পরিকল্পিত হত্যা ঠেকাতে ব্যর্থ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর পদত্যাগ দাবি

ঢাকা থেকে শাহরিয়ার শরীফ
2015.11.03
BD-killing ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সাধারন ছাত্ররা প্রকাশক হত্যার প্রতিবাদ সমাবেশ করেছে। ৩ নভেম্বর, ২০১৫
বেনার নিউজ

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু ও পুলিশ প্রধান শহীদুল হকসহ সরকারের মন্ত্রী, সরকারদলীয় নেতা ও পুলিশ বা গোয়েন্দা কর্মকর্তাদের অনেকেই প্রকাশ্যে বলছেন, টার্গেট কিলিং বা পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড ঠেকানো সম্ভব নয়।

তাঁদের এই বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে পাল্টা প্রশ্ন তুলে সুশীল সমাজ ও বামপন্থী রাজনীতিবিদেরা বলছেন, নীতিনির্ধারকেরা যদি এমন বক্তব্য দেন, তাহলে হত্যাকারীরা পরিকল্পিত হত্যাকান্ড ঘটাতে আরও বেশি উৎসাহিত হবে।

এমন বক্তব্য দেওয়ায় গণজাগরণ মঞ্চ, বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নসহ বিভিন্ন সংগঠন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর পদত্যাগ দাবি করে আসছে। গতকাল মঙ্গলবার তাঁর পদত্যাগ দাবি করেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি।

জাগৃতি প্রকাশনীর ফয়সল আরেফিন দীপনকে হত্যা ও শুদ্ধস্বরের আহমেদুর রশীদ চৌধুরী টুটুলসহ তিনজনকে আহত করার প্রতিবাদে দেশজুড়ে প্রতিবাদ ও নিন্দার ঝড় অব্যাহত রয়েছে । গত সোমবার রাতে আরেকজন ব্লগার হুমকি পেয়ে নিরাপত্তা চেয়ে থানায় জিডি করেছেন।

গণজাগরণ মঞ্চের আহবানে মঙ্গলবার সারাদেশে অর্ধদিবস হরতাল পালিত হয়েছে। বৃহস্পতিবার তারা নতুন কর্মসূচি দিয়েছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রনালয় অভিমুখে কফিন মিছিল এবং শুক্রবার শাহবাগে সংহতি সমাবেশ অনুষ্ঠিত হবে।

এদিকে ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিসে বাংলাদেশ দূতাবাস সংলগ্ন সড়কটির নাম বদলে ‘রুই অভিজিৎ রায়’ বা অভিজিৎ রায় সড়ক রেখে প্রতীকী প্রতিবাদ জানানো হয়েছে।

তবে সাম্প্রতিক কিছু হত্যাকাণ্ড পর্যালোচনা করে অপরাধ বিশেষজ্ঞেরা বলছেন, টার্গেট কিলিংয়ের প্রবণতা বেড়েছে। আগে পথেঘাটে খুন হলেও এখন ঘরে বা অফিসে ঢুকে খুন করা হচ্ছে।

এমনকি শরীরের স্পর্শকাতর স্থানে কোপ বসানো হচ্ছে, যাতে মৃত্যু নিশ্চিত হয়। নির্বিঘ্নে খুন করে পালিয়েও যাচ্ছে দুর্বৃত্তরা। এসব খুনের ঘটনা সাধারণ মানুষের মধ্যে যেমন আতঙ্ক ছড়াচ্ছে, তেমনি উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় রয়েছে পুলিশও।

“টার্গেট কিলিং বা পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড প্রতিরোধ করা খুব সহজ কাজ নয়। কেউ যদি হত্যার জন্য টার্গেট করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পক্ষে তা আগে থেকে জানা সম্ভব নয়। এ ধরনের হত্যাকাণ্ড ঠেকানোর মতো প্রচুর জনবলও আমাদের নেই,” সাংবাদিকদের জানান গোয়েন্দা পুলিশের যুগ্ম কমিশনার মনিরুল ইসলাম।

প্রায় একই কথা বলেছেন পুলিশের মহাপরিদর্শক শহীদুল হক এবং তাঁদের সঙ্গে সুর মিলিয়েছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও তথ্যমন্ত্রীসহ অনেকেই।

“এমন স্পর্শকাতর বিষয়ে কথা বলার আগে এর প্রভাব নিয়ে পুলিশ ও নীতিনির্ধারকদের ভাবা উচিত। তাঁরা যদি টার্গেট কিলিং ঠেকাতে নাও পারেন, তাহলে তা ঢোল পিটিয়ে কেন বলতে হবে?” বেনারের কাছে প্রশ্ন রাখেন অধ্যাপক অজয় রায়, যিনি নিহত অভিজিৎ রায়ের বাবা।

প্রবীণ এই অধ্যাপকের মতে, যদি তারা এটা ঠেকাতে না পারেন, তাহলে তো তাদের দায়িত্ব থেকে সরে যাওয়া উচিত।

অপরাধ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, চাঞ্চল্যকর অনেক খুনের ঘটনা উদ্ঘাটন করতে না পারায় বারবার একই ধরনের ঘটনা ঘটছে। অপরাধীদের গ্রেপ্তার ও আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে রাখার দায়িত্ব যাদের, সেই পুলিশ সদস্যরাও এখন অপরাধীদের টার্গেটে পরিণত হয়েছে। ২২ অক্টোবর রাজধানীর গাবতলীতে চেকপোস্টে এক পুলিশ সদস্যকে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা।

সাম্প্রতিক সময়ে দুই বিদেশি নাগরিক হত্যা, আশুরার তাজিয়া মিছিলে হামলা করে হত্যার মত ঘটনা ঘটে। এর আগে ৫ অক্টোবর বাড্ডায় নিজ বাসায় খুন হন বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের সাবেক চেয়ারম্যান প্রকৌশলী খিজির খান।

সর্বশেষ গত শনিবার মাত্র চার ঘণ্টার ব্যবধানে রাজধানীর শাহবাগ ও লালমাটিয়ায় কুপিয়ে হত্যা করা হয় এক প্রকাশককে এবং অপর তিন প্রকাশক-ব্লগারকে কুপিয়ে আহত করা হয়।


আহসান কবীরের জিডি

নিরাপত্তাহীনতার কথা উল্লেখ করে জিডি করেছেন রম্য লেখক ও একটি বেসরকারি টেলিভিশনের অনুষ্ঠান বিভাগের প্রধান আহসান কবির । গত সোমবার রাতে রাজধানীর বনানী থানায় জিডিটি নথিভুক্ত হয়েছে বলে জানান ওই থানার ওসি মো. সালাউদ্দিন।

তিনি বলেন, “আহসান কবির জিডিতে নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন বলে দাবি করেছেন।”

এ বিষয়ে আহসান কবির সাংবাদিকদের বলেছেন, “৩১ অক্টোবর তিনজনকে আহত ও একজনকে মেরে ফেলার পর আনসার আল ইসলাম আল কায়েদা উপমহাদেশ শাখা টুইটারে একটা বিশ্লেষণ দেয়।”

“বিশ্লেষণের শিরোনাম ‘আহমেদুর রশীদ টুটুল ও ফয়সল আরেফিন দীপনের অপরাধ সমূহ’ । সেখানে দীপনের অপরাধ দুটি। তাদের ভাষ্যমতে, একটা অপরাধ হল অভিজিৎ রায়ের বই ছাপানো। সেখানে ইসলামকে ব্যঙ্গ করা হয়েছে বলে অভিযোগ করা হয়েছে।”

তিনি বলেন, “ফয়সল আরেফিন দীপনের দ্বিতীয় অপরাধ হিসেবে লেখা হয়, আলেম-ওলামাদের কটাক্ষ করে আহসান কবিরের রম্য লেখা ছাপানো। জিডিতে উল্লেখ করেছি, আমার কোনো বইয়ে আমি কোনো ধর্মের পক্ষে বা বিপক্ষে কোনো শব্দ বা বর্ণও লিখিনি।”


প্যারিসে অভিজিতের নামে সড়ক

ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিসে বাংলাদেশ দূতাবাস সংলগ্ন সড়কটির নাম বদলে ‘রুই অভিজিৎ রায়’ বা অভিজিৎ রায় সড়ক রেখে প্রতীকী প্রতিবাদ জানানো হয়েছে । গত রোববার ‘আন্তর্জাতিক দায়মুক্তি অবসান দিবস’ উপলক্ষে সাংবাদিকদের আন্তর্জাতিক সংগঠন রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডারস প্যারিসের ১২টি রাস্তার নাম বদলে এই প্রতীকী প্রতিবাদ কর্মসূচি পালন করে।

অভিজিৎ রায় মুক্তমনা ব্লগের প্রতিষ্ঠাতা। তিনি ব্লগার ও বিজ্ঞান লেখক ছিলেন। চলতি বছরের ২৬ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় প্রকাশ্যে তাঁকে কুপিয়ে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা।

সারা বিশ্বে ৯০ ভাগ ক্ষেত্রে বিচারহীনতার কারণে সাংবাদিক নির্যাতনের শিকার সংশ্লিষ্ট দেশের দূতাবাস যে রাস্তায় অবস্থিত, তার নাম পরিবর্তন করে ওই দেশের নির্যাতিত সাংবাদিক, ব্লগার, লেখকের নামকরণ করে প্রতীকী প্রতিবাদ কর্মসূচি পালন করা হয়।

প্যারিসের হেনরি মার্টিন অ্যাভিনিউয়ে বাংলাদেশ দূতাবাস অবস্থিত। বাংলাদেশ দূতাবাসে যাওয়ার এই রাস্তাকে ‘রুই অভিজিৎ রায়’ হিসেবে অভিহিত করে সংগঠনটি।


স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর পদত্যাগ দাবি

একের পর এক মুক্তমনা মানুষদের হত্যাকাণ্ডের ঘটনার দায় নিয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খানকে পদত্যাগ করার আহ্বান জানিয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক ।

মঙ্গলবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাজেয় বাংলায় প্রকাশক ফয়সল আরেফিন দীপন হত্যা এবং এক প্রকাশক ও দুই ব্লগার-লেখকের ওপর হামলার প্রতিবাদে এক মানববন্ধনে এ আহ্বান জানানো হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি এই মানববন্ধনের আয়োজন করে।

মানববন্ধনে দেওয়া বক্তৃতায় শিক্ষক সমিতির সভাপতি অধ্যাপক ফরিদ উদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বারবার বলে আসছেন, এটা বিচ্ছিন্ন ঘটনা। এর সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা অবনতির কোনো সম্পর্ক নেই। এ ধরনের কথা না বলে ব্যর্থতার দায় স্বীকার করুন।’ তিনি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর উদ্দেশ্যে বলেন, ‘বাংলাদেশের প্রগতিশীল মানুষ, অসাম্প্রদায়িক মানুষ ও সাধারণ জনগণের ওপর সম্মান রেখে সসম্মানে পদ ছেড়ে চলে যান। মানুষের জানমালের নিরাপত্তা দিতে না পারলে, আপনার এই পদে থাকার দরকার নেই।’

সমিতির সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক এ এস এম মাকসুদ কামাল বলেন, “যে জামায়াত-শিবির একাত্তরে পরাজিত হয়েছিল, তারা এখন বিভিন্ন নামে আবির্ভূত হয়েছে। হামলাগুলো চালাচ্ছে। প্রতিটি হামলার পর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মৃদু ভাষায় বলেন, হত্যাকারীরা চিহ্নিত, তাদের ধরে ফেলবেন। কিন্তু হত্যাকারীরা ধরা পড়ে না। ধরতে না পারলে সসম্মানে পদ ছাড়েন।”


জাতিসংঘের আহ্বান

প্রকাশক ফয়সল আরেফিন দীপন ও সাম্প্রতিক সময়ের সব ব্লগার হত্যার পূর্ণ তদন্ত করতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে জাতিসংঘ। গত সোমবার নিউইয়র্কে (বাংলাদেশ সময় মঙ্গলবার) জাতিসংঘের সদর দপ্তরে নিয়মিত সংবাদ ব্রিফিংয়ে এক প্রশ্নের জবাবে মহাসচিব বান কি মুনের মুখপাত্র স্টিফেন ডুজারিক এ কথা বলেন। একই সঙ্গে এ ঘটনাগুলোর জন্য দায়ী অপরাধীদের বিচারের মুখোমুখি করার আহ্বানও জানিয়েছেন মহাসচিবের মুখপাত্র।

স্টিফেন ডুজারিক বলেন, “বাংলাদেশে আমরা যে প্রকাশককে হত্যা করতে দেখেছি, আমাদের অবশ্যই তার তীব্র নিন্দা জানানো উচিত।”

প্রকাশক হত্যা ও হামলার ঘটনায় নিন্দা জানিয়েছে কমিটি ফর প্রটেক্ট জার্নালিস্ট (সিপিজে)। গতকাল দেওয়া এক বিবৃতিতে সিপিজের এশিয়া প্রোগ্রাম রিসার্চ অ্যাসোসিয়েট সামিট গালহোত্রা বলেন, “বাংলাদেশে স্বাধীন মত প্রকাশের ওপর যে চরম সহিংসতা হচ্ছে, তা এখন এ ধরনের ভিন্নমত প্রকাশের সহায়তাকারীদের ওপরও প্রসারিত হয়েছে। আমরা বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে চরমপন্থীদের বিচারের আওতায় আনার জন্য স্পষ্ট ও শক্ত অবস্থান নেওয়ার আহ্বান জানাচ্ছি।”

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।