বাংলাদেশ থেকে হাজার কোটি টাকা পাচার, উদ্বেগজনক পরিসংখ্যান
2015.12.10

এ বছরের শুরুতেই সংবাদ সম্মেলন করে বাংলাদেশের বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) জানিয়েছিল, দেশে বিনিয়োগের বদলে উদ্বেগজনকভাবে অর্থ পাচার হচ্ছে। আর বছরের শেষভাগে তথ্য পরিসংখ্যান দিয়ে ওয়াশিংটনভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইনটিগ্রিটি (জিএফআই) সে কথারই পুনরাবৃত্তি করল।
তবে জিএফআই যে পরিসংখ্যান দিয়েছে তা রীতিমতো উদ্বেগজনক। প্রতিষ্ঠানটির হিসেবে বাংলাদেশ থেকে ২০১৩ সালে আরও ৯৬৬ কোটি ৬০ লাখ ডলার পাচার হয়েছে, যা টাকার অঙ্কে যা ৭৬ হাজার ৩৬১ কোটি ৪০ লাখ টাকা। পাচার হওয়া এই অর্থ আগের বছরের তুলনায় ৩৩ দশমিক ৭৯ শতাংশ বেশি।
তুলনামূলক বিশ্লেষণে দেখা গেছে, বাংলাদেশ থেকে পাচার হওয়া ওই অর্থ বাংলাদেশের ২০১৫-১৬ অর্থবছরের শিক্ষা, স্বাস্থ্য, পরিবহন, পল্লী উন্নয়ন, শিল্প ও ভৌত অবকাঠামো খাতের মোট উন্নয়ন বাজেটের সমান।
এ বছরের ৪ জানুয়ারি ‘বাংলাদেশ অর্থনীতি ২০১৪-১৫: অন্তর্বর্তীকালীন পর্যালোচনা’ শীর্ষক সংবাদ সম্মেলনে সিপিডি জানায়, দেশে বিনিয়োগ তো হচ্ছে না, উল্টো বিপুল পরিমাণ অর্থ পাচার হচ্ছে দেশ থেকে।
“দেশের অর্থ বিদেশে পাচার হচ্ছে বলে আমাদের প্রবল আশঙ্কা। বছরে এই পাচারের পরিমাণ বৈদেশিক সাহায্যের চেয়েও বেশি। এই অর্থই আবার বৈদেশিক বিনিয়োগ হিসেবে দেশে ফিরে আসছে বলে মনে হয়,” সংবাদ সম্মেলনে জানিয়েছিলেন সিপিডির সম্মানিত ফেলো দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য।
কয়েক বছর আগে আফ্রিকাতেও বিনিয়োগের নাম করে এ ধরনের চেষ্টা হয়েছে বলে সেসময় উল্লেখ করেন দেবপ্রিয়।
বছরের শেষভাগে ৮ ডিসেম্বর অর্থ পাচারের যে চিত্র জিএফআই তুলে ধরেছে তা সিপিডির বক্তব্যকে সমর্থন করে। সাত বছর ধরে উন্নয়নশীল দেশ থেকে কী পরিমাণ অর্থ অবৈধভাবে পাচার হয়, তা নিয়ে গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করে আসছে জিএফআই।
এর আগে ২০১৪ সালের জুনে ইউএনডিপি প্রকাশিত আরেক প্রতিবেদনে বলা হয়, স্বাধীনতার পর চার দশকে বাংলাদেশ থেকে পাচার হওয়া অর্থের পরিমাণ জিডিপির আকারের প্রায় ৩০ দশমিক ৪ শতাংশ। সে হিসাবে গত চার দশকে প্রায় ৩ লাখ কোটি টাকা পাচার হয়েছে।
“সব মিলিয়ে আমার ধারণা, দেশের ৬০ শতাংশ অর্থ বিদেশে পাচার হয়। মালয়েশিয়ায় সেকেন্ড হোম নির্মাণের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ দ্বিতীয় বৃহত্তম দেশ হিসেবে অবস্থান করে নিয়েছে,” বেনারকে জানান ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান ।
অর্থনীতিবিদেরা বলছেন, যাঁরা রাজনৈতিক প্রভাব–প্রতিপত্তির জোরে সম্পদের পাহাড় গড়েন, তাঁরাই সাধারণত টাকা পাচার করেন। এ ছাড়া শিল্পোদ্যোক্তা ও ব্যবসায়ীদের একটি অংশ নিজেদের পরিবার এবং সন্তানদের নিরাপত্তা বা নিশ্চয়তার জন্য বিভিন্নভাবে অর্থ বাইরে পাঠিয়ে দিচ্ছে।
“যেভাবে আমরা ব্যবসা, কারখানা ও সম্পদ এ দেশে গড়ে তুলেছি, আমাদের সন্তানেরা সেভাবে পারবে না বা গড়ে তোলা প্রতিষ্ঠান টিকিয়ে রাখতে সক্ষম হবে না,” বেনারের কাছে এমন আশঙ্কা প্রকাশ করেন নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন ব্যবসায়ী, যাঁর মালয়েশিয়ায় সেকেন্ড হোম ও সেখানে বিনিয়োগ রয়েছে।
বাংলাদেশ থেকে প্রতিবছরই উল্লেখযোগ্য পরিমাণ অর্থ পাচার হলেও ২০১৩ সালে এর পরিমাণ ছিল অনেক বেশি। এতে বেশি অর্থ পাচার হওয়া দেশের তালিকায় খারাপ অবস্থানে গেছে বাংলাদেশ।
২০১৪ সালে প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাংলাদেশ ছিল ১৪৫টি দেশের মধ্যে ৫১তম। আর এবার বাংলাদেশ ১৪৯টি দেশের মধ্যে হয়েছে ২৬তম।
সব মিলিয়ে ১০ বছরে বাংলাদেশ থেকে অর্থ পাচারের পরিমাণ ৫ হাজার ৫৮৭ কোটি ৭০ লাখ ডলার বা ৪ লাখ ৪১ হাজার ৪২৪ কোটি টাকা। এই অর্থ দিয়ে অন্তত দুই বছরের বাজেট তৈরি করতে পারত বাংলাদেশ। প্রতিবেদন অনুযায়ী, গড়ে প্রতিবছর বাংলাদেশ থেকে পাচার হয়েছে ৫৫৮ কোটি ৮০ লাখ ডলার।
সবচেয়ে বেশি অর্থ পাচার
এবার প্রতিবেদনের বিষয় ছিল ‘উন্নয়নশীল বিশ্ব থেকে অবৈধ অর্থের প্রবাহ ২০০৪-১৩’। এতে বলা হয়েছে, মূলত আমদানি-রপ্তানির সময়ে পণ্যের প্রকৃত মূল্য গোপন করার মাধ্যমেই সবচেয়ে বেশি অর্থ পাচার করা হয়েছে।
“দু–তিন বছর ধরেই দেখা যাচ্ছে, বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ পরিস্থিতি স্থবির। অর্থ পাচারের বড় কারণ হয়ে থাকতে পারে এটা,” বেনারকে জানান সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা এবি মির্জ্জা মো. আজিজুল ইসলাম।
তাঁর মতে, অর্থ পাচার রোধে অর্থ মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ ব্যাংক ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে সমন্বিতভাবে অনুসন্ধান করতে হবে।
এ বিষয়ে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) চেয়ারম্যান নজিবুর রহমান সাংবাদিকদের বলেছেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে এনবিআর নিবিড়ভাবে কাজ করছে। ইতিমধ্যে এ বিষয়ে একটি বিশেষ সেল খোলা হয়েছে।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা জানান, বাংলাদেশ শুরু থেকেই অবৈধ অর্থের প্রবাহ ঠেকানোর চেষ্টা করছে। এরই অংশ হিসেবে ২০০২ সালেই বাংলাদেশ ‘মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন’ প্রণয়ন করেছে। ২০০৮ সালে জঙ্গি অর্থায়ন প্রতিরোধে ‘সন্ত্রাসী অর্থায়ন কার্যক্রম প্রতিরোধ আইন’ প্রণয়ন করা হয়েছে।
তবে বিশিষ্টজনরা বলছেন, আইন করলেই হবে না, সুশাসন নিশ্চিত করতে হবে।
“টাকা পাচারের বিষয়টি অনেকাংশে সুশাসনের সঙ্গে জড়িত। সুশাসন না থাকায় মানুষের নিরাপত্তাহীনতা বাড়ছে,” জানান বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ।
প্রতি বছর পাচার বাড়ছে
জিএফআইয়ের গবেষণা প্রতিবেদনে ২০০৪ সাল থেকে অর্থ পাচারের হিসাব দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি অর্থ পাচার হয়েছে ২০১২ ও ২০১৩ সালে। যেমন ২০১২ সালে অর্থ পাচারের পরিমাণ ৭২২ কোটি ৫০ লাখ ডলার এবং ২০১৩ সালে ৯৬৬ কোটি ৬০ লাখ ডলার।
এ ছাড়া ২০০৪ সালে পাচার হয়েছিল ৩৩৪ কোটি ৭০ লাখ ডলার, ২০০৫ সালে ৪২৬ কোটি ২০ লাখ ডলার, ২০০৬ সালে ৩৩৭ কোটি ৮০ লাখ ডলার, ২০০৭ সালে ৪০৯ কোটি ৮০ লাখ ডলার, ২০০৮ সালে ৬৪৪ কোটি ৩০ লাখ ডলার, ২০০৯ সালে ৬১২ কোটি ৭০ লাখ ডলার, ২০১০ সালে ৫৪০ কোটি ৯০ লাখ ডলার এবং ২০১১ সালে পাচার হয় ৫৯২ কোটি ১০ লাখ ডলার।
জিএফআইয়ের প্রধান অর্থনীতিবিদ ডেভ কার ও অর্থনীতিবিদ জোসেফ স্পানজারস বরাবরের মতো এই গবেষণা প্রতিবেদনটি তৈরি করেছেন, যিনি এর আগে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) অর্থনীতিবিদ ছিলেন।
তাঁরা বিভিন্ন দেশের লেনদেনের ভারসাম্য ও আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করেছেন। আর এসব পরিসংখ্যানের উৎস হচ্ছে আইএমএফ। গবেষণায় আর্থিক সহায়তা দিয়েছে ফিনল্যান্ড সরকার।
গবেষণায় মূলত দুভাবে অর্থ পাচারের কথা বলা হয়েছে। এর মধ্যে ট্রেড মিসইনভয়েসিং বা আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে চালানের গরমিলের মাধ্যমেই বেশি পরিমাণ অর্থ উন্নয়নশীল দেশগুলো থেকে পাচার হয়ে যাচ্ছে। অর্থাৎ পণ্য আমদানি-রপ্তানির চালানে প্রকৃত মূল্য আড়াল করে কমবেশি দেখিয়ে একদিকে কর ফাঁকি দেওয়া হয়েছে, অন্যদিকে মোটা অঙ্কের অর্থ দেশে না এনে বাইরেই রেখে দেওয়া হয়েছে।
অপরটি হলো আন্তর্জাতিক লেনদেনে গরমিল, তবে এর মধ্যে ভুয়া চালান দেখিয়েই অর্থের ৮৩ শতাংশ পাচার করা হয়েছে।
বাংলাদেশ থেকেও দুভাবে অর্থ পাচার হয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি অর্থ পাচার করা হয় আমদানি-রপ্তানিতে পণ্যের প্রকৃত মূল্য আড়াল করার মাধ্যমে। যেমন গত ১০ বছরে এভাবে পাচার করা অর্থের পরিমাণ ৪ হাজার ৯১৩ কোটি ২০ লাখ ডলার।
ড. সালেহউদ্দিন আহমেদের মতে, বাংলাদেশে দুর্নীতি ও অর্থ পাচার বেড়ে যাওয়া পরস্পর সামঞ্জস্যপূর্ণ। সাধারণত ক্ষমতার কাছাকাছি থাকা লোকজন দুর্নীতি, আর্থিক কেলেঙ্কারি ইত্যাদির সঙ্গে জড়িত থাকে। আর নিরাপদ ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে নির্বাচনের আগে এসব অর্থ বিদেশে পাচার করে; যার চিত্র জিএফআইয়ের প্রতিবেদনে উঠে এসেছে।