নূর হোসেনকে জেলে প্রেরণ, এলাকায় ক্ষোভ–বিক্ষোভ

ঢাকা থেকে শাহরিয়ার শরীফ
2015.11.13
BD-nurhossain ৭ খুনের আসামি নূর হোসেনকে আদালতে নিয়ে আসা হলে উপস্থিত জনতা ক্ষোভে ফেটে পড়ে। ১৩ নভেম্বর,২০১৫
বেনার নিউজ

নারায়ণগঞ্জের চাঞ্চল্যকর সাত খুনের মামলার প্রধান আসামি নূর হোসেনকে গতকাল শুক্রবার কড়া নিরাপত্তার মধ্যে যখন আদালতে নেওয়া হয়, সে সময় তার ফাঁসি ও জিজ্ঞাসাবাদের দাবিতে বাইরে বিক্ষোভ করছিলেন কয়েক হাজার মানুষ। ২২ মামলার আসামি ও চাঞ্চল্যকর সাত খুনের প্রধান আসামি নূর হোসেন তখন মৃদু হাসছিলেন।

গত বৃহস্পতিবার প্রায় মধ্যরাতে ভারত থেকে বাংলাদেশে আনা হয় ওই ঘাতককে। শুক্রবার তাঁকে নারায়ণগঞ্জের আদালতে হাজির করা হয়। আদালত খুব দ্রুত শুনানি শেষে তাকে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন।

সিদ্ধিরগঞ্জ থানা আওয়ামী লীগের সাবেক সহ সভাপতি নূর হোসেনকে ১১ মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হয়। তার জামিনের জন্যও আবেদন করেননি কোনো আইনজীবী।

“আদালতের আদেশের পর তাকে নারায়ণগঞ্জ থেকে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে নিয়ে আসা হয়,” বেনারকে জানান জ্যেষ্ঠ জেল সুপার জাহাঙ্গীর কবীর।

নূর হোসেনকে হাজির করার পর গতকাল আদালত চত্বরে ছিল গণমাধ্যম কর্মীদের প্রস্তুতি ও হইচই। ভিড় সামাল দিতে আসা পুলিশ সদস্যরা হিমশিম খায়। ফাঁসির দাবিতে নিহতদের স্বজনরা মিছিল করেন। ট্রাকের হেলপার থেকে জেলার অন্যতম প্রভাবশালী বনে যাওয়া নূর হোসেনকে দেখার কৌতূহল ছিল অনেকের।

আইনজীবী, স্বজনসহ সবাই চান সাত খুনের ঘটনার পরিকল্পনাকারী ও অর্থদাতাদের চিহ্নিত করতে নূর হোসেনকে জিজ্ঞাসাবাদ করা প্রয়োজন। তবে পুলিশ বলছে, তদন্ত শেষে অভিযোগপত্র দেওয়ায় এ মামলায় তাঁকে রিমান্ডে নেওয়ার সুযোগ নেই।


প্রতিক্রিয়া

তবে আইনজীবীরা পুলিশের এই বক্তব্যের সঙ্গে একমত নন। তাঁরা বলছেন, নূর হোসেনের অর্থ ও মদদদাতারা প্রভাবশালী। তাঁকে জিজ্ঞাসাবাদ করলে কেঁচো খুঁড়তে সাপ বের হতে পারে।

“নূর হোসেনকে রিমান্ডের নেওয়ার সুযোগ ছিল। রাষ্ট্রপক্ষ ও মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা চাইলে রিমান্ডে এনে জিজ্ঞাসাবাদ করতে পারে। বাংলাদেশে এ রকম অনেক নজির রয়েছে,” জানান একটি মামলার বাদী পক্ষের আইনজীবী সাখাওয়াত হোসেন।

আদালতের কাঠগড়ায় ওঠার পরে নূর হোসেন মাথার হেলমেট খোলেন। মোট নয় মিনিট আদালতের কার্যক্রম চলে। এ সময় নূর হোসেনকে চিন্তিত দেখাচ্ছিল না।

সাত খুনের ঘটনায় নিহত কাউন্সিলর নজরুল ইসলামসহ অন্যদের স্বজনরাও সকাল থেকে অপেক্ষায় ছিলেন আদালত চত্বরে। তাদের প্রত্যাশা ছিল, রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদের মাধ্যমে নূর হোসেনের মুখ থেকেই সাত খুনের পেছনে ‘আসল ঘটনা’ উদ্ঘাটন করা হোক।

“নূর হোসেনকে দেশে ফিরিয়ে আনার সঙ্গে সঙ্গেই তার সহযোগীরাও এলাকায় ফিরে আসতে শুরু করেছে।
তারা সংঘবদ্ধ হয়ে হুমকি ধামকি দিচ্ছে। আমাদের লোকজনদের মারধর করছে। আমরা এখন নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছি,” আদালত প্রাঙ্গণে সাংবাদিকদের জানান নিহত কাউন্সিলর নজরুল ইসলামের স্ত্রী সেলিনা ইসলাম বিউটি।

বিউটি বলেন, “আমরা চাই  নূর হোসেনকে রিমান্ডে এনে জিজ্ঞাসাবাদ করা হোক । এই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে আর কারা জড়িত? কারা পরিকল্পনাকারী, কারা অর্থের জোগানদাতা? র‍্যাব কেন আমার স্বামীসহ সাতজনকে নৃশংসভাবে হত্যা করবে?”


ঘটনার বিবরন

২০১৪ সালের ২৭ এপ্রিল ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ লিংকরোডের ফতুল্লার লামাপাড়া থেকে কাউন্সিলর নজরুল ইসলাম, আইনজীবী চন্দন সরকারসহ ৭ জনকে অপহরণ করা হয়। তিন দিন পর শীতলক্ষ্যা নদীতে তাদের লাশ পাওয়া যায়।

নজরুলের শ্বশুর শহীদুল ইসলাম সে সময় অভিযোগ করেন, র‍্যাবকে ৬ কোটি টাকা দিয়ে ৪ নম্বর ওয়ার্ডর কাউন্সিলর নূর হোসেন ওই হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছেন। পরে র‍্যাবের অভ্যন্তরীণ তদন্তেও তার সত্যতা পাওয়া যায়।

হত্যাকাণ্ডের প্রায় এক বছর পর গত ৮ এপ্রিল নূর হোসেন এবং র‍্যাবের সাবেক তিন কর্মকর্তাসহ ৩৫ জনের বিরুদ্ধে নারায়ণগঞ্জের আদালতে অভিযোগপত্র দেয় পুলিশ।

হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে নিজের সংশ্লিষ্টতা অস্বীকার করেন নূর হোসেন। একপর্যায়ে নিরুদ্দেশ হন সিদ্ধিরগঞ্জ আওয়ামী লীগের এই নেতা।

এরপর ২০১৪ সালের ১৪ জুন কলকাতার দমদম বিমানবন্দরের কাছে কৈখালি এলাকার একটি বাড়ি থেকে দুই সহযোগীসহ তাকে গ্রেপ্তার করে পশ্চিমবঙ্গ পুলিশ। তার বিরুদ্ধে ভারতীয় আদালতে পাসপোর্ট আইনে মামলাও হয়।

শেষ পর্যন্ত দুই সরকারের মতৈক্যে ভারত গত অক্টোবরে ওই মামলা তুলে নেয় এবং আদালত নূর হোসেনকে বাংলাদেশে ফেরত পাঠানোর অনুমতি দেয়।


যেভাবে আনা হলো

বাংলাদেশ উলফা নেতা অনুপ চেটিয়াকে ফেরত দেওয়ার এক দিনের মধ্যে বৃহস্পতিবার মধ্যরাতে যশোরের বেনাপোল স্থল বন্দরে তাকে বাংলাদেশি কর্তৃপক্ষের কাছে হস্তান্তর করে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী। এরপর র‍্যাব হেফাজতে তাকে শুক্রবার সকাল পৌনে ৭টার দিকে নিয়ে আসা হয় ঢাকার উত্তরায়, র‍্যাব সদর দপ্তরে।

সেখানে স্বাস্থ্য পরীক্ষার পর নূর হোসেনকে সাত খুনের মামলার তদন্ত কর্মকর্তা মামুনুর রশিদের কাছে হস্তান্তর করে র‍্যাব। এরপর সকাল সোয়া ৮টার দিকে পুলিশ তাকে নিয়ে নারায়ণগঞ্জ পুলিশ লাইনসে পৌঁছায়।

নূর হোসেনকে তার নিজের এলাকায় ফিরিয়ে আনার আগেই শহরজুড়ে নেওয়া হয় ব্যাপক নিরাপত্তা।

“আমার ছেলেকে ফিরে পাব না। কিন্তু আমি ইব্রাহিমসহ সাতজনকে খুনের ঘটনার সুষ্ঠু বিচার চাই। আমি চাই, যারা খুন করেছে আমার ছেলেকে, নূর হোসেন তাদের নাম বলে দিক,” বেনারকে জানান নিহত আইনজীবী চন্দন সরকারের গাড়ির চালক ইব্রাহিমের বাবা আব্দুল ওহাব।

উল্লেখ্য, সাত খুনের মামলায় র‍্যাবের সাবেক তিন কর্মকর্তা তারেক সাঈদ মোহাম্মদ, আরিফ হোসেন ও এম এম রানাসহ ২২ জন কারাগারে রয়েছে। পলাতক রয়েছেন র‍্যাবের ৮ সদস্যসহ ১৩ আসামি।


প্রশ্ন উঠেছে

এদিকে অনুপ চেটিয়াকে ভারতের কাছে ফেরত ও নূর হোসেনকে ভারত থেকে বাংলাদেশে ফেরত আনার প্রক্রিয়াটির স্বচ্ছতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।

“অনুপ চেটিয়াকে কোন আইনে কিভাবে ভারতীয় কর্তৃপক্ষের কাছে হস্তান্তর করা হল এবং নূর হোসেনকে কীভাবে আনা হলো সরকারকে তার পূর্ণাঙ্গ ব্যাখ্যা দিতে হবে। বাংলাদেশের জাতীয় নিরাপত্তার জন্যই এই বিষয়ে পরিষ্কার ব্যাখ্যা থাকা প্রয়োজন,” বেনারকে জানান বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক।


মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।