জাপানি নাগরিক হত্যায় আরো ৩ জন আটক
2015.11.13

জাপানি নাগরিক কুনিও হোশিকে গুলি করে হত্যার ঘটনায় জড়িত সন্দেহে রংপুর যুবদল ও সরকারী দলের অঙ্গ সংগঠন যুবলীগের তিন নেতাকে চাঁপাইনবাবগঞ্জ থেকে আটক করেছে বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে তারা হত্যার দায় স্বীকার করেছে বলেও জানিয়েছে র্যাব।
তবে সরকারের পক্ষ থেকে বিদেশি হত্যার ঘটনায় বরাবরের মত বিএনপি জামায়াতকে দায়ী করা হচ্ছে।
এদিকে ঢাকায় ইতালির নাগরিক চেসারে তাভেলা হত্যায় জড়িত সন্দেহে গ্রেপ্তার এম এ মতিনকে আবারও রিমান্ডে নিয়েছে পুলিশ।
র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক মুফতি মাহামুদ খান জানান, বৃহস্পতিবার রাতে চাঁপাইনবাবগঞ্জ থেকে র্যাব-৫ এর একটি দল ওই তিনজনকে আটক করে।
এরা হলেন- রংপুর মহানগর যুবদলের দুই সদস্য রাজিব হাসান সুমন ওরফে মেরিল সুমন (২৮) ও নওশাদ হোসেদ রুবেল ওরফে ব্ল্যাক রুবেল (২৬) এবং রংপুর মহানগর যুবলীগের সদস্য কাজল চন্দ্র বর্মন ওরফে ভরসা কাজল। তাদের কাছ থেকে পিস্তল, রিভলবার, গুলি ও চাপাতি উদ্ধার করা হয়েছে।
“প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে এই তিনজন কুনিও হোশি হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতার কথা স্বীকার করেছেন।”- বলেন রাজশাহী র্যাব-৫ এর অধিনায়ক লেফটেনেন্ট কর্নেল মাহাবুব আলম।
তিনি বলেন, “জাপানি নাগরিক কুনিও হোশি হত্যাকাণ্ডের পর থেকে এরা পলাতক ছিলেন এবং বিভিন্ন সময় জায়গা পরিবর্তন করে থাকছিলেন। বৃহস্পতিবার গভীর রাতে সন্দেহজনকভাবে সুমনকে আটক করে একটি পিস্তুল, ম্যাগাজিন ও দুটি গুলি পাওয়া যায়। পরে তার দেওয়ার তথ্যের ভিত্তিতে একটি রিভলবার ও একটি চাপাতিসহ নওশাদ ও কাজলকে আটক করা হয়”।
তিনি জানান, রংপুরে রাজিবের বিরুদ্ধে হত্যাসহ আটটি মামলা, রুবেলের বিরুদ্ধে দুটি হত্যা মামলা এবং কাজলের বিরুদ্ধে পাঁচটি মামলা রয়েছে।
শুক্রবার তাদের চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর থানায় হস্তান্তর করে অস্ত্র আইনে মামলা করা হয়েছে বলে জানান মাহাবুব।
আগেই আটক: অভিযোগ পরিবারের
র্যাব এই তিনজনকে বৃহস্পতিবার রাতে আটকের কথা বললেও তাদের পরিবারের অভিযোগ গতমাসেই তাদেরকে ‘সাদা পোশাকধারীরা’ তুলে নিয়ে গিয়েছিল।
গত ৭ অক্টোবর যুবদল নেতা সুমনের স্ত্রী সামিয়া আক্তার রংপুর প্রেসক্লাবে সংবাদ সম্মেলন করে দাবি করেন, আগের দিন (৬ অক্টোবর) বেলা ১টার দিকে র্যাব পরিচয়ে কয়েকজন শহরের হাজীর হাট বাসস্ট্যান্ড থেকে তাকে নিয়ে যায়। একই দিন সুমনের সন্ধান চেয়ে প্রেসক্লাবের সামনে মানববন্ধনও করে দলটির কর্মীরা।
আর গত ১০ অক্টোবর রাতে রুবেলকে রাজশাহী শহরের এক আত্মীয় বাড়ি থেকেও র্যাব পরিচয়ে তুলে নিয়ে যাওয়া হয় বলে অভিযোগ করেন তার বাবা আব্দুল লতিফ।
এর দুইদিন আগে গত ৮ অক্টোবর রাতে ‘সাদা পোশাকের লোকজন’ আইনপ্রয়োগকারী সংস্থার সদস্য পরিচয় যুবলীগের সদস্য কাজলকে বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে যায় বলে জানিয়েছেন তার বাবা বাবলু চন্দ্র বর্মণ।
তবে তাদেরকে আগে আটক করার কথা অস্বীকার করেছেন কাউনিয়ার ওসি জাহিদুল ইসলাম। র্যাবের পক্ষ থেকেও এ অভিযোগ অস্বীকার করা হয়েছে।
ইতালির নাগরিক হত্যা: বিএনপি নেতার ভাই রিমান্ডে
পুলিশের আবেদনের প্রেক্ষিতে ঢাকায় ইতালির নাগরিক চেসারে তাভেলা হত্যায় জড়িত সন্দেহে গ্রেপ্তার বিএনপি নেতা এম এ কাইয়ুমের ছোট ভাই এম এ মতিনকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আবারও পাঁচদিনের রিমান্ডে পেয়েছে গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশ। এর আগে মতিনকে আটদিনের রিমান্ডে নেওয়া হয়।
পুলিশ জানিয়েছে, গত ৪ নভেম্বর রাত সাড়ে ১০টার দিকে ভারতে পালিয়ে যাওয়ার সময় বেনাপোলের বড় আঁচড়া সীমান্ত থেকে এম এ মতিনকে গ্রেপ্তার করা হয়। এ নিয়ে এ ঘটনায় জড়িত সন্দেহে পাঁচজনকে গ্রেপ্তার করা হয়।
বিএনপির সাবেক ওয়ার্ড কমিশনার কাইয়ুমকে তাভেলা হত্যার সন্দেহভাজন পরিকল্পনাকারী হিসেবে সন্দেহ করা হচ্ছে। গত ২৮ অক্টোবর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল এ কথা জানান। এ হত্যাকাণ্ডের প্রায় এক মাস পর গত ২৬ অক্টোবর এ ঘটনায় জড়িত সন্দেহে চারজনকে গ্রেপ্তারের কথা জানান পুলিশের ডিবি শাখার সদস্যরা।
এদের তিনজনই ইতিমধ্যে হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকার কথা স্বীকার করে আদালতে জবানবন্দি দিয়েছেন বলে জানিয়েছে পুলিশ।
গত ২৮ সেপ্টেম্বর রাজধানীর কূটনৈতিক পাড়া গুলশানে সন্ত্রাসীদের গুলিতে নিহত হন ইতালির নাগরিক চেসারে তাভেলা। এর পাঁচ দিনের মাথায় রংপুরে কাউনিয়া উপজেলার আলুটারি গ্রামে জাপানি নাগরিক কুনিও হোশিকে গুলি করে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা।
আইএস এই হত্যার দায় স্বীকার করেছে বলে জঙ্গি হুমকি পর্যবেক্ষণকারী ওয়েবসাইট ‘সাইট ইন্টিলিজেন্স গ্রুপ’ জানালেও এর কোনো ‘ভিত্তি’ পাওয়া যায়নি বলে সরকার দাবি করেছে। কুনিও হত্যায়ও এর আগে একাধিক ব্যক্তি গ্রেপ্তার আছেন, যাদের কয়েরজনকে রিমান্ডেও নেওয়া হয়।
বিএনপি জামায়াতকে দুষলেন প্রধানমন্ত্রী
এদিকে বিদেশি হত্যার জন্য বিএনপি-জামায়াতকে দায়ী করেছেন প্রধানমন্ত্রী। ঢাকায় এক অনুষ্ঠানে তিনি বলেছেন, “রাজনৈতিক আন্দোলনের নামে বিএনপি-জামায়াত ২০১৩ সাল থেকে হত্যা, জ্বালাও-পোড়াও এবং ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়ে যাচ্ছে। তারা গুপ্তহত্যার সূচনা করেছে। দেশের মানুষ হত্যা করে সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করতে ব্যর্থ হয়ে এখন বিদেশি মানুষকে হত্যা করছে।”
‘প্রকৃত অপরাধী আটক না হলে অনাস্থা তৈরি হবে’
একের পর এক হত্যাকারী সন্দেহে বিভিন্ন মানুষকে আটক করছে পুলিশ। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পুলিশ যদি সঠিক তথ্যের ভিত্তিতে আটক না করে থাকে, তাহলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর প্রতি আস্থা হারাবে সাধারণ মানুষ। তাই পুলিশকে লক্ষ্য রাখতে হবে যাতে কোন নিরপরাধ মানুষ তাদের সন্দেহে’র শিকার না হয়।
এ বিষয়ে অপরাধ বিষয়ক সাংবাদিক ওমর ফারুক বেনারকে বলেন, “পুলিশ সন্দেহের বশে অনেককেই আটক করে থাকেন। তাতে সবার বিরুদ্ধে যে অপরাধ প্রমাণ হয় তা নয়। যাদের বিরুদ্ধে অপরাধ প্রমাণ হয় না তারা আদালত থেকে বেরিয়ে যান। কিন্তু বের হওয়ার আগ পর্যন্ত নানা ধরনের নিপীড়ণ, যন্ত্রণা তাদেরকে সহ্য করতে হয়। ওই সন্দেভাজনসহ এবং তার পরিবারকে সামাজিকভাবেও গঞ্জনা সইতে হয়”।
তাঁর মতে, তাই পুলিশের উচিত আরো সঠিক তথ্যের ভিত্তিতে ‘আসামি’ আটক করা। না হলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর প্রতি সমাজের অনাস্থা তৈরি হবে। আর বিদেশি হত্যার ঘটনা বিশ্বজুড়ে আলোচিত। তাই প্রকৃত অপরাধীদের খুঁজে বের করতে না পারলে বিশ্বের কাছেও সমালোচিত হবে বাংলাদেশ।