বিদেশি হত্যাকান্ডের পাশাপাশি ঘটছে আরো হত্যা, বাড়ছে অস্থিরতা‏

ঢাকা থেকে জেসমিন পাপড়ি
2015.10.06
BD-killing জেএমবির সামরিক শাখার প্রধান জাভেদ সহ কয়েকজনকে আটক করে পুলিশ, মঙ্গলবার বোমা বিস্ফোরণে জাভেদ পরে নিহত হন বলে জানায় পুলিশ। ৫ অক্টোবর,২০১৫
বেনার নিউজ

নানা অর্জনের সুবাতাসের মধ্যে হঠাৎ করেই এক ধরনের অস্থিরতার মুখে পড়েছে বাংলাদেশ। যার শুরু হয় পরপর দুইজন বিদেশি হত্যা দিয়ে। তবে গত কয়েকদিনে একজন ধর্মীয় যাজক হতার চেষ্টা, বাংলাদেশের স্পর্শকাতর এলাকা বান্দরবনে দুইজন পর্যটক নিখোঁজ, বিদ্যুত উন্নয়ন বোর্ডের একজন সাবেক চেয়ারম্যানের লাশ উদ্ধার ও অস্ত্র সহ বেশ কিছু জেএমবি সদস্য আটক ও তাদের এক নেতার বোমায় নিহত হবার ঘটনা সে অস্থিরতাকে আরো উসকে দিয়েছে।

কয়েকটি ছাড়া বাকি ঘটনাগুলো দেশীয় রাজনীতিতে বিদেশী মদদের ফল বলে মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। তবে সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, যে কোন ধরনের পরিস্থিতি মোকাবেলায় প্রস্তুত সরকার।


গির্জার যাজককে গলা কেটে হত্যার চেষ্টা

সোমবার পাবনার ঈশ্বরদীতে বাড়িতে ঢুকে লুক সরকার (৫০) নামে গির্জার এক যাজককে গলা কেটে হত্যার চেষ্টা করেছে দুর্বৃত্তরা। এদিন সকালে উপজেলার বিমানবন্দর সড়কের গোকুলনগর এলাকায় এ ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় জড়িত সন্দেহে এক যুবককে আটক করেছে পুলিশ। সাতক্ষীরার বাসিন্দা লুক সরকার গত পাঁচ বছর ধরে গোকুলনগর এলাকার ব্যাপ্টিস্ট মিশনের ‘ফেইথ বাইবেল চার্চ’-এর যাজক হিসেবে কর্মরত ছিলেন।

আহত লুক সরকারের পরিবারের সদস্যরা জানান, সোমবার সকালে ধর্মবাণী শোনার জন্য তিনজন যুবক আসে। বাইবেল থেকে কিছু বাণী পড়ে শোনানোর মধ্যে দুই যুবক বসা থেকে উঠে তার দুই হাত চেপে ধরেন। আরেক যুবক মুখ চেপে গলায় ধারালো অস্ত্র চালাতে থাকেন। লুক সরকার ওই যুবকের হাতের আঙুলে কামড় দিলে যুবক হাত সরিয়ে নেওয়ায় তিনি চিৎকার দেন। তা শুনে পরিবারের লোক ছুটে আসলে যুবকরা পালিয়ে যান। তবে এলাকাবাসীর ধাওয়ায় মুখে তারা তাদের মোটরসাইকেলটি ফেলে যান।

আহত লুক সরকারের গলার চামড়ায় কয়েকটি সেলাই দিতে হয়েছে। তবে ক্ষত গভীরে না যাওয়ায় তিনি শঙ্কামুক্ত বলে জানান স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের চিকিৎসা কর্মকর্তা শফিকুল ইসলাম।

এদিকে এ ঘটনায় জড়িত সন্দেহে ওবায়দুর রহমান (২২) নামে একজন শিবির কর্মীকে আটক করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন ঈশ্বরদী সার্কেলের সহকারী পুলিশ সুপার এসএমএ জাহিদ।

“গোপন সংবাদের ভিত্তিতে সকাল সাড়ে ৯টার দিকে আওতাপাড়া গ্রামে অভিযান চালিয়ে তাকে আটক করা হয়। বিস্তারিত তথ্যের জন্য তাকে জিজ্ঞাবাদ করা হচ্ছে।” –বেনারকে বলেন তিনি।


পাহাড়ে পর্যটক, গাইডসহ চারজন ‘অপহৃত’

অস্থিরতা থেকে নিস্তার পায়নি দেশের পার্বত্য এলাকাও। দুইজন গাইডসহ দুই পর্যটক  নিখোঁজ হয়েছেন বান্দরবনে।  ‘সশস্ত্র একটি দল’ তাদেরকে অপহরণ করেছে বলে বিলাইছড়ি উপজেলার বরথলি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আতোমং মারমার বরাত দিয়ে বিভিন্ন গণমাধ্যমে খবর প্রকাশিত হয়।
বিলাইছড়ি থানার ওসি মনজুরুল আলম জানান নিখোঁজ দুই পর্যটক হলেন মুন্না (৩৪) ও জুবায়ের (২৬)। তাদের গাইডরা হলেন মানছাই ম্রো (৩২) ও লাল রিং ছাং বমকেও (৩০)

ঘটনার একদিন পরেও তাদের বিষয়ে কোন অগ্রগতি জানা যায়নি। তবে রুমা থানার ওসি শরীফুল ইসলাম জানান, “গত শনিবার থেকে দুইজন পর্যটক ও তাদের গাইডসহ চারজনকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। তাদের সন্ধানে অভিযান চালাচ্ছে সেনাবাহিনী ও পুলিশের যৌথদল।”

চেয়ারম্যান আতোমং মারমা জানান, শনিবার বিকেল তিনটার দিকে ১০/১২ জনের সশস্ত্র একটি দল, যাদের পরনে ছিল সেনাবাহিনীর মত পোশাক, আর ভাষা মিয়ানমারের, ওই চারজনসহ মোট ছয়জনকে ধরে নিয়ে যায়। বাকি দুজন হলেন সেপ্রু পাড়া এলাকার অভিরাং ত্রিপুরা ও মনীন্দ্র ত্রিপুরা। তাদের নির্দেশে ভারত সীমান্তের পথ দেখিয়ে দিলে ওই দুজনকে ছেড়ে বাকিদের নিয়ে যায়।”


নৃসংশভাবে খুন হলেন পিডিবির সাবেক চেয়ারম্যান

একের পর এক ঘটনা নিয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী যখন অস্থির ঠিক তখন খুন হলেন বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) সাবেক চেয়ারম্যান মুক্তিযোদ্ধা খিজির খান। সোমবার রাজধানীর বাড্ডায় নিজ বাসা থেকে হাত-পা বাধা অবস্থায় তার গলাকাটা লাশ উদ্ধার করা হয়। দুর্বৃত্তরা সোমবার রাত সাড়ে ৮টার দিকে বাসায় ঢুকে খিজির খানকে হত্যা করে।

পুলিশ জানায়, খিজির খান নক্সাবন্দিয়া মুজাদ্দেদিয়া তরিকার একজন পীর ছিলেন। বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ তার বাড়িতে যাতায়াত করত। ছয়তলা বাড়ির তৃতীয় তলায় তিনি পরিবারের সঙ্গে বসবাস করতেন আর দ্বিতীয় তলায় ছিল তার খানকা শরীফ। দুর্বৃত্তরা দ্বিতীয় তলায় এ হত্যাকাণ্ড ঘটায়।


গ্রেনেড বিস্ফোরণে আটক জেএমবি নেতার মৃত্যু

আটকের পরদিনই নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গি সংগঠন জামায়াতুল মোজাহিদিন বাংলাদেশের (জেএমবি) চট্টগ্রামের সামরিক শাখার প্রধান মো. জাবেদ গ্রেনেড বিস্ফোরণে মারা গেছেন।  নগর গোয়েন্দা পুলিশের হাতে গ্রেফতারের পর ভোরে আরেকটি গোপন আস্তানায় অভিযান চালাতে গিয়ে আহত হন জাবেদ।  

মঙ্গলবার ভোর সোয়া ৬টায় চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালের কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন বলে বেনারকে নিশ্চিত করেন চমেক পুলিশ ফাঁড়ির নায়েক মোহাম্মদ আবু হামিদ।

নগর গোয়েন্দা পুলিশের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার (উত্তর-দক্ষিণ) বাবুল আক্তার জানান, বায়েজিদ বোস্তামি থানার অনন্যা আবাসিক এলাকায় তাদের আরও একটি গোপন আস্তানা আছে বলে গ্রেফতারের পর স্বীকারোক্তি দেয় জাবেদ।

সে তথ্য অনুযায়ী সেখানে অভিযান চালাতে যায় নগর গোয়েন্দা পুলিশ।  ভোর রাতে অক্সিজেন-কুয়াইশ সড়কে গোপন আস্তানা থেকে আর একটি গ্রেনেড উদ্ধারের পর সেটি বিস্ফোরিত হয়ে জাবেদ এবং পুলিশের উপ-পরিদর্শক (এসআই) মো. ইলিয়াস ও কনস্টেবল ফয়সাল আহত হন।  পরে তাদের তিনজনকে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালে নেওয়া হলে কর্তব্যরত চিকিৎসক জাবেদকে মৃত ঘোষণা করেন।

সোমবার (০৫ অক্টোবর) বিকেলে নগরীর কর্ণফুলী থানার খোয়াজনগর লালমিয়া কন্ট্রাকটর সড়কের হাজী নুর আহমদ টাওয়ারের নিচতলায় গোপন আস্তানায় অভিযান চালিয়ে জেএমবি প্রধান মো. জাবেদসহ পাঁচজনকে গ্রেফতার করা হয়। পাশাপাশি তাদের কাছ থেকে নয়টি হ্যান্ড গ্রেনেড, কয়েক’শ রাউন্ড গুলি, একটি পিস্তল, ১০টি ছোরা, বিপুল পরিমাণ বোমা তৈরির সরঞ্জাম ও জিহাদি বই উদ্ধার করা হয়।


অপরাধীদের বিচারের মুখোমুখি করার দাবি

ভিন্ন ভিন্ন স্থানে এইসব ঘটনা ঘটলেও অভিন্ন লক্ষ্যে একটি মহল একের পর এক এসব ঘটিয়ে চলেছে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। আর সাধারণ মানুষ বলছেন, বাংলাদেশকে আবারও পিছন থেকে টেনে ধরার চেষ্টা চলছে। যা এখনই বন্ধ করা প্রয়োজন।

একেএম মঈনউদ্দিন নামে রাজধানীর একজন বাসিন্দা বেনারকে বলেন, “বৈশ্বিক নানা সূচকে বাংলাদেশের অগ্রগতির খবর এখন নিত্য নৈমত্তিক ঘটনা। এর মাঝে বিদেশি হত্যা, ধর্মযাজক হত্যা চেষ্টাসহ নানা ধরনের অস্থিরতা তৈরি আমাদের উন্নতির অগ্রযাত্রাকে থামিয়ে দেওয়ার চেষ্টা বৈ কিছু নয়”।

তার মতে, কোন একটি মহল বাংলাদেশকে অস্থিতিশীল রাষ্ট্র হিসেবে বিশ্বের কাছে পরিচিত করতে চায়। এটা প্রাথমিক ধাক্কা বলা যায়। যা অব্যাহত থাকলে এদেশের সকল অর্জন ধূলিস্মাৎ হয়ে যাবে। তাই সরকারের উচিত এসব ষড়যন্ত্রের সঙ্গে জড়িতদের খুঁজে বের করে শাস্তির মুখোমখি করা।

এদিকে এসব ঘটনায় বিদেশি মদদের গন্ধ পেয়েছেন রাজনীতি বিশ্লেষক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. নেহাল করিম। তিনি বেনারকে বলেন, সাম্প্রতিককালে ঘটে যাওয়া হত্যাকান্ডগুলোর দু’একটি ব্যক্তিগত শত্রুতা থেকে ঘটতে পারে। তবে দুইজন বিদেশিসহ বেশিরভাগ হত্যাকান্ডই দেশে অস্থিতিশীল অবস্থা বা ত্রাস সৃষ্টি করার উদ্দেশ্যে ঘটনানো হয়েছে তাতে কোন সন্দেহ নেই। আভ্যন্তরীন রাজনৈতিক ইস্যুতে বিদেশি মদদের ফল হতে পারে এসব ঘটনা। তাই দেশের স্বার্থেই সরকারকে আরো তৎপর হতে হবে।  


প্রতিটি ঘটনার তদন্ত চলছে, পুলিশের দাবি

তবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বলছে, যেকোন চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় প্রস্তুত রয়েছে তারা।

ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি) মিডিয়া সেন্টারের উপ-পুলিশ কমিশনার (ডিসি)মোনতাসিরুল ইসলাম বেনারকে বলেন, “প্রত্যেকটি ঘটনার তদন্ত করে সত্য রহস্য উদঘাটন করে, জড়িতদের আইনের আওতায় আনা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দায়িত্ব। পুলিশ সে চেষ্টা অব্যাহতে রেখেছে। আশা করি সব ঘটনার রহস্য উদঘাটন করতে পারব আমরা। যে কোন ধরনের অস্থিরতা মোকাবেলার সক্ষমতা বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর আছে। কোন অপরাধীই অপরাধ করে পার পাবে না।”

তবে তাদের হাতে কোন ম্যাজিক নেই উল্লেখ করে ডিএমপির এই কর্মকর্তা বলেন, “পুলিশ সাক্ষ্য প্রমানের ভিত্তিতে কাজ করে। অপরাধীরা প্রকাশ্যে কোন অপরাধ স্বীকার করেনা। তারা তা গোপন করতে নানা কৌশল অবলম্বন করে। সেসব যাচাই করে কোন কোন মামলার তদন্তে দ্রুত সফলতা পাওয়া যায়, আবার কোনটার সফলতা পেতে দেরি হয়। এটাই  সারা পৃথিবীতে তদন্তের নিয়ম। ইচ্ছাকৃতভাবে আইনশৃঙ্খলাবাহিনী কোন কাজের দীর্ঘসূত্রিতা করে না।”

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।