শেরে বাংলা নগর সম্প্রসারণে বাধা লুই কানের মূল নকশা
2015.11.04

রাজধানী ঢাকার শেরে বাংলানগর, যেখানে অবস্থিত ঐতিহ্যবাহী স্থাপনা ও বাংলাদেশের জাতীয় সংসদ ভবন। গুরুত্বপূর্ণ এই এলাকাটির সংস্কার ও সম্প্রসারণের কাজ করছে সরকার। রমনায় অবস্থিত সচিবালয়ও এখানে স্থানান্তর করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। কিন্তু এ কাজে মূল বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে সংসদ ভবন কমপ্লেক্স ও আশপাশের এলাকা নিয়ে করা স্থপতি লুই আই কানের মূল নকশা।
সরকারি সূত্র বলছে, স্থপতি লুই আই কানের মূল নকশা না থাকায় শেরেবাংলা নগরে সচিবালয় স্থানান্তর প্রকল্পটি আটকে গেছে। প্রকল্পটির অনুমোদন না দিয়ে ফেরত পাঠিয়েছে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটি (একনেক) । মূল নকশাটি সংগ্রহ করে সে অনুযায়ী পরিকল্পনা প্রণয়নের নির্দেশনা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এদিকে লুই কানের মহাপরিকল্পনাটি দাখিলের নির্দেশ দিয়েছে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগও।
এদিকে দেশের প্রধান বিরোধীদল অভিযোগ করছে, রাজনৈতিক কারণে সরকার শেরেবাংলা নগরের চন্দ্রিমা উদ্যোনে অবস্থিত জিয়ার মাজার সরিয়ে দিতে চায়। আর সেকারণেই লুই কানের মূল নকশাটি আনার তোড়জোড়, যাতে জিয়ার মাজারের অস্তিত্ব নেই। সংসদ ভবন এলাকায় মোট আটজন রাজনৈতিক নেতা ও বিশিষ্ট নাগরিকের কবর রয়েছে। মূল নকশার বাস্তবায়ন হলে এগুলোও তুলে দেওয়া হবে।
৩ মাসের মধ্যে মূল মাস্টার প্লান দাখিলের নির্দেশ
আগামী ৩ মাসের মধ্যে জাতীয় সংসদ ভবন কমপ্লেক্স ও আশেপাশের এলাকা নিয়ে লুই কানের করা ‘মাস্টার প্ল্যান’ সংসদ সচিবালয়ের সচিবকে আদালতে দাখিল করতে বলেছে সুপ্রীম কোর্টের আপিল বিভাগ। এ বিষয়ে হাই কোর্টের এক রায়ের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষের করা আপিলের শুনানিতে প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহা নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের বেঞ্চ বুধবার এই আদেশ দেয়।
আদেশের পর সরকারের পক্ষে শুনানিকারী অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল মুরাদ রেজা বলেন, “আদালত জাতীয় সংসদ ভবন এলাকা নিয়ে লুই কানের মাস্টার প্ল্যানটি তিন মাসের মধ্যে দাখিল করতে নির্দেশ দিয়েছেন।”
সংসদ ভবন এলাকায় স্পিকার এবং ডেপুটি স্পিকারের আবাসিক ভবন নির্মাণের বৈধতা নিয়ে ২০০৩ সালে বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) ও ইনস্টিটিউট অব আর্কিটেক্টস বাংলাদেশ একটি রিট করে। যাতে দাবি করা হয়, মূল নকশা লংঘন করে জাতীয় সংসদ এলাকায় এসব ভবন নির্মাণ করা হচ্ছে। প্রাথমিক শুনানি নিয়ে আদালত রুলসহ নির্মাণ কাজে স্থগিতাদেশ দেয়।
পরবর্তীতে হাইকোর্টের দেওয়া স্থগিতাদেশ আপিল আদালতে স্থগিত হয়। রুলের ওপর চূড়ান্ত শুনানি শেষে ২০০৪ সালের ২১ জুন হাই কোর্ট ওই ভবন নির্মাণ কার্যক্রম অবৈধ ঘোষণার পাশাপাশি নির্দেশনাসহ রায় দেয়। রায়ে সংসদ ভবন এলাকা ‘ন্যাশনাল হেরিটেজ’ সাইট ঘোষণা করার নির্দেশ দেওয়া হয়। পাশাপাশি ‘ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ’ হিসেবে গণ্য করার জন্য ইউনেস্কোর কাছে আবেদন করতেও বলা হয়।
হাই কোর্টের এই রায় স্থগিতে রাষ্ট্রপক্ষ আপিল বিভাগে আবেদন করলে তা স্থগিত হয়ে যায়। পরবর্তীতে রাষ্ট্রপক্ষ নিয়মিত লিভ টু আপিল করে। একই বছরের ১০ নভেম্বর তা মঞ্জুর করে আপিল বিভাগ। এরই ধারাবাহিকতায় মঙ্গলবার রাষ্ট্রপক্ষের আপিলের ওপর শুনানি শুরু হয়।
মূল নকশার বিচ্যুতি হচ্ছে কিনা দেখার নির্দেশ প্রধানমন্ত্রীর
এদিকে গত মাসে সচিবালয় স্থানান্তর প্রকল্পটি অনুমোদের জন্য জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) বৈঠকে তোলা হলে তা ফেরত পাঠানো হয়।
এ বিষয়ে পরিকল্পনামন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল সাংবাদিকদের বলেন, “লুই কানের নকশার যে অনুলিপি আমাদের কাছে আছে তাতে মূল নকশার বিচ্যুতি হচ্ছে কি না, তা দেখতে নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। এ কারণে মূল নকশা পাওয়ার পর এ প্রকল্প আবার একনেকে উপস্থাপনের নির্দেশ দিয়েছেন তিনি। একারণে প্রকল্পটি গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়কে ফেরত দিয়ে লুই কানের নকশা অপরিবর্তিত রেখে নতুন পরিকল্পনা তৈরি করে একনেকে আবার উত্থাপন করতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
প্রকল্পটি আপাতত ‘ঝুলে গেছে’ বলে মন্ত্রী জানান।
মূল নকশা যুক্তরাষ্ট্রে, আনতে খরচ বিরাট অঙ্কের অর্থ
পরিকল্পনামন্ত্রী মুস্তফা কামাল, ১৯৬২ সালে ঢাকায় সংসদ ভবন কমপ্লেক্স ও আশপাশের এলাকা নিয়ে করা স্থপতি লুই কানের মূল নকশাটি যুক্তরাষ্ট্রের পেনসিলভানিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে সংরক্ষিত আছে। তবে সেটি আনতে বিরাট অঙ্কের অর্থ প্রয়োজন। এর আগে জাতীয় সংসদ সচিবালয় কমিশনের ২৬তম বৈঠকে জানানো হয়, নকশাটি আনতে মোট চার লাখ ৫৯ হাজার ৮০০ ডলার খরচ পড়বে।
জাতীয় সংসদ ভবনের চারপাশে নিরাপত্তা বেষ্টনী নির্মাণ নিয়ে সমালোচনার প্রেক্ষিতে গতবছর ওই মূল নকশা আনার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। সেজন্য লুই কানের প্রতিষ্ঠান ডেভিড অ্যান্ড উইজডমের সঙ্গে যোগাযোগও করেছিল স্থাপত্য অধিদপ্তর।
বিরোধী দলের আপত্তি
এদিকে লুই কানের নকশা অনুযায়ী প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করলে চন্দ্রিমা উদ্যানে থাকা সাবেক প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের কবর উঠিয়ে দেওয়ার আশঙ্কা করছে তার দল বিএনপি। বাংলাদেশের প্রধান বিরোধী দলটি বলছে, সম্পূর্ণ রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে সরকার এ কাজটি করছে। তবে যেহেতু এর আগেও সরকার মূল নকশাটি আনার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছে, তাই এখনই উদ্বিগ্ন নয় তারা।
এ বিষয়ে বিএনপির মুখপাত্র ড. আসাদুজ্জামান রিপন বেনারকে বলেন, “সরকার যেহেতু এখনো প্রেসিডেন্ট জিয়ার মাজার সরানোর বিষয়ে তেমন কিছু বলেনি, তাই আমরা এ বিষয়টি নিয়ে এখনো উদ্বিগ্ন নই। তাছাড়া সরকার আগেও মূল নকশাটি আনার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছে। ”
কবরটি সরানোর বিষয়ে পরিকল্পনামন্ত্রী বলেছেন, “মূল নকশা না দেখে কিছু বলা যাবে না। মূল নকশায় দেখতে হবে- সেখানে একটি মাজার, নাকি আরও মাজার আছে।”
প্রস্তাবিত প্রকল্পে যেমন হবে সচিবালয়
রমনায় সচিবালয় সম্প্রসারণের জায়গা না থাকায় বর্তমানে বাণিজ্য মেলার খোলা মাঠ ও সংলগ্ন চন্দ্রিমা উদ্যানের কিছু জায়গা নিয়ে ৩২ একর জমির উপর নতুন জাতীয় সচিবালয় নির্মাণের একটি প্রস্তাব গত ৬ জুন পরিকল্পনা কমিশনের প্রাক মূল্যায়ন কমিটির (পিইসি) সভায় তোলা হয়।
পরিকল্পনা কমিশনের আপত্তি সত্ত্বেও প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনায় গত জুলাই মাসে প্রকল্পটি এগিয়ে নেওয়ার সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করা হয়। প্রস্তাবিত জায়গাটি চারটি ব্লকে ভাগ করে দুটি বড় ব্লকে ৩২টি বড় মন্ত্রণালয় এবং বাকি দুটি ব্লকে ১৬টি ছোট মন্ত্রণালয়কে স্থানান্তর করার পরিকল্পনা নেওয়া হয়।
প্রস্তাবিত সচিবালয়ের মূল ভবনের আয়তন ধরা হয়েছে প্রায় ২ লাখ ৫৩ হাজার ৩১০ বর্গমিটার। এর সঙ্গে থাকবে ৫৪ হাজার ৫০৫ বর্গমিটার এসোসিয়েটস ভবন, ৫ হাজার ৮৪৩ বর্গমিটার অডিটোরিয়াম ও হলরুম, ২৪ হাজার ৭২৯ বর্গমিটার মসজিদ আর্কেড ও সমবায় ভবন, ১ হাজার ৩৮ বর্গমিটার এন্ট্রান্স প্লাজা, ৫ হাজার ২০০ বর্গমিটার চিলার রুম, ৬৮ হাজার ২৩৪ বর্গমিটারের সড়ক এবং ১ হাজার ৭৭২ মিটার সীমানা প্রাচীর।
গণপূর্ত অধিদপ্তরের মাধ্যমে দুই হাজার ২১৩ কোটি টাকা ব্যয়ে ২০১৮ সালের মধ্যে এ প্রকল্প বাস্তবায়নের কথা বলা হয় প্রকল্প প্রস্তাবে।
তবে প্রকল্পটি নেওয়ার আগে কোনো প্রাক-মূল্যায়ন না করার অভিযোগ আছে।
উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল আগেও
১৯৭৪ সালে শেরেবাংলা নগরে ৪২ একর জায়গায় ১০টি ব্লকে চারটি নয়তলা ভবনসহ অফিস ব্যাংক, অডিটোরিয়াম, মসজিদ, কার পার্কিং সম্বলিত জাতীয় সচিবালয় নির্মাণের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। এজন্য যুক্তরাষ্ট্রের ডেভিড উইজডম অ্যান্ড এসোসিয়েশনের সঙ্গে চুক্তিও হয়েছিল। তবে পরে এর কোনো অগ্রগতি হয়নি।
ওই এলাকায় এরই মধ্যে ১০ একর জমিতে বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্র নির্মাণ করা হয়েছে। জমি কমে যাওয়া এবং বর্তমানের চাহিদা বিবেচনায় লুই আই কানের নকশা স্থাপত্য অধিদপ্তর কিছুটা সংশোধন করেছে। এর ভিত্তিতে সচিবালয় নির্মাণ প্রকল্প প্রস্তাব তৈরি করা হয়েছে।
জাতীয় সংসদ ভবনের চারপাশে নিরাপত্তা বেষ্টনী নির্মাণ নিয়ে সমালোচনার পরিপ্রেক্ষিতে গত বছরও একবার লুই কানের মূল নকশা আনার উদ্যোগ নেওয়া হয়। সে জন্য স্থাপত্য অধিদপ্তর যোগাযোগও করেছিল। নকশা আনতে ব্যয় হবে সাড়ে চার লাখ ডলার। তবে শেষ পর্যন্ত নকশা আনা হয়নি।