মাহফুজ আনামের বিরুদ্ধে ৬৯টি মামলা, ক্ষতিপূরণ দাবি ৭২ হাজার কোটি
2016.02.17

টকশোতে একটি মন্তব্যের জন্য প্রধান ইংরেজি দৈনিক ডেইলি স্টার-এর সম্পাদক মাহ্ফুজ আনামের বিরুদ্ধে গতকাল বুধবার পর্যন্ত নয় দিনে মোট ৬৯ টি মামলা দায়ের হয়েছে। এর মধ্যে মানহানির ৪৪টি মামলায় ৭২ হাজার ২৮০ কোটি ৫০ লাখ টাকার মানহানি হয়েছে দাবি করা হয়।
মানহানি ও রাষ্ট্রদ্রোহসহ সব মামলাই হয়েছে হাকিম আদালতে। আর এসব মামলার বাদীদের প্রায় সবাই ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ, এর অঙ্গ-সহযোগী ও সমমনা সংগঠনের নেতা-কর্মী ও আইনজীবী।
তাঁদের দাবি হচ্ছে, বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে সামরিক গোয়েন্দা সংস্থার দেওয়া তথ্য যাচাই–বাছাই না করে ডেইলি স্টার প্রকাশ করেছিল এবং এর সম্পাদক সেই স্বীকারোক্তি দিয়েছেন ।
বেশ দেরিতে হলেও এবং বিভিন্ন মহলের সমালোচনার মুখে গতকাল বুধবার সম্পাদকদের সংগঠন বাংলাদেশ সংবাদপত্র পরিষদ (বিএসপি) উদ্বেগ প্রকাশ করে বিবৃতি দিয়ে বলেছে, এই ঘটনা দেশের স্বাধীন সাংবাদিকতার অন্তরায়।
একইদিন দেশের ১০ বিশিষ্ট নাগরিক মামলা দায়েরের ঘটনাগুলো হয়রানিমূলক উল্লেখ করে তা বন্ধের দাবি জানিয়েছেন।
প্রায় আট বছর আগে দ্য ডেইলি স্টারে সামরিক গোয়েন্দা সংস্থার সরবরাহ করা সূত্রবিহীন কিছু সংবাদ প্রকাশ করে একটি টক শোতে ভুল স্বীকার করেন মাহফুজ আনাম। এরপর থেকে সরকারের বিভিন্নমহলের পক্ষ থেকে তাঁকে গ্রেপ্তার ও ডেইলি স্টার বন্ধ করার দাবি ওঠে।
মাহফুজ আনাম ছাড়াও দেশের শীর্ষস্থানীয় বাংলা দৈনিক প্রথম আলোর সম্পাদক মতিউর রহমানের বিরুদ্ধে এই মুহূর্তে ৫৮টি মামলা দেশের বিভিন্ন আদালতে বিচারাধীন রয়েছে, যেগুলোর বেশির ভাগই মানহানির মামলা, কয়েকটি মামলা আদালত অবমাননার।
প্রথম আলো বাংলায় ও ডেইলি স্টার ইংরেজিতে একই মালিকানাধীন দুটি বড় পত্রিকা, যেগুলো গুণে ও মানে পাঠকপ্রিয়তা অর্জন করেছে।
মাহফুজ আনাম ও মতিউর রহমান মামলা মোকাবিলা করলেও সরকারবিরোধী আমার দেশ পত্রিকার ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক মাহমুদুর রহমান প্রায় তিন বছর জেলে আছেন। পত্রিকাটি বন্ধ হওয়ায় এর প্রায় ৪০০ সাংবাদিক ও কর্মীর বেশির ভাগই বেকার হয়ে পড়েছেন।
“গত সোমবার ৭০টি মামলায় জামিন পান মাহমুদুর রহমান। কিন্তু ২০১৩ সালের একটি পুরোনো মামলায় তাঁকে গ্রেপ্তার দেখিয়ে আবার জেলে রাখার আয়োজন করেছে সরকার,” বেনারকে জানান বন্ধ ঘোষিত ওই পত্রিকার নির্বাহী সম্পাদক সৈয়দ আবদাল আহমদ।
সরকারবিরোধী আরেক সাংবাদিক নেতা শওকত মাহমুদও জেলে আছেন কয়েক মাস ধরে। তাঁর বিরুদ্ধে মামলার সংখ্যা ৮৮টি। শওকত মাহমুদ জাতীয় প্রেসক্লাবের সাবেক সভাপতি ও বিএনপির চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার উপদেষ্টা।
মাহফুজ আনামের মামলা প্রতিদিন বাড়ছে
মাহফুজ আনামের বিরুদ্ধে গতকাল ১৪টি মামলা হয়েছে চাঁদপুর, গাজীপুর, মানিকগঞ্জ, কুমিল্লা, ময়মনসিংহ, রাজবাড়ী ও গাইবান্ধা জেলায়। এর আগে গত মঙ্গলবার ২০টি, সোমবার ১৭টি ও রোববার ১৩টি মামলা হয়। এর আগে ৯ ও ১১ ফেব্রুয়ারি হয়েছিল পাঁচটি মামলা। মোট মামলার সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৬৯টি।
গত মঙ্গলবার নারায়ণগঞ্জের মুখ্য বিচারিক হাকিম আদালত মানহানির একটি মামলায় মাহ্ফুজ আনামের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারির আদেশ দেন। এ নিয়ে তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়।
সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে মানহানির অভিযোগে করা মামলায় সরাসরি গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারির বিধান বাতিল করে ২০১১ সালের ২ ফেব্রুয়ারি জাতীয় সংসদে বিল পাস হয়। এরপর থেকে সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে করা মানহানির মামলায় সমন জারি করে আসছেন আদালত।
কিন্তু নারায়ণগঞ্জে গ্রেপ্তারি পরোয়ানার আদেশ দেওয়া হয়। সরকারি কৌঁসুলি (পিপি) ওয়াজেদ আলী বিষয়টি নিশ্চিত করে সাংবাদিকদের বলেন, মাহ্ফুজ আনামের বিরুদ্ধে ৫০০ ও ৫০১ ধারায় গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেছেন আদালত।
তবে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক এ প্রসঙ্গে সাংবাদিকদের জানান, গ্রেপ্তারি পরোয়ানা হবে না। এটা হবে সমন।
গতকাল বুধবার গ্রেপ্তারের ওই আদেশ সংশোধন করে সমন জারি করেন আদালত।
এটা স্বাধীন সাংবাদিকতার পরিপন্থী: সম্পাদক পরিষদ
মাহফুজ আনামের বিরুদ্ধে দেশের বিভিন্ন স্থানে মামলা দায়েরের ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছে সম্পাদক পরিষদ। গতকাল বুধবার ঢাকা ক্লাবে অনুষ্ঠিত পরিষদের এক সভায় এর নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়ে বলা হয়, এ ধরনের ঘটনা স্বাধীন সাংবাদিকতার পরিপন্থী।
সভায় বলা হয়, “আমরা আশা করি, মাহফুজ আনামের বিরুদ্ধে দায়ের করা সকল মামলা প্রত্যাহার করা হবে এবং এ ব্যাপারে সকল মহলের শুভ বুদ্ধির উদয় হবে।”
সভায় সভাপতিত্ব করেন সম্পাদক পরিষদের সভাপতি ও সমকাল সম্পাদক গোলাম সারওয়ার। উপস্থিত ছিলেন ডেইলি স্টার সম্পাদক মাহফুজ আনাম, নিউজ টুডের সম্পাদক রিয়াজ উদ্দিন আহমেদ, ফিনান্সিয়াল এক্সপ্রেসের সম্পাদক মোয়াজ্জেম হোসেন, মানবজমিনের প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী, ইনডিপেনডেন্ট সম্পাদক এম শামসুর রহমান, বাংলাদেশ প্রতিদিনের সম্পাদক নঈম নিজাম, প্রথম আলোর সম্পাদক মতিউর রহমান, নিউ এজ সম্পাদক নূরুল কবির, কালের কন্ঠের সম্পাদক ইমদাদুল হক মিলন, বণিক বার্তার সম্পাদক দেওয়ান হানিফ মাহমুদ, ইনকিলাব সম্পাদক এ এম এম বাহাউদ্দীন, ভোরের কাগজ সম্পাদক শ্যামল দত্ত ও ঢাকা ট্রিবিউনের সম্পাদক জাফর সোবহান।
হয়রানি না করার আহ্বান নয় বিশিষ্ট নাগরিকের
মাহ্ফুজ আনামের বিরুদ্ধে একের পর এক মামলায় জড়িয়ে হয়রানি করায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন দেশের নয়জন বিশিষ্ট নাগরিক।
এ বিষয়ে গতকাল শিক্ষাবিদ অধ্যাপক আনিসুজ্জামান স্বাক্ষরিত এক বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, গত এক সপ্তাহে বিভিন্ন জেলায় সাংবাদিক মাহ্ফুজ আনামের বিরুদ্ধে ৫০টিরও বেশি মানহানির মামলা করা হয়েছে ও সমন জারি করা হয়েছে। এতে আমরা গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করছি।
বিবৃতিতে বলা হয়, সাংবাদিকতার নীতি নৈতিকতা মেনে বিশেষ পরিস্থিতিতে প্রকাশিত সংবাদের বিষয়ে ভুল স্বীকার করার মধ্য দিয়ে বিষয়টি নিষ্পত্তি হয়ে গেলে বাক স্বাধীনতার জগতে এক উন্নত সংস্কৃতির নজির হতে পারতো। কিন্তু জেলায় জেলায় তাঁর বিরুদ্ধে মানহানি ও রাষ্ট্রদ্রোহিতার ঢালাও অভিযোগ এনে এতগুলো মামলা করায় বিষয়টি হয়রানির পর্যায়ে চলে গেছে।
এটি একটি গণতান্ত্রিক পরিবেশ ও সংবাদপত্রসহ নাগরিকের মত প্রকাশের স্বাধীনতাকে অবজ্ঞা করার শামিল বলে মত দেন বিশিষ্ট নাগরিকেরা।
এসব নাগরিকেরা হচ্ছেন অধ্যাপক আনিসুজ্জামান, অ্যাডভোকেট সুলতানা কামাল, ডা. সারওয়ার আলী, অধ্যাপক এম এম আকাশ, অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরী, আয়েশা খানম, জিয়া উদ্দিন তারেক আলী ও আবুল হাসনাত।
এ ধরনের অবস্থান অগণতান্ত্রিক ও প্রতিক্রিয়াশীল চক্রকে তাদের দুরভিসন্ধিমূলক অপপ্রয়াস চালানোর সুযোগ করে দিতে পারে-এমন আশঙ্কা করে বিজ্ঞপ্তিতে বিশিষ্টজনরা বলেন, সরকার, গণমাধ্যম ও নাগরিক সমাজকে স্ব স্ব ক্ষেত্রে অধিকতর দায়িত্বশীল হয়ে এ ধরনের অবস্থা মোকাবিলা করতে হবে।
আসক এর উদ্বেগ
মাহ্ফুজ আনামের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগে মামলা ও সমন জারির ঘটনায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক)। গতকাল আসক-এর নির্বাহী পরিচালক সুলতানা কামাল স্বাক্ষরিত এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়।
বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, ৪ ফেব্রুয়ারি রাতে একটি বেসরকারি টেলিভিশনের টকশোতে সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা ও গণমাধ্যমের বিচ্যুতির প্রসঙ্গে সম্পাদক মাহ্ফুজ আনাম ২০০৭ সালে ডেইলি স্টার পত্রিকায় একটি সংবাদ যাচাই না করে ছাপার কারণে দুঃখ প্রকাশ করেছিলেন।
মাহ্ফুজ আনামের এ স্বীকারোক্তির পর থেকেই তাঁর বিরুদ্ধে দেশের বিভিন্ন স্থানে একের পর এক রাষ্ট্রদ্রোহ ও মানহানির মামলা দায়ের হয়েছে। মাহ্ফুজ আনামের দুঃখ প্রকাশের পরপরই তাঁর বিরুদ্ধে যেভাবে অভিযোগ এনে মামলা দায়ের করা হয়েছে ও আদালত কর্তৃক সমন জারি হয়েছে -তা গভীর উদ্বেগের বিষয়।
দুঃখ প্রকাশ ও স্বীকারোক্তির পরেও মাহ্ফুজ আনামের বিরুদ্ধে এ ধরনের আইনি প্রক্রিয়ার ঘটনা গণমাধ্যমের স্বাধীনতার জন্য মোটেও ইতিবাচক নয়-এমন মন্তব্য করে বিজ্ঞপ্তিতে আরও বলা হয়, এতে মতপ্রকাশ ও গণমাধ্যমের স্বাধীনতা চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
এ প্রসঙ্গে আসক উল্লেখ করেছে, সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৩৯ প্রত্যেক নাগরিকের বাক ও ভাব প্রকাশের স্বাধীনতা এবং অনুচ্ছেদ-১১ মৌলিক মানবাধিকার ও স্বাধীনতার নিশ্চয়তাকে নিশ্চিত করে।
মুক্তচিন্তার সংকট চলছে: মির্জা ফখরুল
মাহফুজ আনামের বিরুদ্ধে মামলাকে মুক্তচিন্তার সংকট বলে আখ্যায়িত করেছেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। তিনি বলেন, “পত্রপত্রিকায় লিখছে বিএনপির সংকট। এই সংকট বিএনপির শুধু নয়, প্রমাণিত হয়েছে আজ যখন মাহফুজ আনামের বিরুদ্ধে ৩৭টি মামলা হয়, তখন বিএনপির সংকট নয়, এই সংকট মুক্তচিন্তার সংকট।”
গতকাল বুধবার দুপুরে ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটি মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত এক আলোচনা সভায় তিনি এ কথা বলেন।
মির্জা ফখরুল বলেন, গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় অবশ্যই সরকারের সমালোচনা হবে। কিন্তু এখন সমালোচনা করতে গেলেই রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা হয়। কথা বলা যায় না। পত্রিকায় লেখা যায় না। সরকারের বিরুদ্ধে কিছু বললে রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা হয়।