বাংলাদেশি শ্রমিক প্রবেশে লিবিয়ার নিষেধাজ্ঞা
2015.05.19

সাগর পথে অবৈধভাবে রোহিঙ্গাদের সঙ্গে মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ডে বাংলাদেশি শ্রমিক পাচারের ঘটনায় বিশ্ব যখন তোলপাড়, ঠিক তখনই একই অভিযোগ এনে যখন বাংলাদেশ থেকে আবারও শ্রমিক নেওয়া বন্ধ করার ঘোষণা করল উত্তর আফ্রিকার দেশ লিবিয়া। ২০১০ সালেও একবার বাংলাদেশ থেকে শ্রমিক নেওয়া বন্ধ করে দেশটি।
বাংলাদেশ থেকে কাজের জন্য লিবিয়া গিয়ে, সেখান থেকে অবৈধভাবে নৌপথে ভূমধ্যসাগার পাড়ি দিয়ে ইউরোপে যাওয়ার চেষ্টার অভিযোগে দেশটি এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে বলে জানিয়েছে লিবিয়া সরকারের মুখপাত্র হাতেম উরাইবি।
লিবিয়ার বাংলাদেশ দূতাবাসও বিষয়টি নিশ্চিত করেছে। তবে সরকার দাবি করছে, বৈধ শ্রমিকদের জন্য বন্ধ হয়নি বাজারটি। শুধু মাত্র অবৈধভাবে যাওয়া শ্রমিকদের প্রবেশ নিষিদ্ধ করেছে লিবিয়া সরকার।
আর জনশক্তি রপ্তানিকারকরা বলছেন, প্রায় একবছর ধরে নাম-কা-ওয়াস্তে শ্রমিক যাওয়া দেশটির এমন সিদ্ধান্ত বাংলাদেশের জনশক্তি রপ্তানি খাতে খুব বেশি প্রভাব ফেলবে না। তবে আন্তর্জাতিকভাবে বাংলাদেশের ভাবমূর্তিকে ক্ষুন্ন করবে। কারণ, সম্প্রতি থাইল্যান্ড ও মালয়েশিয়া উপকূলে বহু বাংলাদেশি অভিবাসী আটক হয়েছে। সাগরে ভাসমানদের মধ্যেও আছে বাংলাদেশিরা।
লিবিয়ার পূর্বাঞ্চলভিত্তিক সরকারের মুখপাত্র হাতেম উরাইবিকে উদ্ধৃত করে গত শনিবার আন্তর্জাতিক বিভিন্ন বার্তা সংস্থা বাংলাদেশি শ্রমিকদের লিবিয়া প্রবেশে এই নিষেধাজ্ঞার কথা জানায়।
হাতেম উরাইবিক বলেন, ‘বাংলাদেশি শ্রমিকেরা লিবিয়ায় কাজ করতে আসেন। কিন্তু এরপর তারা অবৈধভাবে নৌপথে চড়ে ইউরোপে পাড়ি জমান। অবৈধ অভিবাসনের বিরুদ্ধে লিবিয়া সরকার তৎপর। তারই অংশ হিসেবেই এই নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছে।’
লিবিয়া সরকারের এ নিষেধাজ্ঞা কেবল দেশটির পূর্বাঞ্চলের স্থলসীমান্ত, নদী ও সমুদ্রবন্দর এবং বিমানবন্দরে কার্যকর হবে। কারণ, লিবিয়ার কেবল ওই অংশটিই আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত লিবীয় সরকারের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে।
এই নিষেধাজ্ঞার বিষয়ে বাংলাদেশকে এখনও আনুষ্ঠানিকভাবে কিছু জানানো হয়নি বলে লিবিয়া থেকে জানিয়েছেন বাংলাদেশ দূতাবাসের কাউন্সেলর (শ্রম) আ স ম আশরাফুল ইসলাম। তিনি বলেন, ‘অনেক বাংলাদেশি লিবিয়ায় কাজ করতে এসে নৌপথে ইউরোপে যাওয়ার চেষ্টার করে থাকেন- এমন অভিযোগে দেশটি এ সিদ্ধান্ত নিয়েছে বলে আমরা শুনেছি। তবে এখনো আমরা আনুষ্ঠানিক কোনো চিঠি পাইনি।’
ত্রিপোলিসহ লিবিয়ার পশ্চিমাঞ্চল নিয়ন্ত্রণ করছে বিদ্রোহীদের একটি পক্ষ, যারা নিজেরাই সেখানে সরকার চালাচ্ছে। নৌকায় করে অবৈধ অভিবাসীদের ইতালিতে পাঠাতে ভূমধ্যসাগরের তীরবর্তী লিবিয়ার ওই অঞ্চলটিই ব্যবহার করে আসছে মানবপাচারকারীরা। গত মাসে ভূমধ্যসাগর দিয়ে অবৈধভাবে ইতালি যাওয়ার পথে নৌযান ডুবে প্রায় ৯০০ অভিবাসী প্রাণ হারান।
জাতিসংঘের হিসাবে, চলতি বছর সাড়ে পাঁচ মাসেই ৬০ হাজারের বেশি লোক ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইউরোপে পৌঁছানোর চেষ্টা করেছে। এমনভাবে সাগর পাড়ি দেওয়ার ঘটনায় এ বছর অন্তত ১ হাজার ৮০০ লোকের মৃত্যু হয়েছে বলে ধারণা করা হয়, যা গতবছরের একই সময়ের তুলনায় ২০ গুণ বেশি।
লিবিয়া থেকে ইউরোপ যাওয়ার চেষ্টা করেছেন এমন বাংলাদেশিদের কোন তালিকা বা ঠিকানা জানা নেই উল্লেখ করে আশরাফুল ইসলাম সম্প্রতি ভূমধ্যসাগরে একটি জাহাজ ডুবে কয়েক শ মানুষ মারা যাওয়ার ঘটনার কথা স্মরণ করিয়ে দেন। যে জাহাজ থেকে এক বাংলাদেশিকে জীবিত উদ্ধার করা হয়। যিনি ওই জাহাজটিতে আরও অন্তত ২৫ জন বাংলাদেশি ছিলেন বলে তথ্য দিয়েছিলেন।
ওই ঘটনার পর থেকে বাংলাদেশ দূতাবাস অবৈধভাবে শ্রমিক পাঠানো বন্ধে ব্যবস্থার নেওয়ার জন্য সরকারের প্রতি আহবান জানায়। এর কিছুদিনের মধ্যে লিবিয়া যাওয়ার পধে চট্টগ্রাম বিমানবন্দরে ১১ জন ধরা পড়েন।
লিবিয়ার এমন ঘোষণায় বাংলাদেশের শ্রমবাজার বন্ধ হয়েছে- সেকথা মানতে নারাজ প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার খন্দকার মোশাররফ হোসেন। তার দাবি অবৈধভাবে শ্রমিক যাওয়া বন্ধ হলেও বাংলাদেশের আমাদের বৈধ বাজার সেভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে না।
এ প্রসঙ্গে তিনি বেনারকে বলেন, ‘যারা বৈধপথে লিবিয়ায় যাচ্ছে তাদের যাওয়া বন্ধ হয়নি। বরং যারা অবৈধপথে বিএমইটির (জনশক্তি রফতানি ও প্রশিক্ষণ ব্যুরো) ছাড়পত্র ছাড়া যাচ্ছে, তাদেরকে লিবিয়া সরকার ঢুকতে দেবে না। সুতরাং লিবিয়ার শ্রমবাজার বন্ধ হয়নি। দুই সরকারের (বাংলাদেশ-লিবিয়া) মধ্যে জনশক্তি রফতানি ও আমদানি চালু আছে।’
কয়েক বছর আগেও সৌদি আরব ও মালয়েশিয়ার বাজার বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর বাংলাদেশের অন্যতম শ্রমবাজার হয়ে ওঠেছিল লিবিয়া। ২০০৯ ও ২০১০ সালে ৩৫ হাজার বাংলাদেশি শ্রমিক দেশটিতে প্রবেশ করে।
কিন্তু দেশটির শ্রম বাজারে বাংলাদেশি শ্রমিকদের সুদিন আসতে না আসতেই দালাল চক্র জাল ভিসায় লোক পাঠানো শুরু করে। কিছু দালাল আটকও হয় পুলিশের কাছে। এসব কারণেই ২০১০ সালে বাংলাদেশ থেকে লোক নেওয়া বন্ধ করে দেয় আফ্রিকার দেশে লিবিয়া।
তবে ২০১১ সালে দেশটিতে যুদ্ধাবস্থা শুরুর পর ৩৬ হাজার বাংলাদেশি দেশে ফিরে আসেন।
তবে গাদ্দাফি সরকারের পতনের পর দেশটির পুনর্গঠনের কাজ শুরু বাংলাদেশিদের জন্য আবারও উন্মুক্ত হয় লিবিয়ার শ্রম বাজার।
জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) তথ্য অনুযায়ী, ২০১২ সালে ১৪ হাজার ৯৭৫ জন, ২০১৩ সালে ৭ হাজার ১৭৫ জন এবং ২০১৪ সালে লিবিয়াতে যান ৪ হাজার ৪৬১ জন কর্মী। আর এ বছর এখন পর্যন্ত গেছেন ৯৩ জন। বর্তমানে ৫০ হাজারেরও বেশি বাংলাদেশি লিবিয়াতে কর্মরত আছেন।
জনশক্তি রপ্তানিকারকদের সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ইন্টারন্যাশনাল রিক্রুটিং এজেন্সিজের (বায়রা) সহ-সভাপতি গোলাম কবির বেনারকে বলেন, ‘দীর্ঘদিন ধরেই লিবিয়ায় যুদ্ধাবস্থাসহ নানা সংকটের কারণে বৈধভাবে শ্রমিক যাওয়া বন্ধ ছিল। লিবিয়া থেকে ইউরোপে পাঠানোর প্রলোভন দেখিয়ে অবৈধভাবে শ্রমিক পাঠায় একটি চক্র। লিবিয়ার সঠিক পরিস্থিতি না জানিয়ে উল্টো সেখানে নিরাপদ পরিবেশ, ভালো বেতন এবং সেখান থেকে সাগর পেরোলেই ইউরোপে যাওয়ার নিশ্চয়তা দেয় দালালরা। এসব কারণে বৈধভাবে রপ্তানিকারকরা ক্ষতিগ্রস্ত হন। যে দেশেই হোক অবৈধভাবে শ্রমিক পাঠানো বন্ধ করা প্রয়োজন।’