রাজনীতিতে ব্যবসায়ীদের সংখ্যা বাড়ছে, সুষ্ঠু রাজনৈতিক চর্চা নেই
2016.02.03

তৃণমূল থেকে রাজধানী, রাজনৈতিক দলের ইউনিয়ন পর্যায় থেকে কেন্দ্রীয় কমিটি—কোথাও রাজনৈতিক কর্মসূচি ও গণতন্ত্রের সুষ্ঠু চর্চা নেই। এই পরিস্থিতিতে দেশ রাজনৈতিক শূন্যতার মধ্যে পড়বে বলে বিশেষজ্ঞরা শঙ্কা প্রকাশ করছেন।
স্থানীয় পর্যায়ে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, দেশের জেলা বা উপজেলা পর্যায়ের রাজনীতি ‘সংবর্ধনানির্ভর’ বা ‘কমিটিনির্ভর’ হয়ে পড়েছে। গত দুই বছরে তৃণমূলে রাজনৈতিক সভা–সমাবেশের ঘটনা অতীতের যে কোনো সময়ের তুলনায় কমে গেছে।
তৃণমূলে সুষ্ঠু রাজনীতির চর্চা যেমন নেই, তেমনি কলেজ–বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্ররাজনীতির বন্ধ্যা অবস্থা চলছে। ১৯৯০ সালের পর থেকে ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী ও জাহাঙ্গীরনগরসহ কোনো বড় বিশ্ববিদ্যালয় বা কলেজে ছাত্রসংসদ নির্বাচন হয়নি।
রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ছাত্র রাজনীতি বা তৃণমূলের রাজনীতি থেকে জাতীয় রাজনীতিতে উঠে আসার সিঁড়ি না থাকায় দেশের রাজনীতি ক্রমাগত ব্যবসায়ীদের হাতে চলে যাচ্ছে।
জাতীয় সংসদ সচিবালয়ের তথ্য বলছে, দশম জাতীয় সংসদের ৩০০ সাংসদের মধ্যে ২০৬ জনের পেশাই ব্যবসা। এই তথ্য প্রকাশ হওয়ার পর রাজনীতির ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করছেন রাজনীতিবিদ ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের অনেকেই।
তাঁরা বলছেন, তৃণমূল বা উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে রাজনীতিবিদ তৈরির প্রক্রিয়া থেমে যাওয়ায় জাতীয় রাজনীতিতে ব্যবসায়ীদের অংশগ্রহণ ও দাপট ক্রমাগত বাড়ছে। তা ছাড়া রাজনীতি করার জন্য যে পরিমাণ টাকা ও পেশিশক্তির দরকার হয় তা অনেক রাজনীতিবিদেরই নেই।
“রাজনীতিকদের পিঠে বন্দুক রেখে ব্যবসায়ীদের অনেকেই এ পেশায় ঢুকে পড়ছেন। ফলে জনসেবা নয়, রাজনীতিই এখন সবচেয়ে বড় ব্যবসা হয়ে উঠেছে,” বেনারকে জানান সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী শাহদীন মালিক।
ওই আইনজীবী বলেন, ছোট ব্যবসায়ীরা কিন্তু রাজনীতিতে আসছেন না। বড় ব্যবসায়ীরাই রাজনীতিতে আসছেন। অর্থাৎ রাজনীতি ব্যবসায় পরিণত হওয়ায় ব্যবসায়ীরাই এখন এর প্রতি আকর্ষণ বোধ করছেন।
৬৯ শতাংশ এমপির পেশা ব্যবসা
জাতীয় সংসদ সচিবালয়কে এমপিদের দেওয়া তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা যায়, বর্তমান দশম সংসদে ব্যবসায়ী এমপির হার ৬৯ শতাংশ। স্বাধীনতার পর ১৯৭৩ সালে এমপিদের মধ্যে ব্যবসায়ীর এই হার ১৫ শতাংশ ছিল। মুক্তিযুদ্ধের আগে ১৯৫৪ সালে এমপিদের মধ্যে ব্যবসায়ীর সংখ্যা ছিল মাত্র ৪ শতাংশ।
সংসদ সচিবালয়ের সাম্প্রতিক তথ্য হচ্ছে, ১৯৭৯ সালে সংসদে ব্যবসায়ীর সংখ্যা ছিল ৩৫ শতাংশ। ১৯৯৬ সালে ৪৮ শতাংশ, ২০০১ সালে ৫১ শতাংশ এবং ২০০৮ সালে ৬৩ শতাংশ এমপি ছিলেন ব্যবসায়ী।
এদিকে দশম সংসদে ব্যবসায়ী ২১৪ জন এমপির মধ্যে আওয়ামী লীগেরই ১৭০ জন, জাতীয় পার্টির ২৪ জন, স্বতন্ত্র ১৪ জন এবং জাসদ, তরিকত ফেডারেশন, ওয়ার্কার্স পার্টি ও জেপি মিলিয়ে ৬ জন। মোট ৯ জন এমপির পেশার বিষয়ে কোনো ঘোষণা দেওয়া হয়নি সংসদ সচিবালয়ের কাছে। অবশ্য এ সংখ্যা আরও বেশিও হতে পারে।
গত বছরের ৫ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রধান বিরোধী দল বিএনপি নির্বাচন বয়কট করে। ওই দলটি অংশ নিলেও ব্যবসায়ী এমপির সংখ্যায় তেমন একটা হেরফের হতো না বলে মত দিয়েছেন রাজনৈতিক বিশেজ্ঞরা।
দ্বিতীয় সর্বোচ্চ অবস্থানে আছে আইনজীবী এবং এই সংখ্যা ৩০০ জনের মধ্যে ৪৮ জন। পেশা হিসেবে রাজনীতির কথা উল্লেখ করেছেন মাত্র ২২ জন। এ ছাড়া স্বল্পসংখ্যক সদস্যের পেশা কৃষি, শিক্ষকতা ও চিকিৎসা। কয়েকজন অবসরপ্রাপ্ত সামরিক ও বেসামরিক কর্মকর্তাও এমপি হয়েছেন।
“একজন সাংসদ ব্যবসায়ী হলে তিনি অনেক সময় জনগণের স্বার্থের চেয়ে তার ব্যক্তিগত বা ব্যবসায়িক স্বার্থকে বেশি প্রাধান্য দেন। ফলে রাষ্ট্রীয় সম্পদের বণ্টন যথাযথভাবে হয় না,” বেনারকে জানান সুশাসনের জন্য নাগরিক-সুজনের সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার।
তিনি বলেন, আদর্শ ও সৎ চিন্তার চর্চা করা মানুষগুলো এখন আর রাজনীতিতে আসছেন না। স্থানীয় সরকারের নির্বাচন দলীয় প্রতীকে অনুষ্ঠিত করার সিদ্ধান্তে নির্দলীয়, সৎ ও যোগ্যদের জনপ্রতিনিধি হওয়ার সুযোগ অনেকটাই সংকুচিত হয়েছে।
অন্য দেশের দৃষ্টান্ত
ওয়েবসাইটে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, যুক্তরাষ্ট্রে মার্কিন কংগ্রেসের সদস্যদের মধ্যে ৩৮ শতাংশ ব্যবসার সঙ্গে জড়িত, ব্রিটিশ পার্লামেন্ট হাউস অব কমন্সে এই হার ২৫ শতাংশ।
প্রতিবেশী ভারতের রাজনীতি বাংলাদেশের থেকে গুণগতভাবে খুব একটা এগিয়ে না থাকলেও সেখানে লোকসভায় মাত্র ২০ শতাংশ ব্যবসায়ী এমপি রয়েছেন। সেখানে সর্বোচ্চ ২৭ শতাংশ এমপি কৃষি এবং ২৪ শতাংশ রাজনীতিকে পেশা হিসেবে দেখিয়েছেন।
কোটিপতি এমপি
বাংলাদেশে রীতিমতো কোটিপতি এমপির ছড়াছড়ি। সুশাসনের জন্য নাগরিক-সুজনের একটি গবেষণা অনুসারে, দশম সংসদের ২২৬ জন অর্থাৎ ৬৫ শতাংশ এমপির কোটি টাকার ওপরে সম্পদ রয়েছে। এর মধ্যে আওয়ামী লীগের ১৯৪ জন এমপি অর্থাৎ ৭১ শতাংশই কোটিপতি।
এ ছাড়া জাতীয় পার্টির ১৮ জন বা ৪৫ শতাংশ এমপির কোটি টাকার ওপরে সম্পদ রয়েছে। জাসদের ৬ জন এবং ওয়ার্কার্স পার্টির একজন এমপি কোটিপতি।
তরিকত ফেডারেশনের দুই এমপির দুজনই কোটিপতি। স্বতন্ত্র এমপিদের মধ্যে ৮ জন কোটিপতি আছেন।
“অর্থ-প্রতিপত্তির জন্য রাজনৈতিক নেতৃত্ব রাজনীতির কথা না ভেবে ব্যবসায়ীদের দলীয় মনোনয়ন দিচ্ছেন। এর বড় কারণ নির্বাচনে জয়ের জন্য এখন টাকা অপরিহার্য হয়ে উঠেছে। আবার দলীয় কর্মকাণ্ডের জন্য সারা বছরই ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে টাকা নিচ্ছে রাজনৈতিক দলগুলো,” জানান প্রবীণ বাম রাজনীতিবিদ পঙ্কজ ভট্টাচার্য।
তিনি বলেন, তৃণমূলে এখন রাজনীতির চর্চা নেই। মন্ত্রী–এমপিদের সংবর্ধনা সভা হয়, কিন্তু রাজনৈতিক সভা–সমাবেশ হয় না। রাজনীতির এমন দৈন্য গত ৫০ বছরেও ছিল না।