১০০টি দেশে বাংলাদেশের ওষুধ, এবার যাচ্ছে আমেরিকাতেও

ঢাকা থেকে শাহরিয়ার শরীফ
2016.02.18
BD-pharma বিশ্ববিখ্যাত ওষুধ প্রস্তুতকারী কোম্পানির অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে গত ২৮ জানুয়ারি থেকে ৩০ জানুয়ারি পর্যন্ত ঢাকায় অনুষ্ঠিত হয় অষ্টম এশিয়া ফার্মা এক্সপো।
বেনার নিউজ

বাংলাদেশের ওষুধ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলো উৎকৃষ্ট মানের যে কোনো ওষুধ তৈরিতে এখন সক্ষম। এশিয়া, আফ্রিকা, ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশ ও অস্ট্রেলিয়ার পর এ বছরের মার্চে প্রথমবারের মতো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে প্রবেশ করতে যাচ্ছে বাংলাদেশের ওষুধ।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের খাদ্য ও ওষুধের মান নিয়ন্ত্রণকারী প্রতিষ্ঠান এফডিএ প্রতিনিধিদলের দেওয়া ৪৮৩টি টি শর্ত পূরণ করেছে বাংলাদেশের স্কয়ার ও বেক্সিমকো ফার্মাসিউটিক্যালসের টঙ্গী ও গাজিপুর কারখানা। এরই পরিপ্রেক্ষিতে দুটি প্রতিষ্ঠান মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ওষুধ রপ্তানির অনুমতি পায়।

“আমরা আশা করছি ২০১৬ সালের মধ্যে আরও কমপক্ষে ছয়টি দেশি প্রতিষ্ঠান এফডিএ অনুমোদন পাবে,” বেনারকে জানান ওষুধ শিল্প মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক শফিউজ্জামান।

তিনি বলেন, দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে শ্রীলঙ্কা ও নেপালে একটা সময় শুধু ভারতের ওষুধ ব্যবহার হতো। ধীরে ধীরে এ দুটি বাজারেও বাংলাদেশের ওষুধ জনপ্রিয় হয়ে উঠছে।

বাংলাদেশের ওষুধ এখন বিশ্বের প্রায় ১০০টি দেশে রপ্তানি হচ্ছে বলেও জানান তিনি।


‘দামি’ ওষুধও এখন সুলভে মিলছে

১৯৮২ সালে ওষুধ নীতি বাস্তবায়নের আগে বাংলাদেশের ওষুধের বাজার নিয়ন্ত্রণ করত বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানগুলো।১৯৮২ সালের পর দেশীয় প্রতিষ্ঠানগুলো ভিটামিন ও কিছু সিরাপ উৎপাদন করতে শুরু করে।দেশীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে সুযোগ করে দিতে এ দুটি পণ্য উৎপাদনে বিদেশি প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রতি নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়।

এরপর দেশীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি।ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তরের হিসেবে বাংলাদেশে এখন প্রায় দেড় হাজার ধরনের ওষুধ ২২ হাজার নামে (ব্র্যান্ড) দেশে ও বিদেশে বিক্রি হচ্ছে। ১৭৬টি প্রতিষ্ঠান এই উৎপাদনকাজের সঙ্গে জড়িত। শীর্ষ ২০টি প্রতিষ্ঠান প্রায় ৯০ ভাগ ওষুধের জোগানদাতা।  

ভিটামিন ও সিরাপ উৎপাদনকারী সেই ওষুধ শিল্প এখন দেশেই উৎপাদন করছে ডায়াবেটিস ও ক্যানসারের ওষুধ। পুরোপুরি বিদেশ নির্ভর এ ওষুধগুলো দেশে তৈরি হওয়ায় কমদামে রোগীরা কিনতে পারছেন। দেশি প্রতিষ্ঠানগুলো কমে ওষুধ দেওয়ায়, এখন বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানগুলোও দাম কমাচ্ছে।

“বছর দশেক আগেও আমরা রোগীদের সান্তনামূলক ব্যবস্থাপত্র (প্রেসক্রিপশন) দিতাম। ক্যানসার কেমোথেরাপি ওষুধের দাম বেশি হওয়ায় অনেক রোগীই চিকিৎসা নিতে পারতেন না। সে জায়গায় এখন দেশীয় ওষুধ চার ভাগের একভাগ দামে বাজারে পাওয়া যাচ্ছ,” বেনারকে জানান জাতীয় ক্যানসার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের পরিচালক ডা. মোয়াররফ হোসেন।

“এ দেশের দক্ষ মানবসম্পদ দেশে ওষুধ শিল্পের বিকাশে কাজ করেছে। নিম্ন আয়ভুক্ত দেশ হিসেবে বাংলাদেশ এখনো পর্যন্ত উন্নত দেশের ওষুধের ফর্মুলা অনুসরণ করে দেশে ওষুধ তৈরির সুযোগ পাচ্ছে,” বেনারকে জানান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ওষুধ প্রযুক্তি অনুষদের ডিন আ ব ম ফারুক।


বড় হচ্ছে ওষুধের বাজার

১৯৮২ সালে ওষুধ নীতি প্রণয়নের পর বাংলাদেশের ওষুধের বাজার আকারে ৬৫ গুণ পর্যন্ত বেড়েছে। আন্তর্জাতিক সংস্থা আইএমএস বলছে, ১ হাজার ৭৩০ মিলিয়ন টাকার বাজার এখন ১১৩ বিলিয়ন টাকার বাজারে পৌঁছেছে।

গত ডিসেম্বরে সংস্থাটির ‘মার্কেট ইনসাইট: হাউ দ্য বাংলাদেশ ফার্মাসিউটিক্যাল সেক্টর ইস পারফরমিং ২০১৫’ শিরোনামে প্রকাশিত প্রতিবেদনটিতে বলা হয়, ২০১০ সাল থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত বাজারটির প্রবৃদ্ধি বেড়েছে গড়ে ১০ শতাংশ হারে। ২০১৮ সাল নাগাদ ওষুধের বাজার ১৬০ বিলিয়ন টাকায় পৌঁছাবে বলে ভবিষ্যদ্বাণী করেছে সংস্থাটি।


অষ্টম এশিয়া ফার্মা এক্সপো

বিশ্ববিখ্যাত ওষুধ প্রস্তুতকারী কোম্পানির অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে গত ২৮ জানুয়ারি থেকে ৩০ জানুয়ারি পর্যন্ত ঢাকায় অনুষ্ঠিত হয় অষ্টম এশিয়া ফার্মা এক্সপো । ওষুধ শিল্প সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বাংলাদেশ ওষুধশিল্প সমিতির উদ্যোগে ঢাকায় তিন দিনের এই মেলার মধ্য দিয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও মূল্যবান অভিজ্ঞতা অর্জন করেছে বাংলাদেশ।

এশিয়া ফার্মা এক্সপো-২০১৬ তে অংশ নেয় ৮০ টির বেশি দেশের চার শতাধিক ওষুধ প্রস্তুতকারী কোম্পানি। মেলায় অংশ নেওয়া বিশ্ববিখ্যাত কোম্পানিগুলোর কাছ থেকে দেশীয় বিশেষজ্ঞ থেকে উদ্যোক্তা সব পর্যায়ের সংশ্লিষ্টরা মূল্যবান অভিজ্ঞতা অর্জন করতে সক্ষম হয়েছেন বলে জানিয়েছেন আয়োজকেরা।

“আমাদের শিক্ষা হচ্ছে, দেশের মানুষকে কোয়ালিটি মেডিসিন দেওয়া এবং বিদেশে আমাদের রপ্তানি বাড়ানো,” সাংবাদিকদের জানান বাংলাদেশ ওষুধ শিল্প সমিতির মহাসচিব এস এম শফিউজ্জামান।


বড় চ্যালেঞ্জ কাঁচামাল উৎপাদন

বাংলাদেশের সামনে এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো ওষুধের কাঁচামাল উৎপাদন করা। এ ছাড়া দেশটি এখনো পর্যন্ত পিছিয়ে আছে মৌলিক ওষুধ উৎপাদনে।

নিম্ন আয়ভুক্ত দেশ হিসেবে বাংলাদেশ ২০৩১ সাল পর্যন্ত উন্নত দেশে উৎপাদিত ওষুধের নমুনা দেখে ওষুধ উৎপাদন করার অনুমতি পেয়েছে। ধারণা করা হচ্ছে ২০৩১ সালের আগেই বাংলাদেশ মধ্যম আয়ভুক্ত দেশে উন্নীত হবে। ফলে নমুনা অনুকরণে ওষুধ তৈরির সুযোগটি হাতছাড়া হয়ে যেতে পারে।

“ওই পরিস্থিতি মোকাবিলায় আসলেই প্রস্তুতি এখন পর্যন্ত বেশ কম। মৌলিক ওষুধ তৈরিতে আমরা এখন বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষকদের সঙ্গে যোগাযোগ করছি। কিছু প্রকল্প ইতিমধ্যেই চালু করা সম্ভব হয়েছে,” বেনারকে জানান বাংলাদেশ ওষুধ শিল্প মালিক সমিতির সভাপতি নাজমুল হাসান পাপন।

এ দিকে যে ওষুধ উন্নত দেশগুলোর মানুষের ক্ষেত্রে কার্যকরী সেটি এ দেশের মানুষের ওপর কতটা কার্যকরী তার পরীক্ষার আগে ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল হচ্ছে না।

“ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল যেন দেশেই হয়, সে জন্য একটি নীতিমালা তৈরি হয়েছে। আমরা অনুরোধ করব ওষুধ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোকে দেশের ভেতরেই এই ট্রায়ালের সুযোগ নিতে,” বেনারকে জানান ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মোস্তাফিজুর রহমান।

তিনি বলেন, এর বাইরেও আরও একটি সমস্যা রয়ে গেছে। তা হলো বাংলাদেশ এখনো ওষুধের কাঁচামালের ৯৮ ভাগ ভারত, চীন ও ইতালি থেকে আমদানি করছে।

তবে ওষুধ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলো বলছে কাঁচামালের ওপর নির্ভরশীলতা কমাতে ঢাকার অদূরে একটি এপিআই পার্ক (অ্যাকটিভ ফার্মাসিউটিক্যাল ইনগ্রেডিয়েন্টস) প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। সেখানে দ্রুত কাঁচামাল উৎপাদনের উদ্যোগ নেওয়া সম্ভব হবে বলে আশাবাদ সংশ্লিষ্টদের।  

নাজমুল হাসান বলেন, “বাংলাদেশের ক্রিকেট যেমন দেশের গর্ব, ওষুধ শিল্পও তেমন ধীরে ধীরে গর্বের প্রোডাক্ট হয়ে উঠছে।”

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।