ক্ষোভ আর চ্যালেঞ্জ নিয়ে পদ্মা সেতুর কাজ চলছে, ব্যয় বেড়েছে অনেক

ঢাকা থেকে শাহরিয়ার শরীফ
2015.05.20
BD-padma পদ্মা সেতুর কাজ চলছে। মে,২০১৫
বেনার নিউজ

সরকারি টাকায় পদ্মা সেতু প্রকল্পের কাজের অগ্রগতি এখন পর্যন্ত ১৮ শতাংশ। এরই মধ্যে প্রকল্পের ব্যয় বেড়ে যাচ্ছে প্রায় ৮ হাজার ৩০০ কোটি টাকা (১.৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার)। অর্থাৎ এই সেতুর ব্যয় বেড়ে এখন দাঁড়াল ২৮ হাজার ৭৯৩ কোটি টাকা বা ৩.৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলার।

দুর্নীতির অভিযোগ তুলে বিশ্বব্যাংক সরে যাওয়ার পর নিজেদেরে টাকায় দেশের সবচেয়ে বড় ও আলোচিত এ প্রকল্প বাস্তবায়নের সিদ্ধান্ত নেয় সরকার।তহবিল প্রত্যাহার করায় ক্ষোভ এবং এটা নির্মাণ করার চ্যালেঞ্জ নিয়ে এগোচ্ছে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন সরকার।

পদ্মা সেতুর মূল প্রকল্প প্রস্তাব অনুমোদন হয়েছিল ২০০৭ সালে। তখন ব্যয় ধরা হয়েছিল ১০ হাজার ১৬১ কোটি টাকা বা ১.৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। বিশ্বব্যাংকের নেতৃত্বে দাতারা এই সেতু নির্মাণে সম্মত হলে ২০১১ সালে প্রকল্প প্রস্তাব সংশোধন হয়।

তখন এই প্রকল্পে ব্যয় ধরা হয়েছিল প্রায় ২০ হাজার ৫০৭ কোটি টাকা (২.৬৩ বিলিয়ন ডলার), এর মধ্যে বিশ্বব্যাংকের নেতৃত্বে প্রকল্প সাহায্য ছিল ১৬ হাজার ২৫০ কোটি টাকা। কিন্তু দুর্নীতির অভিযোগ তুলে বিশ্বব্যাংক পদ্মাসেতুর জন্য বরাদ্দ করা তহবিল ২০১২ সালে প্রত্যাহার করে।

প্রায় দুবছর পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত ৬ মে পদ্মাসেতু নির্মাণ থেকে বিশ্বব্যাংকের সরে যাওয়ার জন্য সাবেক মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটন ও নোবেল শান্তি পুরস্কার বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে দায়ী করে প্রকাশ্য বক্তব্য রেখেছেন। এক অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী বলেন, পদ্মাসেতু নিয়ে বিশ্বব্যাংক যে সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, তা ওই সংস্থার নিজস্ব সিদ্ধান্ত ছিল না।

তাঁর মতে, ড. ইউনূস মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে দিয়ে বিশ্বব্যাংকে ফোন করিয়ে পদ্মাসেতুর তহবিল প্রত্যাহার করেন। অবশ্য ইউনূস সেন্টার এক বিবৃতিতে দাবি করেছে, প্রধানমন্ত্রীর ওই বক্তব্য সঠিক নয়।
প্রধানমন্ত্রী এ বক্তব্য দেওয়ার একদিন পর ৭ মে পরিকল্পনামন্ত্রী মুস্তফা কামাল বলেন, “পদ্মাসেতু হলে উনার (ড. ইউনূস) কি ক্ষতি হতো? এ প্রকল্পে ঋণ বাতিলের জন্য কেউ না কেউ কলকাঠি নেড়েছেন। তাই আমি বলব, ইউনূসের উচিত হবে, তার অবস্থান স্পষ্ট করা।”
এর আগে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতও পদ্মাসেতু না হওয়ায় ড. ইউনূসের সমালোচনা করেন।

বিশ্বব্যাংকসহ দাতাদের সঙ্গে অর্থায়ন নিয়ে জটিলতার পর ২০১২ সালে নিজস্ব অর্থায়নে সেতু নির্মাণের উদ্যোগ নেয় সরকার। প্রথমে কাজ শেষ হওয়ার কথা ছিল ২০১৫ সালের ডিসেম্বরে। এখন প্রকল্পের মেয়াদ ধরা হয়েছে ২০১৯ সাল পর্যন্ত। তবে সেতু মন্ত্রী বলছেন, ২০১৮ সালের মধ্যে পদ্মা সেতু চালু হবে।

পদ্মা সেতুর নির্মাণকাজে ব্যয় বৃদ্ধির কথা স্বীকার করেন সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। তবে তিনি বলেন,  ব্যায় বাড়লেও সেতু নির্মাণ নির্ধারিত সময়ের মধ্যে হবে।

“ডলারের দাম বৃদ্ধি পাওয়ায় পদ্মা সেতুর নির্মাণ কাজে ২৩ দশমিক পাঁচ শতাংশ ব্যয় বৃদ্ধি পেয়েছে। আগে ডলারের মূল্য ছিল ৬৯ টাকা, কিন্তু এখন তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৭৮ টাকায়,” গত ১১ মে এ প্রতিবেদককে জানান মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের।  

মন্ত্রী বলেন, পদ্মা নদীর তীর রক্ষা কাজ, মাওয়া ফেরিঘাট স্থানান্তর ও নতুন ফেরিঘাটের সংযোগ সড়ক বেড়ে যাওয়ায় নির্মাণ ব্যয় বৃদ্ধি পাচ্ছে।

গত এপ্রিলের মাঝামাঝি সরেজমিনে মুন্সিগঞ্জের মাওয়া, শরীয়তপুরের জাজিরা ও মাদারীপুরের শিবচরে গিয়ে পদ্মা সেতু প্রকল্পের বিশাল কর্মযজ্ঞ দেখা যায়। নদীর দুই তীরে প্রায় ১৪ কিলোমিটারজুড়ে নদীশাসন কাজ চলছে। অফিস ভবন, ল্যাবরেটরি, মসজিদ, স্বাস্থ্যকেন্দ্র, ডুপ্লেক্স ভবনের মোটেল, ওভারহেড পানির ট্যাংক, বিদ্যুতের সাবস্টেশন, গার্ডদের বাসস্থানসহ বিভিন্ন অবকাঠামো হয়েছে।

প্রকল্পসূত্র জানায়, মাওয়া ও জাজিরা প্রান্তে ১৪ কিলোমিটার সংযোগ সড়ক নির্মাণকাজের অগ্রগতি ৪২ শতাংশ। অবকাঠামো নির্মাণ এগিয়েছে ৩৩ শতাংশ।

মাওয়া ও জাজিরার মধ্যেই হবে ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার দীর্ঘ পদ্মা সেতু। দ্বিতলবিশিষ্ট এই সেতুর ওপর দিয়ে চলবে যানবাহন, নিচ দিয়ে যাবে রেল।  মাওয়া চৌরাস্তা বরাবর দিয়ে সেতুটি হবে।

সেতু বিভাগের পরিকল্পনা অনুযায়ী, আগামী অক্টোবরে শুরু হবে সেতুর মূল পাইলিংয়ের কাজ। আগামী বছর মে মাসে খুঁটির ওপর সেতুর স্প্যান বসানো শুরু হবে। এখন চলছে মূল সেতুর পরীক্ষামূলক পাইলিং।  

পদ্মা সেতুর কাজ মোটাদাগে পাঁচ ভাগে বিভক্ত। এগুলো হচ্ছে মূল সেতু, নদীশাসন, দুটি সংযোগ সড়ক ও অবকাঠামো (সার্ভিস এলাকা) নির্মাণ। এর বাইরে আছে জমি অধিগ্রহণ ও পুনর্বাসন।

এ পর্যন্ত যে অগ্রগতি হয়েছে, এর বেশির ভাগজুড়েই রয়েছে ভূমি অধিগ্রহণ, পুনর্বাসন, সংযোগ সড়ক ও অবকাঠামো। এর মধ্যে মূল সেতুর জন্য চীনের চায়না মেজর ব্রিজ ইঞ্জিনিয়ারিং করপোরেশনকে (এমবিইসি) ১২ হাজার ১৩৩ কোটি টাকায় নিয়োগ দেওয়া হয় গত বছর জুনে। নিয়োগের পরই মূল চুক্তির ১৫ শতাংশ অর্থ দেওয়া হয় ঠিকাদারকে।

গত বছরের নভেম্বরে ৮ হাজার ৭০৭ কোটি টাকায় নদীশাসনের কাজ পায় চীনেরই সিনোহাইড্রো করপোরেশন। দুটি সংযোগ সড়ক ও অবকাঠামো নির্মাণকাজ পায় বাংলাদেশের আবদুল মোনেম লিমিটেড। চুক্তি হয় ২০১৩ সালের শেষের দিকে।  

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নির্ধারিত সময়ে কাজ শেষ করতে হলে বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হবে। প্রথমত, সব যন্ত্রপাতি ও মালামাল সময়মতো পৌঁছাতে হবে। আর নকশায় যে গভীরতায় পাইলিং করার কথা বলা হয়েছে, তা মিলতে হবে। এর ব্যতিক্রম হলে প্রকল্পের কাজও পিছিয়ে যাবে।  

সেতু বিভাগের হিসাবে, গত এপ্রিল পর্যন্ত মূল সেতুর কাজের অগ্রগতি হয়েছে ৭.৮৩ শতাংশ। নদীশাসনের কাজ একেবারেই প্রাথমিক পর্যায়ে। বার্জে করে বালুভর্তি বস্তা নদীতে ফেলা হচ্ছে।

“তবে আগামী বছরই মূল সেতু দৃশ্যমান করা যাবে,” সাংবাদিকদের জানান পদ্মা সেতু প্রকল্পের পরিচালক শফিকুল ইসলাম।

তবে স্বপ্নের পদ্মা সেতু নতুন কী সুযোগের সৃষ্টি করবে—সে সম্পর্কে পদ্মাপারের অনেকেই নিশ্চিত নন। তবে বাড়ছে জমির দাম।

“জমির দাম বেড়ে এর মধ্যে প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে। আবাসন কোম্পানি বেশ তৎপর।একসঙ্গে অনেক জমি কেনার জন্য বিত্তবান ও ব্যবসায়ীরা ঘোরাঘুরি করছেন,” বেনারকে জানান বাগেরহাটের ফলতিতা এলাকায় জমি কেনাবেচার সঙ্গে জড়িত স্থানীয় যুবক ইয়ার আলী(৩৮)।

তিনি জানান, এখন ঢাকা-মাওয়া মহাসড়কের কাছে জমির কদর ও দাম বেড়েছে।

“সেতুর জন্য সরকার জমি অধিগ্রহণ শুরু করার পর থেকেই জমির দাম বেড়েছে,” জানান মাদারীপুরের শিবচর উপজেলার বাখরেরকান্দি পদ্মা সেতু পুনর্বাসন কেন্দ্রের বাসিন্দা আবদুল আজিজ হাওলাদার।

পদ্মা সেতুর প্রভাব নিয়ে সরকারের করা সম্ভাব্যতা জরিপের তথ্য হচ্ছে, শুধু যোগাযোগেই নয়, জাতীয় ও আঞ্চলিক অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নতিতে সেতুটি বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখবে। এ মহাপ্রকল্পের যৌক্তিকতা নিয়ে ওই গবেষণায় দাবি করা হয়, সেতুটি নির্মিত হলে দেশের জিডিপি ১ দশমিক ২ শতাংশ বৃদ্ধি পাবে। ওই অঞ্চলের মানুষের আয় ১ দশমিক ৪ শতাংশ বাড়বে। আর ৭ লাখ ৪৩ হাজার মানুষের নতুন কর্মসংস্থান হবে।

তবে পদ্মা সেতু হলে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল ও জাতীয় অর্থনীতি কীভাবে লাভবান হবে, এ প্রশ্নের জবাবে পিপলস পাওয়ার পার্টিসিপেশন ট্রাস্টের (পিপিআরসি) নির্বাহী পরিচালক হোসেন জিল্লুর রহমান বলেন, “আগে ব্যবসা-বাণিজ্য, শিল্পায়ন ও স্থানীয় লোকজনের উন্নতির জন্য বিভিন্ন উদ্যোগ নিতে হবে। শুধু একটি সেতু সেখানকার অর্থনৈতিক উন্নতিতে তেমন ভূমিকা রাখবে না।

দৃষ্টান্ত হিসেবে ড. হোসেন জিল্লুর বলেন, যমুনা সেতুর আগে থেকেই বগুড়া শিল্পাঞ্চল ছিল। উত্তরবঙ্গ কৃষি সমৃদ্ধ ছিল। এ কারণে সেতু হওয়ার পরপরই কিছু সুফল পাওয়া গিয়েছিল। তারপরও অবকাঠামোর অভাবে সেখানে শিল্পায়ন স্থবির হয়েছে।

“আর পদ্মা সেতুর ক্ষেত্রে চিত্রটি ঠিক উল্টো। দক্ষিণাঞ্চল শিল্প বা কৃষি—কোনোটিতেই সমৃদ্ধ নয়,” জানান অর্থনীতিবিদ হোসেন জিল্লুর।

রেল নিয়ে অনিশ্চয়তা: অর্থায়ন নিশ্চিত না হওয়ায় পদ্মা সেতুর ওপর দিয়ে শুরু থেকেই রেল চালু করার বিষয়ে অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে। পদ্মা সেতুর দুই পারে ১৬০ কিলোমিটার রেলপথ নির্মাণের প্রকল্প রেলপথ মন্ত্রণালয়ের। এর জন্য প্রয়োজন প্রায় ২৫ হাজার কোটি টাকা। এখনো এই অর্থের সংস্থান হয়নি। সরকার চীনা অর্থায়নের জন্য দৌড়ঝাঁপ করছে।

পদ্মার দুই পারে ১৬০ কিলোমিটার রেলপথের মধ্যে ঢাকার গেন্ডারিয়া থেকে কেরানীগঞ্জ হয়ে ভাঙ্গা পর্যন্ত ৮২ দশমিক ৩২ কিলোমিটার। আর ভাঙ্গা থেকে যশোর পর্যন্ত ৭৭ দশমিক ৬ কিলোমিটার। অস্ট্রেলিয়াভিত্তিক পরামর্শক প্রতিষ্ঠান স্ম্যাককে দিয়ে সম্ভাব্যতা যাচাই ও রেলপথ ঠিক করে জমি চিহ্নিতও করা হয়েছে।  

“সরকার প্রথম দিন থেকেই রেল চালুর বিষয়টি অগ্রাধিকারে রেখেছে। আমরা আশা করছি, চীনের অর্থ পাওয়া যাবে এবং আগামী বছরই রেলের কাজ শুরু করা যাবে,” বেনারকে জানান এই প্রকল্পের রেলের পরিচালক সাগর কৃষ্ণ চক্রবর্তী।


মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।