হত্যাকান্ডে জড়িত সন্দেহভাজন প্রশ্নে বাংলাদেশ ও ভারতের অভিন্ন মত
2015.10.07

দুই বিদেশি হত্যাকাণ্ডে কারা জড়িত নয় এবং কারা এ হত্যাকাণ্ড ঘটাতে পারে, তা নিয়ে বাংলাদেশ ও বাংলাদেশের ভেতরেও বিভিন্ন আলোচনা সভা, সেমিনার ও টকশোতে আলোচনার অন্যতম বিষয় হয়ে উঠেছে।
বাংলাদেশে দুই বিদেশি নাগরিক হত্যার ঘটনায় ইসলামিক স্টেটের (আইএস) জড়িত থাকার সম্ভাবনা নাকচ করে দিয়েছেন ভারতীয় গোয়েন্দারা। চাঞ্চল্যকর এই হত্যাকাণ্ড নিয়ে বাংলাদেশ সরকারও একই মত দিয়ে আসছে।
অন্যদিকে এসব হত্যায় বাংলাদেশের ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল জামায়াতে ইসলামীর হাত থাকতে পারে বলে মত দিয়েছেন ভারতীয় গোয়েন্দারা। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও গত রবিবার সংবাদ সম্মেলন করে বলেছেন, বিদেশি হত্যায় বিএনপি–জামায়াতের মদদ আছে।
ভারতের প্রভাবশালী ইংরেজি দৈনিক ‘টাইমস অব ইন্ডিয়া’র প্রতিবেদনে গত মঙ্গলবার দেশটির উচ্চপদস্থ গোয়েন্দা কর্মকর্তাদের উদ্ধৃতি দিয়ে বলা হয়, বাংলাদেশে আইএস কিংবা তেমন কোনো সংগঠনের তৎপরতা গড়ে উঠতে পারেনি।
“দেশে আইএসের অস্তিত্ব প্রমাণিত না হলেও এখানকার জঙ্গিরা যে আইএসের দ্বারা অনুপ্রাণিত, তা বোঝা যায়। আইএসের মতোই তাদেরও লক্ষ্য মূলত অমুসলিম, মাজারকেন্দ্রিক পীর-দরবেশ ও অন্য ধর্মীয় নেতারা,” জানান নিরাপত্তা বিশ্লেষক ইশফাক এলাহী, যিনি অবসরপ্রাপ্ত এয়ার কমোডর এবং একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার।
ভারতীয় গোয়েন্দারা মনে করছেন, একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত করার উদ্দেশ্যে জামায়াতের কট্টরপন্থী লোকজন বিদেশি হত্যার মাধ্যমে বাংলাদেশে অস্থিতিশীলতা তৈরি করতে চাচ্ছে। বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকেও এমন ধারণা দেওয়া হচ্ছে।
যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসির ইস্যুটি যুক্ত
টাইমস অব ইন্ডিয়াকে ওই দেশের গোয়েন্দা সংস্থার একজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা জানান, মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে এরই মধ্যে জামায়াতের একাধিক শীর্ষ নেতার ফাঁসি কার্যকর করা হয়েছে এবং আরও কয়েকজনের বিচার সম্পন্নের প্রক্রিয়া চলছে।
উল্লেখ্য, জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদকে ইতিমধ্যে মৃত্যু পরোয়ানা পড়ে শোনানো হয়েছে। আর সুপ্রিম কোর্টে জামায়াতের আমির মতিউর রহমান নিজামীর আপিল শুনানি পর্যায়ে রয়েছে।
আর বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীকেও মৃত্যু পরোয়ানা পড়ে শোনানো হয়েছে, যিনি রাজনীতিতে হঠকারিতা ও রহস্যজনক কর্মকাণ্ডের জন্য পরিচিত।
ভারতীয় গোয়েন্দাদের দাবি, বাংলাদেশে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি তৈরির মাধ্যমে মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার বিষয়ে পশ্চিমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করাই বিদেশি হত্যার নেপথ্য উদ্দেশ্য হতে পারে।
একজন গোয়েন্দা টাইমস অব ইন্ডিয়াকে বলেছেন, “যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালের মাধ্যমে এরই মধ্যে কাদের মোল্লা ও কামারুজ্জামানের মতো জ্যেষ্ঠ নেতাদের সর্বোচ্চ শাস্তি বাস্তবায়ন হতে দেখেছে জামায়াত, এতে ক্ষুব্ধ হয়ে বাংলাদেশের মাটিতে বিদেশি হত্যা করে হাসিনা সরকারকে বেকায়দায় ফেলতে চায় তারা।”
“একের পর এক যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হচ্ছে। বিএনপির চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার দুর্নীতির মামলার রায় সহসাই ঘোষণা হবে। একুশে আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলায় তাঁর ছেলে তারেক রহমানের শাস্তি হতে পারে বলে আইনজীবীরা মত দিচ্ছেন। এ অবস্থায় বিএনপি–জামায়াত থেমে থাকবে না,” বেনারকে জানান বস্ত্র ও পাট প্রতিমন্ত্রী মীর্জা আজম, যিনি আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতা।
আইএস জড়িত না থাকার যুক্তি
বাংলাদেশে বিদেশি হত্যায় আইএস জড়িত নয়—এমন দাবির পেছনে ভারতীয় গোয়েন্দাদের যুক্তি, “বাংলাদেশে সংঘটিত দুই বিদেশি হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে আইএসের হত্যার ধরনের মিল নেই। আইএস শিরশ্ছেদের মাধ্যমে মানুষ হত্যা করে এবং সেসব নির্মম হত্যাকাণ্ড ভিডিও করে প্রচার করে। কিন্তু বাংলাদেশে দুই বিদেশিকেই হত্যা করা হয়েছে গুলি করে।”
প্রসঙ্গত, গত ২৮ সেপ্টেম্বর ঢাকার গুলশান এলাকায় আততায়ীর গুলিতে নিহত হন বাংলাদেশে কর্মরত ইতালির নাগরিক তাবেলা সিজার। এর পাঁচ দিনের মাথায় গত ৩ অক্টোবর রংপুরে একই কায়দায় গুলি করে হত্যা করা হয় জাপানের নাগরিক হোশি কোনিওকে।
“বাংলাদেশে জঙ্গিবাদীদের উপস্থিতি নেই এ কথা যেমন সত্য নয়, তেমনি এটাও সত্য নয় যে সারা দেশে তারা নিজেদের নিরঙ্কুশ প্রাধান্য বিস্তার করতে এবং নিজেদের ইচ্ছাকে কার্যকর করতে সক্ষম,” বেনারকে জানান মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের অন্যতম ট্রাস্টি জিয়াউদ্দিন তারিক আলী।
তিনি মনে করেন, জামায়াতে ইসলামীসহ সমধর্মী সব সংগঠন নিষিদ্ধ করা, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার দ্রুততার সঙ্গে শেষ করা এবং মুক্তবুদ্ধি চর্চাকারীদের হত্যার সব মামলার বিচার সম্পন্ন করা সময়ের দাবি।
কোনও ঘটনার কুলকিনারা হচ্ছে না
দুই বিদেশি নাগরিক হত্যার ঘটনার মতো বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) সাবেক চেয়ারম্যান মুহাম্মদ খিজির খানের হত্যা নিয়েও অন্ধকারে আছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।
তবে খিজির খানের হত্যার ধরনের সঙ্গে গত বছরের আগস্টে ঢাকায় মাওলানা নুরুল ইসলাম ফারুকী, এর আগের বছর ইমাম মাহদীর প্রধান সেনাপতি দাবিদার লুৎফর রহমানসহ ছয়জন খুন এবং গত মাসে চট্টগ্রামে লেংটা ফকির রহমতউল্লাসহ দুজনকে হত্যার ধরনে অনেক মিল রয়েছে বলে জানিয়েছেন পুলিশের কর্মকর্তারা।
এসব হত্যার কোনোটারই কোনো কূলকিনারা করতে না পারলেও সবগুলোতেই তদন্তসংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সন্দেহ ধর্মীয় উগ্রপন্থী গোষ্ঠীর দিকে।
জঙ্গিরা আছে কি নেই: গোলটেবিল বৈঠক
দেশের শীর্ষ ইংরেজি দৈনিক দ্য ডেইলি স্টার আয়োজিত ‘জঙ্গিবাদ ও বাংলাদেশের সামনে চ্যালেঞ্জ’ শীর্ষক এক গোলটেবিল আলোচনায় বক্তারা বলেছেন, দেশে জঙ্গিগোষ্ঠীগুলোর কর্মকাণ্ড ও তাঁদের সঙ্গে আন্তর্জাতিক জঙ্গি-সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর যোগাযোগ অনেক পুরোনো।
তাঁরা বলছেন, এদের নেটওয়ার্ক সম্পর্কে গোয়েন্দা সংস্থা, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কিংবা বেসরকারি গবেষকদের ধারণাও অস্পষ্ট। জঙ্গিবিরোধী কাজে সমন্বয়েরও অভাব রয়েছে।
গতকাল মঙ্গলবার ডেইলি স্টার সেন্টারের এ এস মাহমুদ সেমিনার হলে এই গোলটেবিল আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়।
“দেশে জঙ্গিগোষ্ঠীগুলোর কাজকর্ম ও আন্তর্জাতিক যোগাযোগ সম্পর্কে আমরা খুব কমই জানি। সরকারের পক্ষ থেকে একেক সময় একেক রকম বক্তব্য দেওয়ায় বিভ্রান্তি সৃষ্টি হচ্ছে,” সভায় জানান সাবেক নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন।
তাঁর মতে, দুই বিদেশি নাগরিক হত্যায় একই ধরনের অস্ত্র ও গুলি ব্যবহার হওয়ার তথ্যও গভীর উদ্বেগের। কারণ এতে প্রমাণিত হয়, হত্যাকাণ্ড দুটি নির্দিষ্ট লক্ষ্যাভিসারি ও একই গোষ্ঠীর কাজ।
নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর জেনারেল (অব.) আবদুর রশীদ বলেন, “এ দেশের জঙ্গিদের আন্তর্জাতিক যোগাযোগ সামান্য। এখানে আন্তর্জাতিক নেটওয়ার্কভুক্ত জঙ্গি নেই বলেই ধারণা করা হয়। তবে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে জঙ্গিদের কর্মকাণ্ডের প্রভাব এ দেশের জঙ্গিদের ওপরও পড়ে।”
গত এক বছরে জঙ্গিরা বিশ্বে মোট ৩৩ হাজার মানুষ হত্যা করেছে উল্লেখ করে বাংলাদেশ এন্টারপ্রাইজ ইনস্টিটিউটের ফয়েজ সোবহান বলেন, এ দেশের হুজি, জেএমবি, হিযবুত তাহ্রীর, আনসারুল্লাহ বাংলা টিম প্রভৃতি সংগঠনের সঙ্গে আন্তর্জাতিক জঙ্গিদের যোগসাজশ থাকতে পারে।
“আইএস-বিরোধী আন্তর্জাতিক উদ্যোগে প্রায় ৬০টি দেশ যুক্ত। ইতালি ও জাপান এর মধ্যে আছে। সেদিক থেকে ওই দুই দেশের দুই নাগরিক হত্যা একটি নতুন ইঙ্গিতবহ হতে পারে,” জানান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের শিক্ষক এ এস এম আলী আশরাফ।
ডেইলি স্টার সম্পাদক মাহফুজ আনাম বলেন, “দেশে জঙ্গিদের কর্মকাণ্ড সম্পর্কে বাড়িয়ে বলা যেমন উচিত নয়, তেমনি কমিয়ে বলারও সুযোগ নেই। দরকার প্রকৃত তথ্য জনগণকে জানানো এবং জঙ্গিবিরোধী কাজে সবার একাত্মতা।”