প্রকাশকের পর এবার প্রাণ গেল পুলিশের, এরপর কে?
2015.11.04

রাজধানীর গাবতলী এলাকার তল্লাশি চৌকিতে পুলিশের একজন এএসআই খুন হওয়ার ১৩ দিনের মাথায় গতকাল বুধবার ঢাকার অদূরে আশুলিয়ার বাড়ইপাড়ায় খুন হলেন আরেক পুলিশ সদস্য। পুলিশ কর্মকর্তারা এই হামলার জন্য জঙ্গিদের দিকে ইঙ্গিত করেছেন।
গতকালের ওই হামলায় আরও একজন আহত হয়েছেন। সশস্ত্র পাঁচ পুলিশের দলটির ওপর দুই ব্যক্তি ছুরি-চাপাতি নিয়ে হামলা চালিয়ে ওই হতাহতের ঘটনা ঘটিয়েছে বলে জানিয়েছে পুলিশ। এতে শিল্প পুলিশ কনস্টেবল মুকুল হোসেন (২৫) নিহত ও কনস্টেবল নূরে আলম সিদ্দিকী (২৬) গুরুতর আহত হয়েছেন।
পুলিশ জানিয়েছে, দুই হামলাকারী ছুরি-চাপাতির মুখে কোনো প্রতিরোধ গড়তে পারেনি সশস্ত্র পুলিশ সদস্যরা। পাঁচজনের হাতে পাঁচটি চাইনিজ রাইফেল থাকার পরেও কেউ গুলি ছোঁড়েননি। দুই কনস্টেবল হামলার শিকার হওয়ার পরে সেখানে উপস্থিত অন্য তিনজন শালবনের দিকে দৌড় দেন। এরা হলেন কনস্টেবল ইমরান আজিজ, আপেল মাহমুদ ও পিনারুনুজ্জামান।
তবে হামলাকারীদের কাছেও আগ্নেয়াস্ত্র ছিল। সেটি দিয়ে তারা কয়েক রাউণ্ড ফাঁকা গুলি ছুড়েছে।
ঘটনার পরে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল এনাম হাসপাতালে যান। সেখানে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, “জঙ্গি ও মানবতাবিরোধীদের বিচার কাজ চলছে। তার রায় কার্যকর হওয়ারও সময় ঘনিয়ে এসেছে। এগুলোকে নস্যাৎ করার পাশাপাশি দেশে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি তৈরি করতে এ ধরনের নাশকতা ও আক্রমণ হঠাৎ করে দু-একটি জায়গায় শুরু হয়ে গেছে।”
সশস্ত্র অবস্থায় থাকার পরও পুলিশ সদস্যদের কোনো প্রতিরোধ না করতে পারার বিষয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, বিষয়টি খতিয়ে দেখা হচ্ছে। তদন্ত ছাড়া এ বিষয়ে আপাতত কিছু বলা যাচ্ছে না।
এর আগে ২২ অক্টোবর দুর্গাপূজা উপলক্ষে গোটা শহরে কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থার মধ্যে গাবতলিতে তল্লাশি চৌকিতে ছুরিকাঘাতে দারুস সালাম থানার এএসআই ইব্রাহিম মোল্লা খুন হন।
পুলিশ জানিয়েছিল, ইব্রাহিমকে ছুরিকাঘাতকারী বগুড়ার আদমদীঘি উপজেলা ছাত্র শিবিরের সাবেক সভাপতি। ওই ঘটনার পরে পুলিশ ঢাকা ও বগুড়া থেকে ২৪ জনকে গ্রেপ্তার করে রিমান্ডে নেয়, তাদের কাছ থেকে পাঁচটি হাতে তৈরি গ্রেনেড উদ্ধার করা হয়।
এর আগে গত ২৮ সেপ্টেম্বর ঢাকায় এবং ৩ অক্টোবর রংপুরে যথাক্রমে দুই বিদেশি নাগরিক সিজার তাবেলা ও কুনিও হোশিকে হত্যা, এরপর ৫ অক্টোবর ঢাকায় পিডিবির সাবেক চেয়ারম্যান খিজির খানকে হত্যা এবং পাবনার ঈশ্বরদীতে একজন ধর্মযাজককে হত্যার চেষ্টা করা হয়।
গত ২৩ অক্টোবর পবিত্র আশুরা উপলক্ষে তাজিয়া মিছিলের প্রস্তুতিকালে হামলায় দুজন নিহত হয়। এসবের রেশ না কাটতেই গত শনিবার প্রকাশক ফয়সল আরেফিন দীপনকে হত্যা এবং আরেক প্রকাশককে হত্যার চেষ্টা হয়। এ নিয়ে দেশে–বিদেশে তীব্র সমালোচনার রেশ না কাটতেই একজন পুলিশকে গতকাল খুন করা হল।
ঘটনার বিবরণ
কর্মকর্তারা জানান, ঢাকা-টাঙ্গাইল চার লেনের মহাসড়কের বাড়ইপাড়ায় নন্দন পার্কের উল্টোদিকের ওই তল্লাশি চৌকিতে দুই পালায় ২৪ ঘণ্টাই পুলিশ সদস্যরা মোতায়েন থাকেন। আশুলিয়া থানার ওই চৌকিতে ফোর্স সরবরাহ করে থাকে শিল্প পুলিশ।
ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শীদের সঙ্গে কথা বলে পুলিশ জানায়, গতকাল সকাল সাড়ে সাতটার দিকে পাঁচজন পুলিশ কনস্টেবলকে নন্দনপার্কের সামনে নামিয়ে দিয়ে পুলিশের গাড়িটি চন্দ্রার দিকে চলে যায়। পুলিশ সদস্যরা রাস্তা পার হয়ে নন্দনের উল্টোদিকে পরপর ছয়টি ঝুপড়ি রেস্তোরাঁর একটিতে গিয়ে বসেন। সেই রেস্তোরাঁ তখন কেবল খুলেছে।
মালিকের অনুরোধে পুলিশ সদস্যদের তিনজন পাশের বন্ধ ঝুপড়ি দোকানটিতে গিয়ে বসেন। অন্য দুই সদস্য অনতিদূরেই কোথাও ছিলেন। এই সময় নবীনগরের দিক থেকে উল্টো পথে একটি মোটরসাইকেল এসে সারবাঁধা সেই রেস্তোরাঁগুলোর কোনায় মহাসড়কের ওপর থামে। মোটরসাইকেল থেকে দুই ব্যক্তি নেমে পুলিশ সদস্যরা যে হোটেলটিতে বসেছিল সেখানে ঢুকে সালাম দিয়ে সম্ভাষণ জানান। এরপর তাঁদেরও কোনো আত্মীয় পুলিশে চাকরি করেন বলে আলাপ শুরু হয়।
মিনিটখানেকের মধ্যে মোটরসাইকেলে আসা দুই ব্যক্তির হাতে উঠে আসে ছোরা-চাপাতি। কোনো কিছু বুঝে ওঠার আগেই তাঁরা দুই পুলিশ সদস্যকে আঘাত করে বসেন। হামলাকারীদের একজন আগ্নেয়াস্ত্র বের করে কয়েকটি ফাঁকা গুলিও ছোড়েন।
চাপাতি-ছুরিকাঘাতে আহত কনস্টেবল মুকুল হোসেন ওই দোকান থেকে বেরিয়ে পাশের শুভেচ্ছা ভাতের হোটেলে গিয়ে উপুড় হয়ে পড়েন। হাতে ও পেটে চাপাতির আঘাত নিয়ে কনস্টেবল নুরে আলম রাস্তা পার হয়ে নন্দন পার্কের দিকে দৌড় দেন। তাদের সঙ্গে থাকা অপর তিন কনস্টেবল প্রতিরোধে এগিয়ে না এসে পেছনের শালবনের ভেতরে দৌড় দেন।
গুলির শব্দে নন্দন পার্কের খোলা জায়গায় রাখা বাসগুলোর কর্মীরা, কারখানামুখী শ্রমিকেরা এগিয়ে এসে দুই মোটরসাইকেল আরোহীকে চন্দ্রার দিকে পালিয়ে যেতে দেখেন। পরে লোকজন আহত দুজনকে তুলে হাসপাতালে পাঠালে কনস্টেবল মুকুলকে মৃত ঘোষণা করেন চিকিৎসকেরা।
“কনস্টেবল নূরে আলমকে রক্তাক্ত অবস্থায় ঢাল বেয়ে নামতে দেখে আমি ছুটে গিয়ে তাঁকে ধরি। ঢালের মাঝামাঝি দাঁড়িয়ে দেখি, মহাসড়ক দিয়ে একটি মোটরসাইকেলে দুজন দ্রুত বেগে বাইপাইলের দিকে চলে যাচ্ছেন। মোটরসাইকেল চালক-আরোহীদের মাথায় হেলমেট ছিল না,” ঘটনার পরপর সেখানে উপস্থিত হওয়া বিআরটিসি বাসের চালক কনক দাস সাংবাদিকদের জানান এ কথা।
পুলিশ হত্যার খবর পেয়ে আশুলিয়া থানার পুলিশ, শিল্প পুলিশ, পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই), পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ-সিআইডি, র্যাবসহ বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার কর্মকর্তারা ঘটনাস্থলে আসেন। ঘটনাস্থল থেকে আলামত সংগ্রহ করে সিআইডি ও পিবিআই’র দল। ভাতের হোটেলের ভেতর থেকে দুটি ব্যবহৃত গুলির খোসা উদ্ধার হয়েছে।
পরিকল্পিত হামলা
পুলিশের ভারপ্রাপ্ত মহাপরিদর্শক (আইজিপি) জাবেদ পাটোয়ারি গতকাল দুপুরে ঘটনাস্থলে যান। তিনি সেখানে সাংবাদিকদের বলেন, ধরন দেখে মনে হয়েছে হত্যার উদ্দেশ্যেই পরিকল্পিতভাবে হামলা চালিয়েছে। আইন শৃঙ্খলাবাহিনীর কয়েকটি দল তদন্তে নেমেছে। ওই ঘটনার পরে দেশে পুলিশে সব চৌকিগুলো আরও শক্তিশালী করা হবে বলে জানান ভারপ্রাপ্ত আইজিপি।
“তল্লাশি চৌকিতে দায়িত্ব পালনে যতটা সতর্ক থাকা দরকার সে জায়গায় শৈথিল্য থেকে যাচ্ছে। আর সরকারকে বিব্রতকর অবস্থায় ফেলতেই এ ধরনের পরিকল্পিত হামলা,” বেনারকে জানান পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক নূরুল হুদা।
পরপর পুলিশের ওপর হামলা সামগ্রিকভাবে বাহিনীর মনোবলের ওপর কোনো প্রভাব ফেলেছে কিনা, জানতে চাইলে নূরুল হুদা বলেন, “পুলিশের চাকরিটাই ঝুঁকির। কেউ একজন অতর্কিতে এসে কোনো একজন পুলিশকে হত্যা করলে পুরো বাহিনীর মনোবল ভেঙে যাবে, বিষয়টা তা নয়। তবে যেটা মনে হচ্ছে এ পরিস্থিতিতে যথেষ্ট সতর্কতা নেওয়ার ক্ষেত্রে কিছুটা শৈথিল্য আছে।”