শিশুকে গুলিঃ আইনি লড়াই-এ রক্ষা হলো না, কারাগারে এমপি লিটন
2015.10.15

একটি শিশুকে অকারণে গুলি করার পর আইনপ্রণেতা মঞ্জুরুল ইসলাম লিটন নিম্ন আদালত থেকে উচ্চ আদালতে ছোটাছুটি করেও গ্রেপ্তার এড়াতে পারলেন না, যা সাম্প্রতিক সময়ে প্রশ্নবিদ্ধ আইনের শাসনকে কিছুটা হলেও সমুন্নত করেছে।
গত বুধবার রাতে রাজধানীর উত্তরা এলাকার একটি বাসা থেকে গ্রেপ্তার হন সাংসদ মনজুরুল ইসলাম, যাঁকে ওই রাতেই ঢাকা থেকে গাইবান্ধায় নেওয়া হয়। সেখানে নিম্ন আদালতে জামিনের আবেদন নাকচ হলে বৃহস্পতিবার তাঁকে কারাগারে পাঠানো হয়।
“আমরা এই আদেশের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে যাব,” বেনারকে জানান মনজুরুলের অন্যতম আইনজীবী সিরাজুল ইসলাম।
ঘটনার পর ব্যাপক আলোচনা সৃষ্টি হলে আত্মগোপন করেন আওয়ামী লীগ নেতা ও সাংসদ লিটন। তিনি আগাম জামিনের সবরকম চেষ্টা করেছিলেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান সাংবাদিকদের জানিয়েছিলেন, সাংসদ বা সরকারি দলের নেতা হলেও আইন তার নিজস্ব গতিতে চলবে।
“ওই সাংসদের কর্মকাণ্ডে সরকার ও দলের ভাবমূর্তি নষ্ট হচ্ছিল। তা ছাড়া তিনি পার পেয়ে যাবেন, এমন ধারণাও ছিল অনেকের মধ্যে। তিনি গ্রেপ্তার হওয়ায় সরকারের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হয়েছে,” বেনারকে জানান সাবেক ছাত্রলীগ নেতা ও গাইবান্ধার বর্তমান পৌর মেয়র আবদুল্লাহ আল মামুন।
বিক্ষোভ, পুলিশের লাঠিপেটা
শিশু শাহাদাতকে গুলি করার ১৩ দিনের মাথায় গ্রেপ্তার হন মনজুরুল। এতে সাধারণ মানুষ খুশি হলেও সাংসদ মনজুরুলের কয়েকশ সমর্থক গতকাল জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের সামনে গাইবান্ধা-পলাশবাড়ী সড়কে বিক্ষোভ মিছিল বের করেন।
সাংসদের বিরুদ্ধে করা মামলাকে ‘মিথ্যা’ অভিহিত করে তাঁরা তা প্রত্যাহারের দাবিতে বিভিন্ন স্লোগান দেন। একপর্যায়ে পুলিশ ফাঁকা গুলি ও কাঁদানে গ্যাসের শেল ছোড়ে এবং লাঠিপেটা করে বিক্ষোভকারীদের ছত্রভঙ্গ করে দেয়।
সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মেহেদি হাসান বলেন, ‘পরিস্থিতি পুরোপুরি পুলিশের নিয়ন্ত্রণে আছে।’
সাধারণ মানুষের স্বস্তি
মনজুরুল গ্রেপ্তার হওয়ায় এলাকার সাধারণ মানুষ স্বস্তি প্রকাশ করেছে। গত বুধবার রাত থেকে সুন্দরগঞ্জ উপজেলা শহর ও উপজেলার বিভিন্ন হাটবাজারে মিষ্টি বিতরণ করা হয়। হাটবাজার ও চায়ের দোকানে উপস্থিত লোকজনের মধ্যে উচ্ছ্বাস দেখা যায়। তারা সাংসদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করে। এর আগে কয়েক দফা মানববন্ধন হয় তাঁকে গ্রেপ্তারের দাবিতে।
গত ২ অক্টোবর গাইবান্ধা-১ আসনের সরকারদলীয় সংসদ সদস্য লিটনের ছোড়া গুলিতে শাহাদাত হোসেন সৌরভ নামে নয় বছর বয়সী এক শিশু আহত হয় বলে পরিবারের অভিযোগের ভিত্তিতে গণমাধ্যম খবর প্রকাশ করে। দুই পায়ে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় সে এখন রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন।
ওই সাংসদ এ সময় মদ্যপ অবস্থায় ছিলেন বলে গণমাধ্যম খবর প্রকাশ করে। শিশুকে গুলি করার পর তাঁর বিরুদ্ধে বিভিন্ন অভিযোগ প্রকাশ হতে থাকে।
আহত সৌরভের বাবা সাজু মিয়া ঘটনার পরদিন সাংসদ লিটনকে আসামি করে সুন্দরগঞ্জ থানায় একটি মামলা দায়ের করেন।
এ ছাড়া ভাঙচুর ও লুটপাটের অভিযোগে আরেকটি মামলা করেন হাফিজার রহমান নামে সর্বানন্দ ইউনিয়নের উত্তর শাহাবাজ গ্রামের এক বাসিন্দা।
লিটনকে গ্রেপ্তারের প্রতিক্রিয়ায় সাজু মিয়া স্থানীয় সাংবাদিকদের বলেন, “ভীষণ খুশি হছি। হামার এলাকার মানুষ খুশি হইছে।”
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে ধন্যবাদ জানিয়ে তিনি বলেন, “আমি এমপি লিটনের উপযুক্ত শাস্তি চাই।”
হাইকোর্ট, সুপ্রিম কোট ঘুরেও লাভ হয়নি
আগাম জামিন চেয়ে লিটন হাই কোর্টে আবেদন করলে বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম ও বিচারপতি ভীষ্মদেব চক্রবর্তীর অবকাশকালীন বেঞ্চ গত সোমবার তা খারিজ করে দেন।
সেই সঙ্গে সাংসদ লিটনকে ১৮ অক্টোবরের মধ্যে গাইবান্ধার মুখ্য বিচারিক হাকিম আদালতে আত্মসমর্পণের নির্দেশ দেওয়া হয়।
লিটনের আইনজীবী ব্যারিস্টার মোকছেদুল ইসলাম ওই আদেশের ব্যাখ্যা দিয়ে সাংবাদিকদের কাছে দাবি করেন, “আদালত যেহেতু আত্মসমর্পণের তারিখ ঠিক করে দিয়েছে, সেহেতু ১৮ অক্টোবরের আগে লিটনকে গ্রেপ্তারের সুযোগ নেই।”
লিটনকে গ্রেপ্তারের আইনি সুযোগ নিয়ে এই অস্পষ্টতা কাটাতে সুপ্রিম কোর্টের চেম্বার আদালতে বৃহস্পতিবার আবেদন করে রাষ্ট্রপক্ষ।
“তাঁকে গ্রেপ্তারে পুলিশ প্রশাসন যাতে ‘দ্বিধাগ্রস্ত না হয় সে জন্য রাষ্ট্রপক্ষ সুপ্রিম কোর্টে গিয়েছিল,” জানান অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম।
সাংসদ সমর্থকদের ‘হুমকি’
সরকারদলীয় সংসদ সদস্য মঞ্জুরুল ইসলামকে গ্রেপ্তারে এলাকার মানুষ সন্তুষ্ট হলেও তার সমর্থকদের ‘হুমকি’ এখনো পাচ্ছেন বলে অভিযোগ গুলিবিদ্ধ শাহাদত হোসেন সৌরভের পরিবারের।
“এমপির ক্যাডাররা ভয়ংকর প্রকৃতির । ঘটনার পর থাকি তারা হুমকি দিয়া আসছে। এমপির গ্রেপ্তারের প্রতিশোধ নিতে তার ক্যাডাররা আমার পরিবারের ওপর কিছু করতে পারে-সেই আতঙ্কে ভুগতিছি,” স্থানীয় সাংবাদিকদের বলেছেন সৌরভের বাবা সাজু মিয়া।
গুলিবিদ্ধ হওয়ার পর থেকে সৌরভ তার বাবা-মা ও ভাই রংপুর মেডিকেলে রয়েছেন, যেখানে সার্বক্ষণিক সাদা পোশাকের পুলিশ পাহারায় চিকিৎসা চলছে এই শিশুর।
গত ২ অক্টোবর ভোরে গোপাল চরণ এলাকার কালাইয়ের ব্রিজের কাছে পায়ে গুলি করা হয় ৯ বছরের সৌরভ। ওই এলাকা দিয়ে যাওয়ার সময় গাড়ি থামিয়ে এমপি লিটন এই শিশুটিকে গুলি করেন বলে অভিযোগ উঠেছে।
পরে আত্মসমর্পণ করতে উচ্চ আদালতের সময় পেলেও সর্বোচ্চ আদালতে তা আটকে যাওয়ার পর বুধবার রাতে ঢাকায় তাকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ।