মিয়ানমারের রাষ্ট্রদূতকে ফের তলব, রাজ্জাককে নির্যাতন করায় বিজিবির প্রতিবাদ
2015.06.19

কক্সবাজারের নাফ নদীতে বিজিবির সদস্যদের ওপর গুলিবর্ষণ ও নায়েক আবদুর রাজ্জাককে অপহরণের ঘটনায় ঢাকায় মিয়ানমারের রাষ্ট্রদূত মিউ মিন্ট থানকে ১৮ জুন ফের তলব করেছে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। তাঁকে নির্যাতন করে সেই ছবি প্রকাশ করায় গতকাল ১৯ জুন ফ্যাক্স ও ই মেইলে মিয়ানমারের বর্ডার গার্ড পুলিশের (বিজিপি) কাছে কড়া প্রতিবাদ পাঠিয়েছে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ–বিজিবি।
ডেকে নিয়ে মিয়ানমারের বিজিপির হাতে আটক রাজ্জাককে অবিলম্বে ফিরিয়ে দেওয়ার দাবি জানিয়েছে বাংলাদেশ।
চলতি মাসে এ নিয়ে দ্বিতীয়বারের মতো মিয়ানমারের রাষ্ট্রদূতকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে তলব করা হলো। এর আগে সমুদ্রপথে মানব পাচারকারীদের হাত থেকে উদ্ধার হওয়া লোকজন বাংলাদেশের নাগরিক বলে মিয়ানমার অপপ্রচার চালালে দেশটির এ ভূমিকার প্রতিবাদে ৫ জুন মিন্ট থানকে তলব করা হয়েছিল।
নায়েক রাজ্জাককে ফিরিয়ে দেওয়ার বিষয়ে টেকনাফে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) ও বিজিপির মধ্যে ১৮ জুন যে পতাকা বৈঠক হওয়ার কথা ছিল, তা হয়নি। ১৯ জুন বেলা ১২টায় বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তের ঘুমধুম জিরো পয়েন্টে পতাকা বৈঠক অনুষ্ঠিত হলেও রাজ্জাককে ফেরত দেওয়া হয়নি।
এ নিয়ে বিজিবি ও বিজিপির মধ্যে উত্তেজনা চলছে। এরই মধ্যে অপহৃত বিজিবির নায়েক রাজ্জাককে হাতকড়া পরিয়ে আটকে রাখার ছবি প্রকাশ করা হয়েছে ফেসবুকে বিজিপির পেজে। এই ঘটনাকে অমানবিক উল্লেখ করে কড়া প্রতিবাদ জানানো হয়েছে।
গতকাল শুক্রবার ইমেইল ও ফ্যাক্সযোগে বিজিবির পক্ষ থেকে পাঠানো ওই প্রতিবাদে বলা হয়, বিজিবির একজন সদস্যকে ধরে নিয়ে গিয়ে নির্যাতন, হাতকড়া পরিয়ে রাখা আন্তর্জাতিক কোন আইনে তো পড়েই না বরং এগুলো মানবতাবিরোধী কাজ। এর মাধ্যমে কেবল বিজিবিকেই অপমান করা নয় বরং বাংলাদেশের ১৬ কোটি মানুষকেও আঘাত করা হয়েছে।
আটক রাজ্জাককে ফেরতের জন্য কয়েক দিন ধরেই যোগাযোগ অব্যাহত রেখেছে বিজিবি। কিন্তু মিয়ানমার বলছে, তারা উধবর্তন কতৃর্পক্ষের কাছ থেকে অনুমতি না পাওয়ায় বৈঠক হয়নি। গতকাল আবার যোগাযোগ করা হলে বিজিপি জানিয়েছে, দেশটির স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অনুমতি ছাড়া তাকে ফেরত দিতে পারবে না।
বিজিবি সূত্রে জানা গেছে, রাজ্জাককে ফেরত না দিয়ে বিজিপির ফেসবুকে তিনিটি ছবি প্রকাশ করা হয়েছে। একটি ছবিতে দেখা যাচ্ছে, রাজ্জাকের নাক দিয়ে রক্ত বের হচ্ছে আর তার পেছনে বিজিপির একজন সদস্য দাঁড়ানো।
আরেকটি ছবিতে দেখা যাচ্ছে রাজ্জাকের সামনে তাঁর অস্ত্র ও অন্যান্য সামগ্রী রেখে তাকে আসামির মতো করে দাঁড় করিয়ে রাখা হয়েছে। তৃতীয় ছবিতে দেখা যাচ্ছে তাকে হাতকড়া পরিয়ে রাখা হয়েছে।
এসব ছবির বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে বিজিবির উর্ধ্বতন একজন কর্মকর্তা বলেন, এ ঘটনায় বাংলাদেশ প্রচণ্ড ক্ষুব্ধ। বিজিবি ও বাংলাদেশ সরকার মাথা ঠান্ডা রেখে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে চায়।
“আরও একটি পতাকা বৈঠকের মাধ্যমে দ্রুততম সময়ের মধ্যে বিজিবি সদস্য নায়েক রাজ্জাককে ফেরত দিতে রাজি হয়েছে মিয়ানমার সীমান্তরক্ষী বাহিনী,” বেনারকে জানান বিজিবির কক্সবাজার সেক্টর কমান্ডার এম এম আনিসুর রহমান।
গতকাল ১৯ জুন দেড় ঘণ্টাব্যাপী বৈঠক হয় বিজিবি–বিজিপির সঙ্গে। এ সময় কক্সবাজার সেক্টরের কমান্ডার এমএম আনিসুর রহমানের কাছে ৩৭ বাংলাদেশিকে হস্তান্তর করেন মিয়ানমার ইমিগ্রেশন বিভাগের সহকারী পরিচালক চ নাইং।
এর আগে গত ৮ জুন ১৫০ জনকে যাচাই বাছাইয়ের মাধ্যমে মিয়ানমার থেকে ফেরত আনা হয়েছিল।
২৯ মে মিয়ানমারের জলসীমায় পাচারকারীদের আরেকটি নৌকা থেকে ৭২৭ জনকে উদ্ধার করে দেশটির নৌ-বাহিনী, যাদের রোহিঙ্গা ও বাঙালি পরিচয় দিয়েছে আন্তর্জাতিক বিভিন্ন গণমাধ্যম। এদের মধ্যে মোট ১৮৭ জন বাংলাদেশি বলে নিশ্চিত হওয়া গেল।
“ইমিগ্রেশনের আনুষ্ঠানিকতা ও জিজ্ঞাসাবাদ শেষে গতকাল ফিরে আসা ৩৭ জনকে স্বজনদের কাছে হস্তান্তরের ব্যবস্থা নেবে জেলা প্রশাসন,” বেনারকে জানান ১৭ ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লে. কর্নেল খন্দকার সাইফুল আলম।
বিজিবি সূত্র জানায়, অপহরণ করে আটকে রাখার ঘটনা মিয়ানমারের কাছে পুরোনো। গত বছরের ২৮ মে বান্দরবানের পাইনছড়ি সীমান্ত এলাকায় বিজিপির সদস্যরা বিনা উসকানিতে বিজিবির সদস্যদের ওপর গুলি চালান।
ওই সময় মিয়ানমারের সদস্যরা বিজিবির সদস্য নায়েক সুবেদার মিজানুর রহমানকে অপহরণ করে হত্যা করেন। দুই দিন পর বিজিবি মিজানুর রহমানের লাশ ফেরত নিতে গেলে উল্টো বিজিপি ওই প্রতিনিধিদলের ওপর গুলি চালায়। পরে ৩১ মে মিজানুরের লাশ ফেরত দেয় বিজিপি।
প্রায় একইভাবে গত ১৭ জুন ভোরে বিজিবির ছয় সদস্যের একটি দল নায়েক আবদুর রাজ্জাকের নেতৃত্বে নাফ নদীতে টহল দিচ্ছিল। তাঁরা বাংলাদেশের জলসীমায় মাদক চোরাচালান সন্দেহে দুটি নৌকায় তল্লাশি করছিলেন।
একপর্যায়ে বিজিপির সদস্যদের বহনকারী ট্রলারটি বিজিবির টহল নৌযানের কাছে এসে থামে। বিজিপির ট্রলারটিকে বাংলাদেশের জলসীমা ছেড়ে যেতে বলা হলে তাঁরা নায়েক রাজ্জাককে জোর করে ট্রলারে তুলে নেন।
বিজিবির অন্য সদস্যরা এতে বাধা দিলে দুই পক্ষের মধ্যে গুলিবিনিময় হয়। এতে সিপাহি বিপ্লব কুমার গুলিবিদ্ধ হন।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সূত্র জানায়, অতিরিক্ত পররাষ্ট্রসচিব মো. মিজানুর রহমানের দপ্তরে তলব করা হলে গুলিবর্ষণের ঘটনার ব্যাখ্যা দেন মিউ মিন্ট থান। তিনি জানান, ডাকাত ভেবে বিজেপি সদস্যরা গুলি ছুড়েছিল।
মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, অতিরিক্ত পররাষ্ট্রসচিবের দপ্তরে বসেই মিউ মিন্ট থান মিয়ানমারে ফোন করে বিজিবির সদস্যকে দ্রুত ফেরত দেওয়ার জন্য পদক্ষেপ নিতে বলেন। এরপর একদিন পার হলেও মিয়ানমান ইতিবাচক কিছু জানায়নি।
এদিকে মিয়ানমার থেকে ফেরত আসা ৩৭ জন বাংলাদেশির মধ্যে রয়েছে সিরাজগঞ্জের ৫, মাদারীপুর ১, সুনামগঞ্জ ৪, কিশোরগঞ্জ ৮, হবিগঞ্জ ১১, জামালপুর ১ ও বগুড়ার ৭ জন।
“আজ (১৯ জুন) বিকেলে তাঁদের কক্সবাজার সাংস্কৃতিক কেন্দ্রে আনা হয়েছে। সেখানে তাঁদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। ২০ জুন আদালতের মাধ্যমে তাঁদের স্বজনদের কাছে দেওয়া হবে। এ ছাড়া তিন শিশুকে রেডক্রিসেন্ট সোসাইটির মাধ্যমে তাদের বাড়ি পৌঁছে দেওয়া হবে,” বেনারকে জানান কক্সবাজারের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার তোফায়েল আহমদ।