নতুন আইনের বেড়াজালে অর্থ লেনদেন এবং এনজিও

ঢাকা থেকে শাহরিয়ার শরীফ
2015.09.09
BD-money অবৈধ লেনদেন বন্ধ করার জন্য সংসদে নতুন আইন পাস করা হয়। ৬ সেপ্টেম্বর,২০১৫
অনলাইন

একের পর এক বাংলাদেশে এমন সব আইন তৈরী হচ্ছে যার মূল লক্ষ্য মুদ্রাপাচার ঠেকানো এবং অবৈধ লেনদেন বন্ধ করা। এছাড়াও অন্যতম লক্ষ্য জঙ্গীবাদ সামাল দেওয়া।

এসব লক্ষ্যে বাংলাদেশে অবস্থানরত অন্য দেশের নাগরিকদের হাতে থাকা বিদেশি মুদ্রা এবং বিদেশে তাদের সম্পত্তির তথ্য চাওয়ার বিধান রেখে গত ৬ সেপ্টেম্বর একটি আইন পাস হয়েছে সংসদে।

‘ফরেন এক্সচেঞ্জ রেগুলেশন (অ্যামেন্ডমেন্ট) বিল-২০১৫’ শিরোনামে এই আইনটি জাতীয় সংসদে পাসের জন্য উত্থাপন করলে তা কণ্ঠভোটে পাস হয়। অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত এটি উত্থাপন করেন।

সংশোধিত আইন অনুযায়ী, সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংক প্রয়োজনে বাংলাদেশে বসবাসরত বাংলাদেশি ও অন্য দেশের নাগরিকদের হাতে থাকা বিদেশি মুদ্রা বা বৈদেশিক সিকিউরিটিজ সম্পর্কিত তথ্য এবং বিদেশে তাদের স্থাবর বা অন্য সম্পত্তির বিষয়ে তথ্য চাইতে পারবে।

বিলের সংশোধনী প্রস্তাব দেওয়ার সময় জাতীয় পার্টির ফখরুল ইমাম এবং স্বতন্ত্র সদস্য হাজি মো. সেলিম আইন বাস্তবায়নে বিভিন্ন আমলাতান্ত্রিক জটিলতার কথা তুলে ধরেন।

জবাবে অর্থমন্ত্রী বলেন, “আমলাতান্ত্রিক জটিলতা থাকে। কিন্তু আমরা যারা আছি তারা কী ঘোড়ার ঘাস কাটতে আছি?  মন্ত্রিসভা কী ঘোড়ার ঘাস কাটতে আছে?  এখানে যারা নেতৃত্ব দিচ্ছেন তারা জানেন,  কীভাবে দায়িত্ব পালন করতে হয়। আমলাতন্ত্রকে কীভাবে ধরতে হয়,  তা আমরা জানি।”

বৈদেশিক মুদ্রা ও সিকিউরিটিজ ক্রয়-বিক্রয় নিয়ন্ত্রণের জন্য ১৯৪৭ সালে এই আইনটি করা হয়েছিল। পরে ১৯৭৬ ও ২০০৩ সালে দুই দফা সংশোধন করা হয়।

“বাংলাদেশিদের ক্ষেত্রে আইনটি প্রয়োগে কোনো অস্পষ্টতা না থাকলেও বাংলাদেশে বসবাসরত বিদেশি নাগরিকদের ক্ষেত্রে অস্পষ্টতা ছিল। তা দূর করতেই এই সংশোধন,” বেনারকে জানান মন্ত্রীপরিষদ বিভাগের সচিব মোহাম্মদ মোশাররাফ হোসাইন ভূইঞা।

তিনি বলেন, “এই আইন বাংলাদেশের সব নাগরিক ও বাংলাদেশে বসবাসরত বিদেশি নাগরিকদের জন্য প্রযোজ্য হবে।”

আইন সংশোধনের কারণ ব্যাখ্যা করে অর্থমন্ত্রী বলেন,  “বৈদেশিক বিনিয়োগ ও আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের ব্যাপক প্রসারের পরিপ্রেক্ষিতে বৈদেশিক লেনদেনের প্রকার ও আকার এবং নিষ্পত্তির পরিসর অনেক বৃদ্ধি পাওয়ায় আইনটি সংশোধন করা না হলে বাংলাদেশে বৈদেশিক বিনিয়োগ ও আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে অসুবিধার সৃষ্টি হবে এবং যুগোপযোগী কার্যক্রম গ্রহণ বাধাগ্রস্ত হবে।”


এনজিওগুলোর  সন্দেহজনক লেনদেন নজরদারিতে

দেশে কার্যক্রম পরিচালনাকারী সব বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা বা এনজিও এবং অলাভজনক সংস্থা বা প্রতিষ্ঠানকে (এনপিও) মানি লন্ডারিং বা মুদ্রা পাচার প্রতিরোধ ও সন্ত্রাসবিরোধী আইনের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।

এর ফলে এখন থেকে এনজিও এবং এনপিওগুলোর যেকোনো ধরনের সন্দেহজনক লেনদেনের তথ্য বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট ইউনিটকে জানাতে হবে।

গত মঙ্গলবার বাংলাদেশ ব্যাংকের অধীনে প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ) থেকে এ-সংক্রান্ত নির্দেশনা জারি করা হয়েছে।

বিএফআইইউর নির্দেশনা অনুযায়ী, এখন থেকে এনজিও এবং এনপিওগুলো এক লাখ টাকার বেশি লেনদেন করলে অবশ্যই তা ব্যাংকের মাধ্যমে করতে হবে।

বিদেশি সাহায্য বা অনুদান গ্রহণে ব্যবহার করতে হবে একটিমাত্র ব্যাংক হিসাব। কোনো এনজিও বা এনপিও বেনামে, ছদ্মনামে বা শুধু নম্বরযুক্ত কোনো গ্রাহক হিসাব খুলতে পারবে না।

এমনকি যেসব ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান এনজিও এবং এনপিওগুলোর কাছ থেকে সুবিধাভোগী সেবা নেবে, তাদের ব্যাংক হিসাবের ক্ষেত্রেও এ বিধান পরিপালন করতে হবে।

এ ছাড়া মুদ্রা পাচার ও সন্ত্রাসী কাজে অর্থায়ন বন্ধে প্রত্যেক এনজিও এবং এনপিওর প্রধান কার্যালয়ে প্রতিষ্ঠানের প্রধান নির্বাহীর সরাসরি তত্ত্বাবধানে একটি ‘কেন্দ্রীয় পরিপালন ইউনিট’ খুলতে হবে।

যেসব ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান বা গোষ্ঠী এনজিও ও এনপিওর সঙ্গে বছরে ২০ হাজার টাকার বেশি অর্থ বা সেবা লেনদেন করবে, তাদের পূর্ণাঙ্গ পরিচিতি ও সংশ্লিষ্ট দলিল সংরক্ষণ করা বাধ্যতামূলক।

নির্দেশনায় আরও বলা হয়েছে, প্রতিটি এনজিও এবং এনপিও জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ তালিকাভুক্ত এমন কোনো ব্যক্তি বা সংস্থা থেকে ঋণ বা অনুদান গ্রহণ করতে পারবে না, যারা বিভিন্ন সন্ত্রাসী কার্যক্রম ও ধ্বংসাত্মক অস্ত্র বিস্তারের অর্থায়নের সঙ্গে জড়িত রয়েছে।

একইভাবে বাংলাদেশ সরকার যেসব ব্যক্তি, সংস্থা ও সত্তাকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে তাদের হালনাগাদ তথ্য সংরক্ষণ করতে হবে এনজিও এবং এনপিওগুলোকে। এসব ব্যক্তি বা সংস্থার সঙ্গে কোনো ধরনের লেনদেন করা যাবে না।

“যে কোনো অবৈধ লেনদেন প্রতিরোধের উদ্যোগ প্রশংসনীয়। কিন্তু সুইস ব্যাংকে বাংলাদেশীদের টাকা রাখার পরিমাণ প্রতি বছর বাড়ছে। সেই পাচার সরকার কীভাবে ঠেকাবে তা মানুষ আগে জানতে চায়,”  বেনারকে জানান ট্রিনিটি ডেভেলপার্সের অংশীদার আবদুল মতিন।


এনজিওগুলোর জন্য নতুন আইন আসছে

বেসরকারি সংস্থাগুলোর (এনজিও) নেওয়া বিদেশি অনুদানের স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে নতুন আইন প্রণয়ন করেছে সরকার। এনজিওবিষয়ক ব্যুরো এসব সংস্থার কার্যক্রম পরিদর্শন, পর্যবেক্ষণ ও মূল্যায়ন করবে।

মন্ত্রিসভায় এ-সংক্রান্ত বৈদেশিক অনুদান (স্বেচ্ছাসেবী কার্যক্রম) রেগুলেশন আইন, ২০১৪-এর খসড়ার চূড়ান্ত অনুমোদন হয়েছে, যা খুব শিঘ্রই সংসদে উঠবে।
আইন অনুযায়ী, এনজিও ব্যুরোর নিবন্ধন ছাড়া কোনো বেসরকারি সংস্থা কার্যক্রম চালাতে পারবে না। এ ছাড়া বেসরকারি সংস্থার বিভিন্ন কর্মসূচি বা প্রকল্প শুরুর আগে এনজিও ব্যুরোর অনুমোদন নিতে হবে। ব্যুরো সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের মতামত নিয়েই এ অনুমোদন দেবে।

পার্বত্য এলাকায় কোনো সংস্থা কাজ করতে চাইলে পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অনুমতি নিতে হবে।

নতুন আইনে প্রতিটি এনজিওর একটি মূল হিসাব (মাদার অ্যাকাউন্ট) থাকবে। ওই হিসাবে বৈদেশিক অনুদানের সব টাকা সংরক্ষণ করতে হবে। প্রতিবছর ওই হিসাব নিরীক্ষা করে প্রতিবেদন এবং বার্ষিক বিবরণী এনজিও ব্যুরোর কাছে জমা দিতে হবে।

বিদেশি অনুদান পাওয়া বেসরকারি সংস্থাগুলোর (এনজিও) জন্য আইনের যে খসড়া সরকার চূড়ান্ত করেছে, তা পর্যালোচনা করে এর সঙ্গে যুক্ত সংশ্লিষ্টদের  আশঙ্কা হচ্ছে, স্বেচ্ছাসেবী ও বেসরকারি সংস্থাগুলোর ওপর সরকার  নিয়ন্ত্রণ ও নজরদারি বাড়তে যাচ্ছে।

“আমরা আইনের পক্ষে, নিয়ন্ত্রণের বিপক্ষে। এমনিতেই বিদেশি অনুদানের পরিমাণ বাংলাদেশসহ বিশ্বজুড়ে কমছে। সেখানে এমন কিছু করা ঠিক হবে না,  যা বিদেশি অনুদানের প্রবাহ বাধাগ্রস্ত করে,”  বেনারকে জানান গণসাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক রাশেদা কে চৌধূরী ।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।