উন্নয়নের ছোঁয়ায় বদলে যাচ্ছে বিলুপ্ত ছিটের মানুষদের ভাগ্য
2015.10.16

আনুষ্ঠানিকভাবে ছিটমহল বিনিময়ের পর গত আড়াই মাসে বাংলাদেশ ভূখন্ডে একীভূত অংশে ব্যাপক উন্নয়নকান্ড এগিয়ে চলে। হয়তো প্রধানমন্ত্রীর সফরের আগে দ্রুত বেশ কিছু কাজ এগিয়ে নেয়া হয়। এতে বিলুপ্ত ছিটমহলের হাজার হাজার অধিবাসীর মধ্যে আস্থার ভাব সৃষ্টি করেছে নিঃসন্দেহে।
কুড়িগ্রাম, লালমনির হাট, পঞ্চগ্রাম ও নীলফামারী মিলিয়ে ১১১টি ছিটে অবস্থিত প্রায় ২,৫০০ বাড়িতে বিনা মূল্যে বিদ্যুৎ সংযোগ দেয়া হয়েছে। শুরু হয়েছে স্কুল ও ক্লিনিক নির্মাণের কাজ। অস্থায়ীভাবে কয়েক হাজার মানুষকে স্বাস্থ্যসেবা দেয়া হয়েছে। রাস্তা-ঘাট ও পুল নির্মাণও এগিয়ে যাচ্ছে। বিলি করা হয়েছে সৌর বিদ্যুৎ প্যানেল। অতি-দরিদ্রদের দেয়া হয়েছে চাল ও শুকনো খাবার। এগিয়ে নেয়া হচ্ছে আইডি কার্ড ও ভোটার তালিকাভূক্তির ব্যবস্থা। স্থাপন করা হয়েছে পুলিশ ফাঁড়ি।
বিভিন্ন মন্ত্রনালয়ের গৃহীত বিবিধ কর্মসূচিতে উন্নয়েনের এই কর্মকান্ড শিঘ্রই আরো বহুদূর গড়াবে। সফরকালে প্রধানমন্ত্রীর প্রতিশ্রুতিই তার প্রমাণ।
আপনজন বলে ওদের বুকে টেনে নিলেন প্রধানমন্ত্রী
গত বৃহস্পতিবার কুড়িগ্রাম জেলার ফুলবাড়ী উপজেলার সাবেক ছিটমহল দাসিয়ারছড়ায় সুধী সমাবেশে বক্তৃতা করেন প্রধানমন্ত্রী। গত জুলাইয়ে ছিটমহল বিনিময়ের পর এই প্রথম প্রধানমন্ত্রী সেখানে গেলেন। তাঁর আসার আগেই সেখানে শুরু হয়েছে ব্যাপক উন্নয়ন কর্মকাণ্ড। ওই ইউনিয়নের নতুন নাম হয়েছে ‘মুজিব-ইন্দিরা দাসিয়ারছড়া ইউনিয়ন পরিষদ’।
“আপনারা আমাদের আপনজন। আপনাদের আর কখনো ছিটমহলবাসী বলা হবে না। আপনারা এ দেশের নাগরিক। আপনাদের আর বঞ্চিত হতে হবে না,”—প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কুড়িগ্রাম জেলার ফুলবাড়ী উপজেলার সাবেক ছিটমহল দাসিয়ারছড়ায় গিয়ে এই বক্তব্য দেওয়ার পর ছিটমহলবাসী আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন।
দীর্ঘ ৬৮ বছর মুক্তির প্রতীক্ষায় থাকায় মানুষগুলোর চোখেমুখে ছিল মুক্তির আনন্দ। মানবেতর ও অবমাননাকর জীবন কাটিয়ে আসা ওই নাগরিকদের প্রধানমন্ত্রী সম্বোধন করেন ‘নতুন প্রস্ফুটিত একগুচ্ছ ফুল’ বলে।
“জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বেঁচে থাকলে অনেক আগেই আপনারা নাগরিক সুবিধা পেতেন। দীর্ঘ ৬৮ বছর আপনাদের মানবেতর জীবন যাপন করতে হতো না,” জানান প্রধানমন্ত্রী।
তিনি বলেন, “১৯৭৪ সালে বঙ্গবন্ধু শুধু ভারতের সঙ্গে স্থলসীমান্ত চুক্তিই করেননি, আইনও পাস করেছিলেন। তবে ভারত এই আইন পাস করতে পারেনি। বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার পর যারা ক্ষমতায় এসেছিল—জিয়া, এরশাদ, খালেদা—কোনো সরকারই স্থল চুক্তি বাস্তবায়ন নিয়ে কোনো উদ্যোগ নেয়নি।”
ভারতীয় সংসদে স্থলসীমান্ত চুক্তি বিলটি পাস হলে চলতি বছরের ৩১ জুলাই মধ্য রাতে ভারত-বাংলাদেশের ভেতরে অবস্থিত ১৬২ ছিটমহল বিনিময় হয়। বিগত ৬৮ বছর ধরে নাগরিকত্বহীন অবস্থায় থাকা এখানকার বাসিন্দাদের অনেকেই ওই দিন রাতে ৬৮টি মোমবাতি জ্বালিয়ে এত দিনের অভিশাপ থেকে মুক্তি পাওয়ার আনন্দে মেতে ওঠেন।
’৭৪-এর স্থল সীমান্ত চুক্তি বাস্তবায়নের অংশ হিসেবে বাংলাদেশের ভূ-খণ্ডে থাকা ভারতের ১১১টি ছিটমহল বাংলাদেশের ভূ-খণ্ড এবং ভারতে থাকা বাংলাদেশের ৫১ টি ছিটমহল ভারতের ভূ-খণ্ড হয়েছে বলে বিবেচিত হয় ।
বাংলাদেশে অন্তর্ভুক্ত হওয়ার পর ১১১টি ছিটমহলের মধ্যে যারা ভারতে ফিরে যেতে চান তারা ছাড়া সবাইকে বাংলাদেশের নাগরিকত্ব দেওয়া হয়েছে। অন্যদিকে ভারতে অন্তর্ভুক্ত হওয়ার পর ৫১ টি ছিটমহলের মানুষ পান ভারতীয় নাগরিকত্ব।
বাংলাদেশে ভারতের ১ লাখ ৭ হাজার ১৬০ একর আয়তনের ১১১টি ছিটমহল এবং ভারতে বাংলাদেশের ৭ হাজার ১১০ একর আয়তনের ৫১টি ছিটমহল রয়েছে।
ভারতে সবগুলি ছিটমহল পশ্চিমবঙ্গের কোচবিহার জেলায় অবস্থিত। বাংলাদেশে ছিটমহলগুলো পঞ্চগড়, লালমনিরহাট, কুড়িগ্রাম ও নীলফামারী জেলায় অবস্থিত।
এখন মন বদলাচ্ছে অনেকের
ছিটমহলের জনগণের জন্য বাংলাদেশ সরকারের নেওয়া বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পের ছোঁয়ায় চেহারা পাল্টে যেতে শুরু করেছে অধুনা বিলুপ্ত কুড়িগ্রামের দাসিয়ারছড়া ছিটমহলের। এই পরিস্থিতিতে মন এবং মত পাল্টে গেছে ভারতে যেতে ইচ্ছুক ট্রাভেল পাস পাওয়া কুড়িগ্রামের কয়েকটি হিন্দু পরিবারের সদস্যদের।
ট্রাভেল পাস পেলেও এখন তারা আর ভারত যেতে চান না। থেকে যেতে চান নিজেদের পূর্বপুরুষের ভিটেতে--যেটি আগে ছিল ভারতের ছিটমহল, এখন রূপান্তরিত বাংলাদেশি ভূখণ্ডে।
দাশিয়ার ছড়ার কালির হাট এলাকায় শ্রী বাবলু চন্দ্র বর্মন (৩৩) জানান, ট্রাভেল পাস পেলেও ভারত যেতে চান না। স্ত্রী ও দুই সন্তানসহ তিনি বাংলাদেশে থেকে যেতে চান।
“ছিটবাসীদের জন্য বাংলাদেশ সরকারের বিভিন্ন উদ্যোগ দেখে বুঝতে পারছি বাংলাদেশই আমাদের জন্য উপযুক্ত স্থান। আত্মীয়-স্বজনদের ছেড়ে ভারতে গেলে ভালো থাকতে পারব না,” টেলিফোনে বেনারকে জানান বাবুল চন্দ্র।
অবশ্য বাংলাদেশে থাকতে পারবেন কি না সে বিষয়েও তার মধ্যে শঙ্কা কাজ করছে। কারণ তাদের আগামী ৩০ নভেম্বরের মধ্যে চলে যেতে বলা হয়েছে।
“বাবা হামরা কিছু বুঝবার না পায়া ভারত যাওয়ার আবেদন করছিলাম। হামরা ছিটত থাকিয়া আগততো বুঝি নাই বাংলাদেশ ভারত কী! কিন্তু ছিটের জন্যে বাংলাদেশ সরকারের দরদ দেখিয়া বুঝছি হামার এটেই ভালো হইবে,” বেনারকে জানান ষাটোর্ধ্ব কৃষ্ণ কান্ত বর্মন।
কৃষ্ণ কান্তের পরিবারের দশ জন সদস্য ভারতে যাওয়ার ট্রাভেল পাস পেয়েছেন কিন্তু এখন কেউ ভারতে যেতে চান না। সেখানে উপস্থিত কামালপুরের নারায়ণ চন্দ্র, শ্রীমতি দেবরাণী, কান্ত বর্মনসহ উপস্থিত অনেকেই ভারতে যাওযার ট্রাভেল পাস পেলেও এখন ভারত যেতে চাচ্ছেন না।
তাদের কেউ কেউ জানান, এতো অল্প সময়ে তাদের পক্ষে স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ বিক্রি করা সম্ভব হচ্ছে না। কেউ তাদের জমি কিনতেও চাচ্ছে না। ফলে পূর্ব পুরুষের ভিটেমাটি এভাবে ফেলে রেখে তারা যেতে পারবেন না।
“৩০ নভেম্বরের মধ্যে ট্রাভেল পাসধারীরা দেশ ত্যাগ না করলে তাদের ব্যাপারে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে কী সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে তা উভয় রাষ্ট্র যৌথ বৈঠকের মাধ্যমে ঠিক করবে। এখনই এ বিষয়ে কিছু বলা যাচ্ছে না,” বেনারকে জানান ফুলবাড়ি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা নাসির উদ্দিন মাহমুদ।
গত ৭ ও ৮ সেপ্টেম্বর কুড়িগ্রামের ফুলবাড়ীর দাসিয়ারছড়ায় এবং ভূরুঙ্গামারীতে ভারতীয় হাইকমিশনের পক্ষ থেকে কুড়িগ্রাম জেলার বিলুপ্ত বিভিন্ন ছিটমহল থেকে ভারতে গমনে ইচ্ছুক অবশিষ্ট ৩০১ জনের মধ্যে ২৬৪ জনকে ট্রাভেল পাস বিতরণ করা হয়। চলতি বছরের ৩০ নভেম্বরের মধ্যে তাদের ভারতে চলে যেতে হবে বলে ট্রাভেল পাসে উল্লেখ করা হয়।
চলছে উন্নয়ন কর্মকাণ্ড
ঢাকা থেকে ছিটমহল এলাকায় যাওয়া সাংবাদিকদের সঙ্গে যোগাযোগ করে জানা যায়, প্রধানমন্ত্রী ঢাকা থেকে হেলিকপ্টারে ফুলবাড়ী যান। সেখান থেকে মোটর শোভাযাত্রায় ১৯ কিলোমিটার দূরে দাসিয়ারছড়ায় পৌঁছান সোয়া ১০টায়। এই সড়কটি নতুন করে মেরামত এবং সাবেক ছিটমহল দাসিয়ারছড়া পর্যন্ত দুই কিলোমিটার নতুন করে তৈরি করা হয়েছে।
সেখানে কালীরহাট বাজারের পাশের নতুন প্রতিষ্ঠিত শেখ হাসিনা বহুমুখী বালিকা উচ্চবিদ্যালয় মাঠের পাশে মঞ্চে তিনি সুধী সমাবেশে বক্তব্য দেন। এ সময় অনেকে স্লোগান দেন, ‘নিজ দেশে পরবাসী ছিলাম এত দিন/ শেষ হবে না, শেষ হবে না শেখ হাসিনার ঋণ’।
এর আগে প্রধানমন্ত্রী দাসিয়ারছড়াসহ পঞ্চগড়ের সাবেক ছিট দহলা খাগড়াবাড়ী, কোটভাজনী, কাজলদীঘি, শালবাড়ী ও পুটিমারী এবং লালমনিরহাট জেলার সাবেক ছিট খারিজা শিয়ালদহ ১ ও ২ এবং নগরজিগাবাড়ীতে বিদ্যুৎ-সংযোগ কার্যক্রমের উদ্বোধন করেন। এসব এলাকার ২ হাজার ৫৬১টি পরিবারে বিদ্যুৎ-সংযোগ দেওয়া হয়েছে।
প্রধানমন্ত্রীর উপস্থিতিতে সেখানে উৎসবমুখর পরিবেশ সৃষ্টি হয়। তাঁকে গান গেয়ে শোনান কেউ কেউ। প্রধানমন্ত্রী বুকে জড়িয়ে ধরেন কয়েকজনকে।
বিদ্যুতের লাইন নিতে গ্রাহককে একটি নির্দিষ্ট অঙ্কের অর্থ জমা দিতে হয়, কিনতে হয় মিটার। কিন্তু এসব এলাকায় গ্রাহকদের কিছুই প্রয়োজন হয়নি। যারা আবেদন করেছেন, সরকারের সিদ্ধান্ত মোতাবেক তাদের বাড়িতে বিনা মূল্যে বিদ্যুৎ সংযোগ দেয়া হয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী কুড়িগ্রাম জেলায় একটি শিশুপার্ক, সরকারি বা বেসরকারি উদ্যোগে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা, দুধকুমার নদে সোনাহাট সেতু নির্মাণ এবং একটি বিশেষ শিল্পাঞ্চল গড়ে তোলার পরিকল্পনার কথা বলেন। কুড়িগ্রাম জেলায় ২০টি নতুন প্রকল্পের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন এবং ২০টি প্রকল্পের কাজের উদ্বোধন ঘোষণা করেন তিনি। প্রধানমন্ত্রী দাসিয়ারছড়ায় সোলার প্যানেল বিতরণকাজেরও উদ্বোধন করেন।
শেখ হাসিনা কুড়িগ্রাম জেলায় তাঁর সরকার গৃহীত বিভিন্ন উন্নয়ন কর্মসূচির বর্ণনা দিয়ে বলেন, কুড়িগ্রামে এখন মঙ্গা শব্দ বলে কিছু নেই। জেলায় এখন চাহিদার চেয়ে ১৫ শতাংশ বেশি খাদ্যশস্য উৎপাদিত হয়েছে।
প্রসঙ্গত, দুই দেশের স্থল সীমান্ত সুরাহার জন্য ১৯৭৪ সালের ১৬ মে বাংলাদেশের তখনকার প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবর রহমান ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী স্থল সীমান্ত চুক্তিতে সই করেন। বাংলাদেশ ওই বছরই চুক্তিটি সংসদে অনুসমর্থন করলেও ভারত সেটি করেনি।
এবার নরেন্দ্র মোদির বিজেপি সরকার ক্ষমতায় আসার পর গত মে মাসে সর্বসম্মতভাবে ভারতের লোকসভা ও রাজ্যসভায় ভারতের সংবিধান সংশোধনী বিল পাস হয়। অবসান ঘটে দীর্ঘ ৪১ বছরের অপেক্ষার।