জঙ্গিচক্রে যোগ দিচ্ছে শিক্ষিত-উচ্চবিত্ত শ্রেনীর ছেলেরা, নতুন করে গ্রেফতার ৪ জন

ঢাকা থেকে জেসমিন পাপড়ি
2015.06.19
BD-militants হরকাতুল জিহাদ আল ইসলামিয়া বাংলাদেশ (হুজি-বি) ও আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের কাছে এসব বিস্ফোরক ও রাসায়নিক পদার্থ সরবারহ করার সন্দেহে আটক হওয়া চার ব্যক্তি। ১৯ জুন,২০১৫
বেনার নিউজ

বাংলাদেশে জঙ্গি কার্যক্রমে বাড়ছে শিক্ষিত, উচ্চবিত্ত শ্রেণীর সংখ্যা। এমনকি বাদ যাচ্ছেন না বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র, শিক্ষক, কর্মচারিরাও।

এর সর্বশেষ প্রমাণ মিলেছে শুক্রবার। এদিন গোয়েন্দা পুলিশের হাতে নিষিদ্ধ কয়েকটি জঙ্গি সংগঠনের কাছে রাসায়নিক পদার্থ ও বিস্ফোরক সরবরাহের অভিযোগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মচারিসহ গ্রেফতার হয়েছে চারজন।

এর আগেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকসহ কয়েকটি বেসরকারি বিদ্যালয়ের ছাত্ররা জঙ্গি সন্দেহে আটক হন।


শুক্রবার আটক হওয়া চার ব্যক্তি হরকাতুল জিহাদ আল ইসলামিয়া বাংলাদেশ (হুজি-বি) ও আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের কাছে এসব বিস্ফোরক ও রাসায়নিক পদার্থ সরবারহ করত বলে দাবি করেছে পুলিশ।


শুক্রবার দুপুরে সংবাদ সম্মেলনে তাদেরকে গণমা্ধ্যমের সামনে হাজির করা হয়।


এসময় ডিবি যুগ্ম কমিশনার মনিরুল ইসলাম বলেন, গত ৭ জুন ছয় কেজি বিস্ফোরকসহ হরকাতুল জিহাদ আল ইসলামিয়া বাংলাদেশ ও আনসার উল্লাহ বাংলা টিমের ৯ জন সদস্য গ্রেপ্তার হন। গ্রেপ্তার এই চারজন তাদের কাছে বিস্ফোরক দ্রব্য বিক্রি করেছিলেন।


গ্রেপ্তারকৃত ব্যক্তিরা হলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মৃত্তিকা, পানি ও পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের ল্যাব সহকারী গাজী মোহাম্মদ বাবুল, টিকাটুলির তিন রাসায়নিক দ্রব্য বিক্রেতা প্রতিষ্ঠান এশিয়া সায়েন্টিফিকের মালিক রিপন মোল্লা, ওয়েস্টার্ন সায়েন্টিফিক কোম্পানির মালিক মহিউদ্দিন ও এফএম কেমিক্যাল অ্যান্ড সন্সের মালিক নাসির উদ্দিন।


মনিরুল ইসলাম জানান, এর আগে গ্রেপ্তার হুজি ও বাংলা টিমের সদস্যদের জিজ্ঞাসাবাদ করে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে শুক্রবার এই চারজনকে গ্রেফতার করা হয়। তাদের সঙ্গে কোনো জঙ্গি সংগঠনের সঙ্গে সম্পর্ক আছে কিনা তা খতিয়ে দেখা হবে। তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে বলে জানান তিনি।


ডিবি দক্ষিণের উপকমিশনার মো. মাশরুকুর রহমানের নির্দেশনায় এডিসি মোহাম্মদ ছানোয়ার হোসেনের তত্ত্বাবধানে গতকাল রাজধানীর ঢাকার বিভিন্ন জায়গা থেকে তাদের গ্রেপ্তার করা হয়।


গোয়েন্দারা বলছে, নিম্নবিত্তের পাশাপাশি উগ্র ধর্মীয় মৌলবাদে দীক্ষিত হয়ে সমাজের উচ্চবিত্তের  শিক্ষিত তরুণরাও বিপথগামী হয়ে জঙ্গি সংঠনগুলোর সঙ্গে জড়িয়ে পড়ছে। এদের মধ্যে বিচারপতি,  সচিব, আবার  সেনাবাহিনীর সাবেক উচ্চপদস্থ কর্মকর্তার সন্তানরাও আছে।

জঙ্গিদের সঙ্গে সম্পৃক্ততার প্রমাণ আছে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শুরু করে দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, কর্মচারিদেরও। বিশেষ করে শিক্ষিতদের সংখ্যা সদ্য নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গি সংগঠন আনসারুল্লাহ বাংলা টিমে (এবিটি) বেশি লক্ষ্য করা যাচ্ছে বলে জানান গোয়েন্দারা।


২০১৩ সালে ব্লগার রাজীব হত্যার মধ্য দিয়ে আলোচনায় আসে এ সংগঠনটি। এরই মধ্যে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ৩০ থেকে ৩৫ জন এবিটি সদস্যকে আটক করেছে। সংগঠিনটির কর্মকাণ্ড ও কৌশল ভাবিয়ে তুলেছে সংশ্লিষ্টদের।


সম্প্রতি আটক হওয়া কিছু জঙ্গি

ব্লগার রাজীব হত্যায় আটক হন ফয়সাল বিন নাইম ওরফে দীপ (২২), মাকসুদুল হাসান অনিক (২৬), এহসান রেজা রুম্মন (২৩), নাঈম সিকদার ইরাদ(১৯), নাফিজ ইমতিয়াজ (২২), সাদমান ইয়াসির মাহমুদ(২০)। মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) উপ-কমিশনার শেখ নাজমুল আলম জানান যাদের প্রত্যেকেই বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র এবং ধনাঢ্য পরিবারের সন্তান।

ব্লগার রাজীব হত্যার আটককৃত জুন্নুন সিকদার ছিলেন নর্থ-সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। পরে তিনি ভর্তি হন দারুল ইহসান বিশ্ববিদ্যালয়ের আরবী বিভাগে।
গত ২৫ ফেব্রুয়ারি ব্লগার অভিজিৎ হত্যায় গ্রেপ্তার শফিউর রহমান ফারাবী ছিলেন নটরডেম কলেজের ছাত্র। পরে তিনি ভর্তি হন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে। এর মধ্যেই জড়িয়ে পড়েন জঙ্গি সংগঠনের সাথে।

এ বছরের মে মাসে রাজধানীর বারিধারা থেকে আটককৃত বাংলাটিমের সদস্য আব্দুল্লাহ আল গালীব একটি ইংরেজি মাধ্যম স্কুল থেকে ‘এ’ লেভেল পাস করেন। তার বাবা মেজর (অব.) আব্দুল্লাহ। গালীব আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের সক্রিয় সদস্য। তিনি আল কায়েদার আদলে বাংলাদেশে নতুন একটি সংগঠন তৈরির কাজ শুরু করেছিলেন।

২০১৪ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর রাজধানীর সেগুনবাগিচা থেকে আটক করা হয় বাংলাটিমের সদস্য আসিফ আদনানকে। তার বাবা অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে স্নাতকোত্তর পাস করেন। একই সময় আটক ফজলে এলাহী ‘এ’ লেভেল পাস করেন রাজধানীর একটি ইংরেজি মাধ্যম স্কুল থেকে। তার মা যুগ্মসচিব, যিনি বর্তমানে ওএসডি।

গত ২১ এপ্রিল আশুলিয়ায় কমার্স ব্যাংকের ডাকাতির ঘটনায় আটকৃতরা সবাই আনসারুল্লাহ বাংলাটিমের সদস্য বলে জানায় পুলিশ।
এ ঘটনায় আটক আল আমিন একটি পোশাক কারখানার কর্মী ছিলেন পরে তিনি রিকশা চালান। মজনু প্রধানও রিকশাচালক। বাবুল সরকার গার্মেন্টস কর্মী। সোহেল রানা কমার্স ব্যাংকের নিরাপত্তা কর্মী। বোরহহান উদ্দিন আশুলিয়ায় পরিবহন ব্যবসার সঙ্গে জড়িত।

এরই মধ্যে সাম্প্রতিক সময়ে ১৩ জন তরুণ আইএসের যুদ্ধে যোগ দিতে সিরিয়ার উদ্দেশে দেশ ছেড়েছে বলে গোয়েন্দারা জানিয়েছেন।
এসব বিষয় মাথায় রেখে রাজধানীর বেশ কিছু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ২০০৯ সাল থেকে গোয়েন্দা নজরদারির আওতায় রাখা হয়েছে বলে জানান মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) সিনিয়র এডিসি ছানোয়ার হোসেন।

এছাড়া বিদেশে পড়তে যাওয়া যেসব তরুণকে জঙ্গি সংশ্লিষ্টতার অভিযোগে ফেরত পাঠানো হয়েছে তাদেরকেও নজরদারির মধ্যে রাখা হয়।
সমাজ বিজ্ঞানীরা বলছেন, জঙ্গি কার্যক্রম সমাজের বিভিন্ন স্তরে ছড়িয়ে পড়ছে। এখনই তা সমূলে উৎপাটন করতে হবে।

এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. নেহাল করিম বেনারকে বলেন, এক সময় জঙ্গি বলতে মাদ্রাসা ছাত্র শিক্ষকদের ধরে নেওয়া হত। কিন্তু জঙ্গি কার্যক্রম সমাজের নানা পর্যায়ে ছড়িয়ে পড়ছে। দেশে নানা অনিয়ম মানুষকে বিকল্প পথ ভাবতে শেখায়। সেই সময়টাকে জঙ্গি প্রশিক্ষকরা তাদের মগজ ধোলাই করে থাকে।

তিনি বলেন, এসব জঙ্গিবাদের পাঠশালা বলে পরিচিত মাদ্রাসা শিক্ষাকে বাতিল করতে হবে। দেশে এই শিক্ষার মর্যাদা দেওয়া হয়না, যার কোন প্রায়োগিক দিক নেই সে শিক্ষা রেখে জঙ্গিবাদ বাড়তে দেওয়া যায় না। একজন ব্যক্তি যে পরিবেশে বেড়ে ওঠে সেই ধরনের মানসিকতা ধারণ করে। তাই যারা মাদ্রাসা শিক্ষা নিয়ে বড় হয় তারা জঙ্গিবাদী মানসিকতার সঙ্গেই বেড়ে ওঠে। সরকারের উচিত নতুন প্রজন্মের মেধা বিকাশের স্বার্থে মাদ্রাসা শিক্ষাকে যুগোপযোগী করে গড়ে তোলা।


মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।