ইউরোপ যাচ্ছে বাংলাদেশের আম, ওয়ালমার্ট বাছাই করছে

ঢাকা থেকে জেসমিন পাপড়ি
2015.05.20
BD-mango প্রথমবারের মতো বাংলাদেশের আম ইউরোপ ও আমেরিকার বাজারে রফতানী হতে যাচ্ছে। এপ্রিল, ২০১৫
বেনার নিউজ

হিমসাগর, আম্রপলি, ল্যাংড়া। বিখ্যাত সব আমের জাত। আর বাংলাদেশের এসব আম এখন যাচ্ছে ইউরোপের বাজারে। প্রাথমিকভাবে ২ হাজার ৮শ কেজি আম যুক্তরাজ্যে পাঠানো হয়েছে।

এর ফলে আম উৎপাদনকারীদের জন্য একটি বিশাল বাজার সৃষ্টির সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। পাশাপাশি উৎপাদনকারীরা তাদের উন্নতমানের আমের জন্য ভালো দামও পাবেন।

সরকারের কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর এবং জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষিবিষয়ক সংস্থার (এফএও) সহায়তায় বাংলাদেশের এসব আম কিনছে বিশ্বের সবচেয়ে বড় খুচরা পণ্য বিক্রেতা প্রতিষ্ঠান ওয়ালমার্ট। এসব ফল উৎপাদনে কারিগরি সহায়তা দিয়েছে সরকারি প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ হর্টেক্স ফাউন্ডেশন। এই সম্মিলিত চেষ্টায় বিশ্ববাজারের ক্রেতাদের জন্য আম এখন থেকে নিয়মিতভাবে রপ্তানির সুযোগ তৈরি হলো।

হর্টেক্স ফাউন্ডেশন যৌথভাবে সাতক্ষীরা, চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও রাজশাহীর আম উৎপাদনকারী এলাকায় যুক্তরাজ্যের আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞদের মাঠ পর্যায়ে পরিদর্শনের ব্যবস্থা করে। পরিদর্শন শেষে নয়টি জাতের আমের নমুনা পাঠানো হয়। সেখান থেকে ওয়ালমার্ট তিন জাতের আম আমদানির জন্য বাছাই করে।

প্রাথমিকভাবে সাতক্ষীরার হিমসাগর আম রপ্তানি শুরু হয়েছে। এরপর অন্যান্য জেলার থেকে প্রতি সপ্তাহে ৪ মণ করে আম যুক্তরাজ্যের বাজারে রপ্তানি হবে। এসব আম স্থান পাবে ইউরোপের সুপার শপগুলোতে।

এ বিষয়ে হর্টেক্স ফাউন্ডেশনের মহাপরিচালক ড. আব্দুল জলিল ভূঁইয়া বেনারকে বলেন, ‘প্রাথমিক ভাবে রোববার থেকে আমরা আনুষ্ঠানিক ভাবে আম রফতানি শুরু করেছি। প্রথম দিনে ২ হাজার ৮শ কেজি সাতক্ষীরার হিমসাগর রফতানি করা হয়েছে। এখন হিমসাগরের উৎপাদনের সময়। অন্যান্য আমের উৎপাদন অনুসারে সেগুলোও রফতানি করা হবে।’

তিনি বলেন, কয়েক বছর ধরে ইউরোপে বাংলাদেশ থেকে আম রফতানি হলেও সুপার শপে এই প্রথম রফতানি শুরু করেছে বাংলাদেশ। এখন এ সুযোগ সৃষ্টি হওয়ায় বাংলাদেশ রফতানি বাড়বে।

জানা যায়, আমে মুকুল আসা থেকে শুরু করে আম উৎপাদন পর‌্যন্ত প্রত্যেকটি ধাপে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর ও এফএওর সমন্বয়ে গঠিত বিশেষজ্ঞ দল পরিদর্শন করেছে।

রপ্তানি হতে যাওয়া আম যে বাগানে চাষ হয়েছে, সেখানে উৎপাদনের প্রতিটি পর্যায়ে পরিদর্শনে ওই আমে কোনো ধরনের ক্ষতিকর রাসায়নিক দ্রব্য ব্যবহৃত হয়নি বলে ছাড়পত্র পেয়েছে। পরে ওই আম জনস্বাস্থ্য বিভাগের পরীক্ষাগারে পরীক্ষা করা হয়। প্রতিটি স্তরেই আমগুলো নিরাপদ হিসেবে প্রমাণিত হওয়ার পর ওয়ালমার্টে রপ্তানির অনুমতি পেয়েছে।

এ বিষয়ে জলিল ভূঁইয়া বলেন, বিদেশে পাঠানোর উপযোগী করতে কৃষকদের প্রশিক্ষণ দেওয়াসহ পুরো উৎপাদন প্রক্রিয়া নিবিড়ভাবে পর‌্যবেক্ষণ করা হয়েছে। সাতক্ষীরার সদর, চাপাইনবাবগঞ্জ সদর ও ভোলাহাট, রাজশাহীর বাঘা ও চারঘাট, পাবনার ইশ্বরদি এবং খাগড়াছড়ি ও রাঙামাটির সদর উপজেলার ১৮০ জন আমচাষী ইতিমধ্যে ওয়ালমার্টের কাছে নাম লিখিয়েছেন।

বাংলাদেশ থেকে আম রপ্তানির ব্যাপারে বিশ্বের শীর্ষ পণ্য ক্রয়কারী প্রতিষ্ঠান ইন্টারন্যাশনাল প্রকিউরমেন্ট লজিস্টিকসের সঙ্গে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর, হর্টেক্স ফাউন্ডেশন ও এফএওর একটি চুক্তিও স্বাক্ষর হয়েছে বলেও তিনি জানান।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্র জানায়, পর্যায়ক্রমে বাংলাদেশ থেকে আম ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রের বাজারেও পাঠানোর চেষ্টা করা হচ্ছে।

এ বিষয়ে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক এজেডএম মমতাজুল করিম বেনারকে বলেন, ‘বাংলাদেশের কয়েকটি অঞ্চলে আম চাষ হয়। সে ধারণা থেকে সরে আসার সময় হয়েছে। পাহাড়ি এলাকা ও বসতবাড়িতে আমগাছ লাগানোর জন্য উদ্যোগ নিয়েছি আমরা। এতে দেশে আমের ফলন আরও চার লাখ টন বাড়ানো সম্ভব হবে। বর্তমানে দেশে মাথাপিছু দৈনিক আমের ভোগ ১০ গ্রাম থেকে বাড়িয়ে ১৫ গ্রামে পরিণত করার লক্ষ্যপূরণের পাশাপাশি বিশ্বের আমবাজারেও দখল নিতে চাই আমরা।’

এফএওর ২০১৪ সালের পরিসংখ্যান বলছে, বাংলাদেশ বিশ্বের সপ্তম আম উৎপাদনকারী দেশ। তা সত্ত্বেও বাংলাদেশ এত দিন বৈশ্বিক আম রপ্তানির বাজারে প্রবেশ করতে পারেনি। শুধুমাত্র বাংলাদেশি বসবাস করেন এমন কিছু দেশে প্রতিবছর সামান্য রপ্তানি হত, যা বাংলাদেশি ব্যবসায়ীরাই বিক্রি করতেন।

কিন্তু আমে ফরমালিন ও অন্যান্য ক্ষতিকারক রাসায়নিক ব্যবহার করা কিছু অসাধু ব্যবসায়ীদের জন্য সেসব বাজারেও আম রফতানি বন্ধ হয়ে যায়। আর তাই  সুনাম ধরতে এবার কঠোর নিরাপত্তার মধ্য দিয়ে রপ্তানির জন্য আম উৎপাদন করেছে হর্টেক্স ফাউন্ডেশন।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের হিসাবে, ২০১২ সালে দেশে ৩৭ হাজার হেক্টর জমিতে আম চাষ হয়, এ বছর হয়েছে ৪২ হাজার হেক্টর জমিতে। গত আমের উৎপাদন ছিল ৯ লাখ ৪৫ হাজার টন। এ বছর তা ১০ লাখ টন ছাড়াবে বলে আশা করা হচ্ছে। আমের ফলন বাড়ার দিক থেকে বিশ্বের আম উৎপাদনকারী দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশে সবচেয়ে এগিয়ে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কৃষকদের অবশ্যই আম উৎপাদন নীতিমালা মেনে মানসম্মত আম উৎপাদন করতে হবে। তাহলে বিশ্বের আম বাজারে শক্ত অবস্থান গড়বে বাংলাদেশ। আম রপ্তানির ফলে উৎপাদনকারীরা পাবে উচ্চমূল্য পাবে এবং জীবনযাত্রার মানও হবে উন্নত। এরজন্য সরকারের পাশাপাশি সকলকে এগিয়ে আসতে হবে।

যুক্তরাজ্যে আম রফতানির খবর কৃষকদের মধ্যে ব্যাপক সাড়া ফেলেছে। রাজশাহীর আমচাষী হাবিল সরকার বেনারকে বলেন, ‘খবরটি শুনে খুব খুশি হয়েছি। দেশের বাজার ডিঙিয়ে বিদেশেও যাবে আমাদের বাগানের আম। এবার স্থানীয় বাজারের জন্য আম উৎপাদন করলেও পরের বছর অবশ্যই কৃষি অধিদপ্তরের সহায়তায় কোন রাসায়নিক দ্রব্য ব্যবহার ছাড়া আম উৎপাদন করতে চাই।’

তবে রফতানির বিষয়টি আম চাষিদেরকে জানানোর ব্যবস্থা করে এ বিষয়ে তাদের আরো সচেতন করে তুলতে সরকারের প্রতি আহবান জানান কৃষক হাবিল।

এফএওর হিসাব অনুযায়ী, ২০১২ সালে বাংলাদেশ ৮ লাখ ৯০ হাজার টন আম উৎপাদন করে বিশ্বের অষ্টম আম উৎপাদনকারী দেশ হয়েছিল। গত দু বছরের মধ্যে দেশে আমের উৎপাদন বেড়ে তা ১০ লাখ টন হয়েছে। আর উৎপাদনকারী দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান সপ্তম স্থানে চলে এসেছে। দেশে এখন প্রায় দেড় কোটি আমগাছ রয়েছে।

এফএওর হিসাবে বর্তমানে বিশ্বের শীর্ষ আম উৎপাদনকারী দেশ ভারত। এর পরেই রয়েছে চীন, থাইল্যান্ড, ইন্দোনেশিয়া ও পাকিস্তান। আর আম রপ্তানিকারক দেশের শীর্ষে আছে মেক্সিকো। এরপর রয়েছে ফিলিপাইন, পাকিস্তান, ব্রাজিল ও ভারত।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।