহিদ ঘটনা স্বীকার করে পুলিশের কাছে জবানবন্দি দেওয়ায় তাকে রিমান্ডে চাওয়া হয়নি।”
এর আগে ৫ অক্টোবর বাড়িতে ঢুকে ব্যাপ্টিস্ট মিশনের ‘ফেইথ বাইবেল চার্চ’-এর যাজক লুক সরকারকে গলা কেটে হত্যার চেষ্টা করেন তিন যুবক। পরিবারের সদস্য ও প্রতিবেশীদের চিৎকারে তারা নিজেদের মোটরসাইকেল ফেলে পালিয়ে যান। পুলিশ মোটরসাইকেলটি জব্দ করে। এ ঘটনায় অজ্ঞাতনামা আসামিদের বিরুদ্ধে ঈশ্বরদী থানায় মামলাও করা হয়। পরে ঈশ্বরদী উপজেলা এলাকা থেকে ওবায়দুল ইসলাম (২৮) নামে এক শিবির কর্মীকে গ্রেফতার করে পুলিশ। সে এখন কারাগারে।
‘মূল পরিকল্পনাকারী’ পলাতক: পুলিশ
এ ঘটনার মূল পরিকল্পনাকারীও একজন জেএমবি সদস্য তবে তিনি পলাতক আছে বলে জানিয়েছেন পাবনার পুলিশ সুপার (এসপি) আলমগীর কবির। পাঁচ জেএমবি সদস্য আটকের পর আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি জানান, পলাতক এই মূল পরিকল্পনাকারীর নাম রাকিবুল ইসলাম ওরফে রাকিব। যিনি ঢাকায় চাকরি করতেন। কিন্তু চাকরি ছেড়ে গত দেড় বছর ধরে তিনি পাবনায় জেএমবিকে সংগঠিত করার চেষ্টা করছিলেন। বিভিন্ন এলাকার জেএমবি সদস্যদের নিয়ে মাসে অন্তত তিনবার পাবনা এডওয়ার্ড কলেজমাঠ ও আশপাশের এলাকায় বৈঠক করতেন তিনি।
সংবাদ সম্মেলনে আটক পাঁচজনকে উপস্থিত করা হলেও সাংবাদিকদের সঙ্গে তাদেরকে কথা বোর সুযোগ দেওয়া হয়নি।
‘সরকারকে চাপে ফেলার উদ্দেশ্য’
পাবনার পুলিশ সুপার (এসপি) আলমগীর কবির আরো জানান, সম্প্রতি এক বৈঠকে রাকিবুল তার সদস্যদের জানান, সরকারকে আন্তর্জাতিকভাবে চাপের মুখে ফেলতে সংগঠনের নেতৃস্থানীয় পর্যায় থেকে নির্দেশ আসছে। সে নির্দেশনা মাথায় রেখে বিদেশি অথবা ভিন্ন ধর্মের লোককে হত্যার পরিকল্পনা নিয়ে আলোচনা হয়। সেখানেই রাকিবুল প্রস্তাবিত নাম লুক সরকারকে হত্যার সিদ্ধান্ত হয়।
পুলিশের বর্ননায় লুক হত্যা চেষ্টা
আলমগীর কবির বলেন, পরিকল্পনা অনুযায়ী গ্রেপ্তার রাকিবুল হাসান ও পলাতক রাকিবুল ইসলাম গত ১৮ সেপ্টেম্বর সকালে ফোন করে লুক সরকারকে ধর্মবাণী শুনতে চান বলে জানান। ওই দিন সকালে তারা মোটরসাইকেলে লুক সরকারের বাড়িতে যান। ধর্মবাণী শোনার নামে তারা বাড়িতে এক ঘণ্টা অবস্থান করে আশপাশের পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করেন। আবার ধর্মবাণী শোনার কথা বলে ৫ অক্টোবর সকালে রাকিবুল হাসান, রাকিবুল ইসলাম ও শাকিল হোসেন নামের আরও একজন লুক সরকারের বাড়িতে যান। লুক সরকার তাদের ধর্মবাণী শোনাতে থাকেন। প্রায় আধা ঘণ্টা পর দুজন লুক সরকারের মুখ চেপে ধরেন। আর শাকিল গলায় ছুরি চালাতে থাকেন।
পুলিশ সুপার বলেন, পলাতক ও গ্রেপ্তার আসামিরা আগে শিবিরের রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন। গ্রেপ্তারের সময় তাদের কাছ থেকে বেশ কিছু জিহাদি বইও জব্দ করা হয়। তাদের বিরুদ্ধে পাবনা সদর থানায় সন্ত্রাস দমন আইনে আরেকটি মামলা করা হয়েছে।
‘ওবায়দুল বিতর্ক’
এদিকে পুলিশ গ্রেফতার করা ওবায়দুল নামের যুবকটি ঘটনার সময় ছিলেন না বলে সাংবাদিকদেরকে জানান লুক সরকার। তবে ঈশ্বরদী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) বিমান কুমার দাশ বলেন, ওবায়দুল ঘটনার নেপথ্যে ছিলেন। এছাড়া আটক পাঁচ জেএমবি সদস্যের ছবি দেখার পর লুক সরকার শুধুমাত্র রাকিবুলকে চিহ্নিত করেন। বাকিদের চিনতে পারেননি তিনি।
জামায়াতের প্রতিবাদ
এদিকে আটক ‘জেএমবি’ সদস্যরা ‘পূর্বে জামায়াত-শিবিরের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিল’ পুলিশের এমন দাবিকে অস্বীকার করেছে জামায়াত ইসলাম। সংগঠনটির পাবনা জেলা শাখার প্রচার সেক্রেটারি মো. আবদুর রউফ এক বিবৃতিতে জানান, পুলিশের দাবি সঠিক নয়। আমরা দৃঢ়তার সঙ্গে বলতে চাই, তারা অতীতে কোন সময়ই জামায়াত-শিবিরের সঙ্গে জড়িত ছিলেন না।
‘অনেক বড় ষড়যন্ত্র’
পরপর বিদেশি হত্যা, ভিন্ন ধর্মের মানুষ হত্যার মধ্য দিয়ে দেশে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টি করার অনেক বড় ষড়যন্ত্র হচ্ছে বলে মন্তব্য করেছেন ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির নির্বাহী সভাপতি শাহরিয়ার কবির।
তিনি বেনারকে বলেন, “এসব ঘটনার প্রত্যেকটি একই সূত্রে গাঁথা। বাংলাদেশকে নিয়ে অনেক বড় ষড়যন্ত্র হচ্ছে। আর এদেশের স্বাধীনতা বিরোধী মহল এ ষড়যন্ত্রের সঙ্গে সম্পৃক্ত। যাদের মূল হল জামায়াত ইসলাম। যে কোনভাবে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টি করে আন্তর্জাতিক মহলের চাপ বাড়িয়ে যুদ্ধাপরাধীদের মুক্ত করা তাদের অন্যতম উদ্দেশ্য। সরকারকে এসব চক্রান্তকারীদের শক্তভাবে দমন করতে হবে। সকল অপরাধীকে আইনের আওতায় আনতে হবে। এদেশে বসবাসকারী সকল ধর্ম, বর্ণের মানুষের নিশ্চয়তা বিধান করতে হবে।”
এছাড়া অত্যন্ত দ্রুততার সঙ্গে যাজক হত্যা চেষ্টা এবং বিদেশি হত্যার সঙ্গে জড়িতদের আটক করায় আ্ইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে ধন্যবাদ জানান তিনি।
বাংলাদেশেই চিরনিদ্রায় জাপানি নাগরিক
রংপুরে আততায়ীর গুলিতে নিহত জাপানি নাগরিক কুনিও হোশি বাংলাদেশেই চিরনিদ্রায় শায়িত হলেন। জাপানে অবস্থানরত পরিবার তার লাশ নিতে অস্বীকৃতি জানানোর পর সোমবার ভোর রাতে জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে রংপুরে তাকে দাফন করা হয়। নিহত হওয়ার দশ দিনের মাথায় তিনি সমাহিত হলেন।
নগরীর মুন্সিপাড়া কবরস্থানে সোমবার ভোর রাত ৪টা ৩০ মিনিটে তাকে দাফন করা হয় বলে জানান অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট প্রিয়সিন্ধু তালুকদার।
তিনি জানান, অতিরিক্ত পুলিশ সুপারের মর্যাদা সম্পন্ন দুই পুলিশ কর্মকর্তাসহ সিটি কর্পোরেশনের প্রতিনিধি ও জাপান দূতাবাসের কর্মকর্তারা রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ফরেনসিক মেডিসিন বিভাগের হিমঘর থেকে লাশ হস্থান্তর ও কবর দেয়া পর্যন্ত উপস্থিত ছিলেন। তিনি ইতিপূর্বে মুসলমান ধর্ম গ্রহন করায় তাকে ইসলামি শরিয়ত মোতাবেক কবর দেয়া হয়েছে।
এদিকে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে লাশ দাফনের বিষয়টি নিশ্চিত করা হলেও মুন্সিপাড়া কবরস্থানে লাশ দাফনের রেজিস্টাররে কুনিও হোশির লাশ দাফন নিয়ে কোনো তথ্য নেই।
তবে পুলিশ প্রশাসনের একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা জানান, কুনিও হোশিকে গোলাম কিবরিয়া নামে দাফন করা হয়েছে। তার লাশ দাফনের পর মুন্সিপাড়া কবরস্থানের নিরাপত্তাও জোরদার করা হয়েছে। সেখানে রাত থেকে সশস্ত্র পুলিশ অবস্থান করছে।