মামলার জালে খালেদা জিয়া, রাজনীতির সময় কমছে

ঢাকা থেকে শাহরিয়ার শরীফ
2015.06.18
BD-khaleda ঢাকার বিশেষ আদালতে দূর্নীতির দু'টি মামলার শুনানিতে হাজিরা দিতে যান বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়া। ১৮জুন,২০১৫
বেনার নিউজ

বিএনপির চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া নয়টি মামলা সামাল দেবেন, নিজের দল গোছাবেন না সরকারবিরোধী আন্দোলন করবেন-এই প্রশ্ন এখন দলটির শত-সহস্র নেতা-কর্মীর। একের পর এক মামলার জালে তাঁকে যেভাবে ঘিরে ফেলা হচ্ছে তাতে এগুলো সামাল দিতেই তাঁকে হিমশিম খেতে হবে।

২০০৮ সালে সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ে দায়ের হওয়া নাইকো, বড়পুকুরিয়া ও গ্যাটকো-এই তিনটি মামলা চালু করায় খালেদা জিয়ার ওপর মামলার ভার বেড়ে গেছে। এ ছাড়া বর্তমান সরকার নাশকতার ঘটনায় হুকুমের আসামি হিসেবে চারটি মামলায় আসামি করেছে।

এর আগে ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর দায়ের হওয়া জিয়া এতিমখানা ট্রাস্ট ও জিয়া দাতব্য ট্রাস্ট মামলায় সাক্ষ্যগ্রহণ চলছে।

“সরকার রাজনৈতিকভাবে মোকাবিলা করতে না পেরে জিয়া পরিবারের বিরুদ্ধে একের পর এক মামলা করছে। এসব মামলা মিথ্যা ও ষড়যন্ত্রমূলক। মোটিভ দেখে মনে হওয়াটাই স্বাভাবিক, মামলা দিয়ে উনাকে ব্যস্ত রাখাই সরকারের লক্ষ্য,” বেনারকে জানান জিয়া পরিবারের আইনজীবী জয়নুল আবেদীন মেজবাহ।

বিএনপির স্থায়ী কমিটির একজন সদস্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, উনার বয়স হয়েছে। এক সন্তান মারা গেছেন, আরেক সন্তান বিদেশে। উনাকে বাড়িছাড়া করা হয়েছে। এখন মাসে কয়েকবার হাজিরা দিতে আদালতে যেতে হবে। উনি রাজনীতি করবেন কখন?


নাইকো মামলা নিম্ন আদালতে

প্রায় ৭ বছর পর চলতি বছরের শুরুতে নাইকো দুর্নীতি মামলাটির কার্যক্রম আবার চালু করার উদ্যোগ নেয় দুর্নীতি দমন কমিশন-দুদক। মামলার বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে খালেদা জিয়ার করা আবেদন ১৮ জুন খারিজ করে দিয়েছেন হাইকোর্ট।

রায়ের অনুলিপি পাওয়ার দুই মাসের মধ্যে খালেদা জিয়াকে নিম্ন আদালতে আত্মসমর্পণ করতে হবে। বিচারপতি মো. নূরুজ্জামান ও বিচারপতি জাফর আহমেদের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ এ রায় দেন।

“আদালত মামলার স্থগিতাদেশ বাতিল করেছেন,” সাংবাদিকদের জানান দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) আইনজীবী খুরশীদ আলম খান।

“এ বিষয়ে খালেদা জিয়ার সঙ্গে কথা বলে আপিল করা হবে,” সাংবাদিকদের জানান খালেদা জিয়ার আইনজীবী এ এম মাহবুব উদ্দিন খোকন।

সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে ২০০৭ সালের ৯ ডিসেম্বর কানাডার কোম্পানি নাইকোর সঙ্গে অস্বচ্ছ চুক্তির মাধ্যমে রাষ্ট্রের বিপুল আর্থিক ক্ষতিসাধন ও দুর্নীতির অভিযোগে খালেদা জিয়াসহ পাঁচজনের বিরুদ্ধে মামলা করে দুদক। অভিযোগপত্রে আসামিদের বিরুদ্ধে প্রায় ১৩ হাজার ৭৭৭ কোটি টাকা রাষ্ট্রীয় ক্ষতির অভিযোগ আনা হয়।

২০০৮ সালের ১৫ জুলাই থেকে মামলাটির কার্যক্রম স্থগিত রয়েছে।


একযাত্রায় দুই ফল

নাইকোকে কাজ দিয়ে রাষ্ট্রের ক্ষতি করার অভিযোগে খালেদার প্রধান রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধেও একই দিনে আরেকটি মামলা করেছিল দুদক।

আওয়ামী লীগ সরকারে আসার পর ২০১০ সালের মার্চে হাই কোর্ট ওই মামলা বাতিল করে দেয়। রায়ে বলা হয়, আওয়ামী লীগ সভানেত্রীকে হয়রানি করার উদ্দেশ্যেই মামলাটি করা হয়েছিল।

এ প্রসঙ্গ টেনে খালেদার মামলার আইনজীবী রাগীব রউফ হাই কোর্টের শুনানিতে বলেছিলেন, বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর মামলাটি যে কারণে বাতিল করা হয়েছে, একই কারণে বিএনপি চেয়ারপারসনের মামলাটিও চলতে পারে না।


জিয়া এতিমখানা ট্রাস্ট ও জিয়া দাতব্য ট্রাস্ট মামলা শেষ পর্যায়ে

খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে সোয়া পাঁচ কোটি টাকা দুর্নীতির দুই মামলায় সাক্ষ্যগ্রহণ ও বাদীকে আসামিপক্ষের জেরার জন্য আগামী ২৩ জুলাই পরবর্তী দিন রেখেছে আদালত। জিয়া এতিমখানা ট্রাস্ট ও জিয়া দাতব্য ট্রাস্ট মামলায় ঢাকার তৃতীয় বিশেষ জজ আদালতের বিচারক আবু আহমেদ জমাদার ১৮ জুন এই আদেশ দেন।  

দুই মামলার শুনানিতে হাজিরা দেওয়ার জন্য বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া ১৮ জুন সকাল সাড়ে দশটার দিকে বকশীবাজারে স্থাপিত বিশেষ আদালতে পৌঁছান।  

২০১১ সালের ৮ আগস্ট জিয়া দাতব্য ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলা দায়ের করে দুদক। আর জিয়া এতিমখানা ট্রাস্টে অনিয়মের অভিযোগে ২০০৮ সালের ৩ জুলাই রমনা থানায় অন্য মামলাটি দায়ের করে। এতিমদের সহায়তার জন্য একটি বিদেশি ব্যাংক থেকে আসা ২ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ আনা হয় এ মামলায়।


গ্যাটকো মামলার বৈধতার রায় যেকোনো দিন

জরুরি অবস্থার সময় দায়ের করা গ্যাটকো দুর্নীতি মামলার বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে খালেদা জিয়ার আবেদনের বিষয়ে হাই কোর্টের রায় হবে যেকোনো দিন। এ বিষয়ে সাত বছর আগে খালেদার করা দুটি রিট আবেদনে হাই কোর্টের দেওয়া রুলের শুনানি শেষে বিচারপতি মো. নুরুজ্জামান ও বিচারপতি আব্দুর রবের বেঞ্চ আবেদনটি রায়ের জন্য অপেক্ষমাণ রাখে।

খালেদার আইনজীবীরা শুনানিতে বলেন, গ্যাটকো মামলায় খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে অর্থ আত্মসাৎ বা দুর্নীতির ‘সুনির্দিষ্ট’ অভিযোগ নেই। শুধু প্রধানমন্ত্রী হিসেবে কোনো দরপত্র অনুমোদনের জন্য প্রশাসনিক সিদ্ধান্তের কারণে তার বিরুদ্ধে করা ফৌজদারি মামলা ‘চলতে পারে না’।

দুর্নীতি দমন কমিশন ২০০৭ সালের ২ সেপ্টেম্বর সাবেক চার দলীয় জোট সরকারের প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া, তার ছোট ছেলে আরাফাত রহমান কোকোসহ ১৩ জনের বিরুদ্ধে এ মামলা দায়ের করেন।

এতে বলা হয়, আসামিরা পরস্পর যোগসাজশে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান গ্যাটকোকে ঢাকার কমলাপুর আইসিডি ও চট্টগ্রাম বন্দরের কন্টেইনার হ্যান্ডেলিংয়ের কাজ পাইয়ে দিয়ে রাষ্ট্রের ১৪ কোটি ৫৬ লাখ ৩৭ হাজার ৬১৬ টাকার ক্ষতি করেছেন। মামলা হওয়ার পরদিন খালেদা জিয়া ও কোকোকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল।


খনি দুর্নীতি মামলার শুনানি ২৪ জুন

বড় পুকরিয়া কয়লা খনি দুর্নীতি মামলা বাতিল চেয়ে খালেদা জিয়ার করা আবেদনের রুলের ওপর শুনানির জন্য ২৪ জুন দিন রেখেছেন হাইকোর্ট।

চীনা প্রতিষ্ঠান কনসোর্টিয়াম অফ চায়না ন্যাশনাল মেশিনারিজ ইমপোর্ট অ্যান্ড এক্সপোর্ট করপোরেশনের (সিএমসি) সঙ্গে বড় পুকুরিয়া কয়লা খনির উৎপাদন, ব্যবস্থাপনা ও রক্ষণাবেক্ষণ চুক্তি করার মধ্য দিয়ে রাষ্ট্রের প্রায় ১৫৮ কোটি ৭১ লাখ টাকার ক্ষতি করার অভিযোগ আনা হয়েছে এই মামলায়।

মামলা বাতিলে খালেদা জিয়ার আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ২০০৮ সালের ১৬ অক্টোবর হাই কোর্ট এর কার্যক্রম স্থগিত করে। সাত বছর পর চলতি বছরের শুরুতে দুদক মামলাটি সচল করার উদ্যোগ নেয়।

“খালেদা জিয়াসহ বিএনপির নেতা-কর্মীদের যেভাবে মামলা ও হামলার ঘটনায় জড়িয়ে জেলে নেওয়া হচ্ছে তাতে জেলখানায় আর জায়গা হবে না। কোনো গণতান্ত্রিক ও সভ্য সমাজে এমন দমন-পীড়ন চলতে পারে না,” বেনারকে জানান বিএনপি নেতা মনির হোসেন, যিনি বিএনপির অঙ্গসংগঠন ছাত্রদলের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সাধারণ সম্পাদক ছিলেন।  

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।