প্রবাসীদের হাতে মেশিন রিডেবল পাসপোর্ট দিতে হিমশিম সরকার

ঢাকা থেকে জেসমিন পাপড়ি
2015.04.21
BD-passport হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে শ্রমিকরা কাজের জন্য বিদেশে যাচ্ছেন। তাদের হাতে মেশিন রিডেবল পাসপোর্ট। নভেম্বর ২০১৪
বেনার নিউজ

আগামী নভেম্বরের মধ্যে সকল প্রবাসী বাংলাদেশির হাতে মেশিন রিডেবল পাসপোর্ট (এমআরপি) পৌঁছে দেওয়া নিয়ে চ্যালেঞ্জের ‍মুখে পড়েছে সরকার। ২০১০ সাল থেকে এ পর্যন্ত এক কোটির বেশি এমআরপি ইস্যু করা হলেও এ সেবা পেতে এখনো বাকি রয়েছে গেছে প্রবাসীদের একটি সিংহভাগ। সরকারি হিসেবে এ সংখ্যা প্রায় ৩০ থেকে ৩৫ লাখ। সরকারের পর্যাপ্ত পদক্ষেপের অভাবেই এমআরপি নিয়ে অনিশ্চয়তায় পড়তে হচ্ছে বলে অভিযোগ প্রবাসীদের।  

আন্তর্জাতিক বেসামরিক বিমান পরিবহন সংস্থার (আইকাও)নিয়মানুযায়ী, চলতি বছরের ২৪ নভেম্বর হাতে লেখা পাসপোর্টের যুগ শেষ হচ্ছে। এ সময়ের পর সংশ্লিষ্ট দেশগুলো ভিসার মেয়াদ থাকলেও এমআরপি না থাকা প্রবাসীদের দেশে ফেরত পাঠিয়ে দেবে। এর ফলে বাংলাদেশ রেমিটেন্সের প্রবাহ কমা ও বেকারত্ব বৃদ্ধির মত সমস্যায় পড়তে পারে বলে আশঙ্কা অর্থনীতিবিদদের।

এসব বিষয় বিবেচনায় নিয়েই বিভিন্ন দেশে বসবাসরত বাংলাদেশিদের হাতে ২০১৫ সালের মধ্যে এমআরপি দিতে কাজ করে যাচ্ছে সরকার। বিভিন্ন দেশে অবস্থিত দূতাবাসগুলোকে এবং তিনটি দেশের জন্য একটি আউট সোর্সিং প্রতিষ্ঠানকেও দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। মালয়েশিয়া, সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাতে এমআরপি প্রকল্পে কাজ করছে মালয়েশিয়াভিত্তিক প্রতিষ্ঠান আইআরআইএস (আইরিস)।

তবে দূতাবাসের প্রবল লোকবল সংকট ও আইরিসের উদাসীনতায় এমআরপি সরবরাহের প্রক্রিয়া খুব ধীর গতিতে চলছে বলে অভিযোগ প্রবাসীদের। আর্থিক অনিয়ম, পাসপোর্ট দিতে দীর্ঘসূত্রিতা, যান্ত্রিক ত্রুটিসহ নানা অভিযোগ এসব প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে। পাসপোর্ট আবেদনের জন্য এসে দীর্ঘ লাইনে দাঁড়িয়ে নষ্ট হয় শ্রমিকদের কর্মঘণ্টা। এছাড়া দালালদের দৌরাত্ম তো আছেই। দূতাবাস থেকে দূরে থাকা প্রবাসীদেরও এ ভোগান্তি আরো প্রকট।

চলতি মাসে সৌদি আরবে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত গোলাম মসীহ স্বাক্ষরিত এক চিঠিতেও আইরিসের নানা অনৈতিক কর্মকাণ্ডের চিত্র তুলে ধরা হয়। বহিরাগমন ও পাসপোর্ট অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের কাছে পাঠানো এ চিঠি রাষ্ট্রদূত জানান, রিয়াদ, দাম্মাম ও বুরাইদাহ এলাকায় এমআরপি সেবা দেওয়া আইরিস এ পর্যন্ত তারা ২৭ হাজার ৬২৭টি পাসপোর্টের প্রসেস করেছে। এর বিপরীতে নির্ধারিত ব্যাংক অ্যাকাউন্টে সাত কোটি ১৪ লাখ ৮৪ হাজার ৮৬২ টাকা জমা দেওয়ার কথা থাকলেও মাত্র দুই কোটি ২৯ লাখ ৯০ হাজার ২৬৫ টাকা জমা করেছে। এমনকি তারা জমা করেনি জন্ম নিবন্ধন ফি’র টাকাও।

সৌদিতে প্রতিদিন নয় হাজার, মালয়েশিয়া ও আমিরাতে প্রতিদিন পাঁচ হাজার করে পাসপোর্ট প্রসেস করার কথা ছিল আইরিসের। কিন্তু সংশ্লিষ্ট দূতাবাসগুলোর তথ্যানুযায়ী, প্রতিষ্ঠানটি সৌদিতে দিনে মাত্র এক হাজার দুইশ, আমিরাতে প্রতিদিন মাত্র ১২৫ থেকে ১৫০টি এবং মালয়েশিয়াতে ৮৯টি পাসপোর্ট প্রসেস করছে।

গত সপ্তাহে অনুষ্ঠিতি এক বৈঠকে এমআরপি বিতরণ সংক্রান্ত উপদেষ্টা কমিটির সভাপতি ও প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন এ তিন দেশের এমআরপি বিতরণ নিয়ে তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করেন।

এমআরপি সমস্যার ভুক্তভোগী মালয়েশিয়া প্রবাসী সাতক্ষীরার শাহজাহান সরদার। মাত্র কয়েক মাসের ব্যবধানে আবারও দেশে ফিরেছেন তিনি।
আগারগাঁও পাসপোর্ট অফিসের সামনে দাঁড়িয়ে তিনি বেনারকে বলেন, কুয়ালালামপুরের বাংলাদেশ দূতাবাস আমার কর্মস্থল সারওয়াহ প্রদেশ থেকে অনেক দূরে। এছাড়া ছুটি নিয়ে দূতাবাসে গেলেও একদিনে কাজ হয়না। আমার অনেক বন্ধু সেখানে গেলেও দীর্ঘসূত্রিতায় পড়েছে। যাওয়া-আসা খরচ তো আছেই, কাজে কামাই দেওয়ায় বেতনও কাটা গেছে। আবার দূতাবাসের কোনো মোবাইল টিমও নেই। একারণে পাসপোর্ট করতে আমি দেশেই এসেছি।

সৌদি আরবের দো-আদমী এলাকায় বসবাসরত নারায়নগঞ্জের মো. শামীম টেলিফোনে বেনারকে বলেন, আমি রিয়াদের বাংলাদেশ দূতাবাস থেকে ২০০ কি.মি. দূরে থাকি। সেখানে দুএকবার গিয়েও ফিরে এসেছি। দীর্ঘদিন ধরে দেশে জন্ম নিবন্ধন সার্ভার নষ্ট বলে দূতাবাস আমাদেরকে ফিরিয়ে দিচ্ছিল। আবার আইরিসও অতিরিক্ত ফি নিচ্ছে।

সরকারের নির্ধারিত ফিস অনুযায়ী ১৬০ থেকে ১৮০ (জন্ম নিবন্ধন না থাকলে) রিয়াল হলেও আইরিস নিচ্ছে ২০০ থেকে ২৫০ রিয়াল।
তিনি আরো বলেন, পাসপোর্ট করতে যেতে হলে মালিক ছুটির দিনে যাওয়ার অনুমতি দেয়। কিন্তু সেদিন দূতাবাস বা আইরিসের অফিস বন্ধ থাকে।

এদিকে সমস্যা সমাধানে দূতাবাসগুলোতে জনবল এবং যন্ত্রপাতি বাড়ানো এবং আইরিসকে কয়েক দফা সতর্ক বার্তা দিয়েছে উচ্চপর্যায়ের উপদেষ্টা কমিটি। সৌদি আরব ও আমিরাতে ভ্রাম্যমান টিম চালু করা হয়েছে। ছুটির দিনে তারা বিভিন্ন এলাকায় ক্যাম্প বসিয়ে পাসপোর্ট আবেদন গ্রহণ করছেন। তবে পর্যাপ্ত সরঞ্জামের অভাবের কথা জানিয়েছে টিম সদস্যরা।

তাদেরকে আরো সচল করতে শীঘ্রই ৩০টি ক্যামেরা ও ফিঙ্গার প্রিন্ট মেশিন সেখানে পাঠানো হবে বলে জানিয়েছেন বহির্গমন ও পাসপোর্ট অধিদপ্তরের মহাপরিচালক এসএম জিয়াউল আলম।

তিনি বেনারকে বলেন, এপর্যন্ত আমরা এক কোটি পাঁচ লক্ষ এমআরপি পাসপোর্ট ইস্যু করেছি। আশা করছি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে সকল প্রবাসী বাংলাদেশিকে এমআরপি পাসপোর্ট দিতে পারব। সেজন্য সব রকমের প্রস্তুতি আমরা নিয়েছি।

তিনি বলেন, সৌদি আরব, মালয়েশিয়া আরব আমিরাত, ওমানসহ মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে পাসপোর্ট দেওয়ার চাপ বেশি। এসব এদেশের দূতাবাসগুলোতে জনবল বাড়ানো হয়েছে। আইরিসকে কাজের গতি বাড়ানোর নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

তবে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে এমআরপি দিতে না পারলে বড় অর্থনৈতিক ক্ষতির আশঙ্কা করছেন অর্থনীতিবিদরা।

এ বিষয়ে অর্থনীতিবিদ ড. আবুল বারাকাত বেনার নিউজকে বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসেব অনুযায়ী, সর্বশেষ অর্থবছরে অভিবাসীদের পাঠানো রেমিটেন্সের পরিমান প্রায় ১৪.৪৬ বিলিয়ন ইউএস ডলার। হুন্ডির মাধ্যমে পাঠানো অর্থ ধরলে এর পরিমান প্রায় ২০ থেকে ২২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। যা আমাদের অর্থনীতির বিরাট একটি অংশ। যদি ৩০-৩৫ লক্ষ প্রবাসী শ্রমিককে এমআরপি না পেয়ে দেশে ফিরে আসতে হয় তাহলে বছরে প্রায় ১০ বিলিয়ন ডলার সমপরিমান বৈদেশিক অর্থ আসা বন্ধ হবে। এছাড়া দেশে বেকারত্বের হারও বাড়বে।

তবে আশার কথা  শুনিয়েছেন প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রী। তিনি বলেন, একজন বাংলাদেশিকেও যাতে এমআরপি না থাকার কারণে বিদেশ থেকে ফেরত না আসতে হয় সেজন্য সব ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। এছাড়া শর্তানুযায়ী কাজ করতে ব্যর্থ হলে প্রয়োজনে আইরিসের সঙ্গে চুক্তি বাতিলের মত সিদ্ধান্তও নিতে পারে সরকার।


মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।