অবসরের পর বিচারকদের রায় লেখা নিয়ে বিতর্ক
2016.01.21

অবসরে যাওয়ার পর সুপ্রিম কোর্টের একজন বিচারপতি রায় লিখতে পারেন কিনা, সেই বিতর্ক উঠেছে জোরেশোরে এবং এর পক্ষে–বিপক্ষে মত দিচ্ছেন আইনজ্ঞরা। এ নিয়ে আলোচনা–সমালোচনা হচ্ছে বিভিন্ন সেমিনারে ও গণমাধ্যমে।
দায়িত্ব গ্রহণের এক বছর পূর্তি উপলক্ষে প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা বলেন, কোনো কোনো বিচারপতি অবসর গ্রহণের দীর্ঘদিন পর পর্যন্ত রায় লেখা অব্যাহত রাখেন, যা আইন ও সংবিধান পরিপন্থী।
গত মঙ্গলবার সুপ্রিম কোর্টের ওয়েবসাইটে এই বাণী প্রকাশ হওয়ার পর বিরোধী দল বিএনপি, আইনজ্ঞসহ সংশ্লিষ্টদের মধ্যে বিষয়টি নিয়ে বিতর্ক শুরু হয়েছে।
সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি খন্দকার মাহবুব হোসেন সংবাদ সম্মেলন করে বলেছেন, “নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার সংবিধানের পরিপন্থী বলে সাবেক প্রধান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক যে রায় দিয়েছিলেন, তাতে তিনি স্বাক্ষর করেন অবসরে যাওয়ার ১৬ মাস পরে। ওই রায়ের সাংবিধানিক ভিত্তি নেই।”
বিরোধী দল বিএনপি গতকাল বৃহস্পতিবার সংবাদ সম্মেলন করে জানিয়েছে, সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী ছিল একদলীয় শাসন কায়েমের লক্ষ্যে উচ্চ পর্যায়ের ষড়যন্ত্রের ‘উলঙ্গ রূপ’, যাঁর সহযোগী ছিলেন সাবেক প্রধান বিচারপতি খায়রুল হক। নয়াপল্টনে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী এ কথা বলেন।
রুহুল কবীর দাবি করেন, “খায়রুল হক চিকিৎসার জন্য প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে ১০ লাখ টাকা এবং আইন কমিশনের চেয়ারম্যান পদে চাকরির জন্য অবসরের পর রায় লিখেছেন ও তাতে সই করেছেন।”
সমালোচনা সত্ত্বেও অবসর নেওয়ার পর বিচারপতিদের রায় লেখার রীতি অনেক দিন ধরেই চলে আসছে। কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ মামলার রায়েও বিচারপতিরা অবসরের পরে সই করেছেন। কিন্তু প্রধান বিচারপতি এ বিষয়ে বক্তব্য দেওয়ার পর রাজনৈতিক অঙ্গনেও বিষয়টি ঘিরে প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছে।
সাধারণত বিচারপতিরা উন্মুক্ত আদালতে সংক্ষিপ্ত রায় ঘোষণা করেন। এরপর তাঁরা বিস্তারিত যুক্তি দিয়ে পূর্ণাঙ্গ রায় লিখে তা প্রকাশ করেন বেশ পরে।
অবসরের পর রায় লেখা নিয়ে বক্তব্যের ব্যাখ্যা দিয়ে প্রধান বিচারপতি বলেন, বিচারপতিরা সংবিধান, আইনের রক্ষণ, সমর্থন ও নিরাপত্তা বিধানের শপথ নেন। কোনো বিচারপতি অবসর নেওয়ার পর তিনি সাধারণ নাগরিক হিসেবে গণ্য হন। এ জন্য তাঁর শপথও বহাল থাকে না।
“অবসরের পর বিচারপতিরা রায় লিখতে পারবেন না, এমন কোনো বিধান নেই। যদি প্রধান বিচারপতি এটা মনে করেন, তাহলে সুপ্রিম কোর্টের বিধিমালা সংশোধন করে এ বিষয়টি যুক্ত করতে পারেন,” বেনারকে জানান সাবেক আইনমন্ত্রী শফিক আহমেদ, যিনি নিজেও একজন স্বনামধন্য আইনজীবী ।
২০১১ সালের ১০ মে সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিল ঘোষণা করে রায় দেন সাবেক প্রধান বিচারপতি খায়রুল হকের নেতৃত্বাধীন আপিল বিভাগের সাত সদস্যের বেঞ্চ। ওই বছরের ১৭ মে খায়রুল হক অবসরে যান। এর প্রায় ১৬ মাস পর পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ হয়।
আবারো তত্বাবধায়ক ইস্যু
“বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে সুষ্ঠু নির্বাচনের অভাবে যে সংকট ও রাজনৈতিক হানাহানি চলছে, তার একমাত্র কারণ নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন পদ্ধতি বাতিল করে ক্ষমতাসীন দলের অধীনে নির্বাচন। আর এর পেছনে রয়েছে বিচারপতি খায়রুল হকের সংবিধান পরিপন্থী অবৈধ ওই রায়,” জানান খন্দকার মাহবুব।
অবশ্য অ্যাটর্নি জেনারেল বুধবার মাহবুবে আলম সাংবাদিকদের বলেছেন, “প্রধান বিচারপতির বক্তব্য লুফে নিয়ে আইনজীবী সমিতি বা অন্যরা তা রাজনৈতিকভাবে ব্যবহার করছে। প্রকৃতপক্ষে প্রধান বিচারপতি ওই মন্তব্য করেছেন বর্তমান প্রেক্ষাপট বিবেচনা করে। কয়েকজন বিচারপতি রায় না লিখে ঝুলিয়ে রেখেছেন, তাঁদের উদ্দেশে প্রধান বিচারপতি এ কথা বলেছেন।”
অবসরের পর বিচারপতিদের রায় লিখতে বাধা নেই উল্লেখ করে অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, একজন বিচারপতি যখন রায় ঘোষণা করেন তখন তাঁর শপথ থাকে। পরে হয়তো কেউ অবসরে চলে গেলে পূর্ণাঙ্গ রায় লেখেন। কিন্তু রায় তো তিনি আগেই ঘোষণা করেন।
বাংলাদেশে অবসরে যাওয়ার পর বিচারপতিদের রায় লেখার প্রচলন রয়েছে বহুদিন ধরেই । ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিলের রায় ছাড়াও ধর্মীয় বিষয়ে ফতোয়া নিয়ে খায়রুল হক যে রায় দিয়েছিলেন, তা পূর্ণাঙ্গ আকারে প্রকাশিত হয়েছিল প্রায় সাড়ে তিন বছর পর।
বিচার বিভাগ পৃথক করে ঐতিহাসিক মাসদার হোসেন মামলার রায়ও পূর্ণাঙ্গ আকারে প্রকাশিত হয়েছিল তৎকালীন প্রধান বিচারপতি মোস্তাফা কামালের অবসরে যাওয়ার পর।
সম্প্রতি মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় আপিল বিভাগে জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর রায় ঘোষণা হয়েছিল ২০১৪ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর। ওই সময় প্রধান বিচারপতি ছিলেন মো. মোজাম্মেল হোসেন। গত বছরের ১ অক্টোবর তিনি অবসরে গেলেও ওই রায় পূর্ণাঙ্গ আকারে প্রকাশিত হয় ৩১ ডিসেম্বর।
“অবসরের পর দেওয়া বা সই করা রায় মূল্যহীন কাগজের টুকরো মাত্র,” বেনারকে জানান সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী মহসিন রশীদ।