মোবাইল সিমের তথ্য ভান্ডার গড়ে তোলা হচ্ছে
2015.12.17

জাতীয় নিরাপত্তার স্বার্থে মোবাইল সিমের তথ্য ভান্ডার তৈরির কাজ শুরু করেছে বাংলাদেশ সরকার। জাতীয় পরিচয়পত্রের সঙ্গে তথ্য মিলিয়ে গ্রাহকের নতুন সিম নিবন্ধন করা হবে। ফলে দেশের প্রায় ১৩ কোটি মোবাইল ব্যবহারকারীর একটি বিরাট ডাটাবেজ তৈরি হতে যাচ্ছে। একইসঙ্গে মোবাইল হ্যান্ডসেটেরও নিবন্ধনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেরিতে হলেও মোবাইল সিমের অপব্যবহার বন্ধ ও আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে সরকারের এ সিদ্ধান্ত অত্যন্ত ইতিবাচক। এটি নাগরিকের সম্পূর্ণ ডিজিটাল আইডেনটিটি হিসেবেও কাজে লাগতে পারে বলে মন্তব্য করেন তারা।
আঙুলের ছাপে সিম নিবন্ধন শুরু
গত ১৬ ডিসেম্বর থেকে দেশব্যাপী আনুষ্ঠানিকভাবে বায়োমেট্রিক পদ্ধতিতে মোবাইল ফোনের সিম নিবন্ধন শুরু হয়েছে। টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিটিআরসি কার্যালয়ে এ পদ্ধতির উদ্বোধন করেন ডাক ও টেলিযোগাযোগ প্রতিমন্ত্রী তারানা হালিম।
এ বিষয়ে তিনি বলেন, প্রত্যেক মোবাইল ব্যবহারকারীকে আঙুলের ছাপ দিয়ে মোবাইল সিম নিবন্ধন করতে হবে। এক বা একাধিক সিম ব্যবহার করলেও গ্রাহককে নিজ নামে সবগুলোর নিবন্ধন করতে হবে। এভাবে আমরা প্রতিটি গ্রাহককে সিকিউর করতে চাই। নিবন্ধন ছাড়া কোন সিম সচল রাখা হবে না।
আগামী বছরের এপ্রিলের মধ্যে পুরোনো সব সিম নিবন্ধন সম্ভব হবে আশাবাদ ব্যক্ত করে তারানা হালিম বলেন, এটা চলমান প্রক্রিয়া। এপ্রিলের পরেও অনেক সিম নিবন্ধন হবে, সেটাও একই প্রক্রিয়ায় চলতে থাকবে।
গত ২১ অক্টোবর প্রধানমন্ত্রীর তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয় নিজের নামে একটি সিমের নিবন্ধনের মাধ্যমে বায়োমেট্রিক পদ্ধতির উদ্বোধন করেন। এরপর নভেম্বর থেকে মোবাইল অপারেটরগুলো পরীক্ষামূলকভাবে এ কার্যক্রম শুরু করে। তবে সেসময় গ্রাহকদের অনেকের আঙ্গুলের ছাপ জাতীয় পরিচয়পত্র তথ্যভাণ্ডারের সঙ্গে মিলছিল না বলে অভিযোগ পাওয়া যায়। পরে সে ত্রুটি সমাধান করা হয়।
নিবন্ধিত হবে মোবাইল হ্যান্ডসেটও, পদ্ধতি চূড়ান্ত হয়নি
সিমের পাশাপাশি গ্রাহকের কাছে থাকা মোবাইল হ্যান্ডসেট নিবন্ধনের প্রক্রিয়া শুরু হবে বলেও জানিয়েছেন প্রতিমন্ত্রী তারানা হালিম। আগামী ফেব্রুয়ারি থেকে এ প্রক্রিয়া শুরু হবে বলে তিনি গণমাধ্যমকে জানান। তবে কী প্রক্রিয়ায় গ্রাহকের হাতে হ্যান্ডসেট নিবন্ধন করা হবে সে বিষয়ে স্পষ্ট করে কিছু বলেননি প্রতিমন্ত্রী।
তিনি বলেন, “আগামী ফেব্রুয়ারিতে মোবাইল ফোন হ্যান্ডসেট নম্বর রেজিস্ট্রেশন করার বিষয়ে নির্দেশনা দেবে বিটিআরসি।”
এ পদ্ধতি শুরু হলে মোবাইল হ্যান্ডসেটের ইন্টারন্যাশনাল মোবাইল ইক্যুইপমেন্ট আইডেনটিটি (আইএমইআই) নম্বর ব্যবহারকারীদের নিবন্ধন করতে হবে। এ কাজে প্রাথমিকভাবে মোবাইল ফোন অপারেটরদের কাস্টমার কেয়ার ব্যবহার করা হবে বলে জানিয়েছে বিটিআরসি কর্তৃপক্ষ। এছাড়া বায়োমেট্রিক পদ্ধতিতে সব গ্রাহককে সিম নিবন্ধন করার সময় হ্যান্ডসেট নিবন্ধনের কাজটিও করে নেওয়া হতে পারে বলে জানা যায়।
মোবাইল হারিয়ে গেলে এই আইএমইআই নম্বর দিয়ে সেটি খুঁজে পাওয়া সহজ। এমনকি আইএমইআই নম্বরের মাধ্যমে ওই সেটের ব্যবহার করা সিমের নাম্বার ও গ্রাহকের তথ্যও পাওয়া যায়। কিন্তু ব্যবসায়ীরা বলছেন, বাজারে যেসব মোবাইল হ্যান্ডসেট আছে সেগুলোর প্রতি তিনটিতে একটি নকল বা অবৈধ।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বলছে, সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে এসব আইএমইআই নম্বরবিহীন হ্যান্ডসেটগুলোই বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হচ্ছে। আবার কোনো কোনো আইএমইআইয়ের বিপরীতে অন্তত বারো হাজার মোবাইল সেটের অস্তিত্ব পাওয়া গেছে। এ কারণে মোবাইল নম্বর থাকার পরও অপরাধীদের সনাক্ত করা সম্ভব হয় না। তাছাড়া হারিয়ে গেলে বা ছিনতাই হলেও তা উদ্ধার করা যায় না।
এসব অপকর্ম বন্ধে বিটিআরসি মোবাইল ফোন অপারেটরদের ন্যাশনাল ইক্যুইপমেন্ট আইডেন্টিফিকেশন রেজিস্ট্রার (এনইআইআর) যন্ত্র বসানোর নির্দেশনা দিয়েছিল। এরপর তিন বছরের বেশি সময় পেরিয়ে গেলেও ওই নির্দেশনা বাস্তবায়ন হয়নি।
‘নাগরিকের ডিজিটাল আইডেনটিটি হবে’
সিম ও মোবাইল নিবন্ধনের সুফলের কথা বলতে গিয়ে প্রতিমন্ত্রী তারানা হালিম বলেন, এই নিবন্ধনের তথ্য একজন নাগরিকের সম্পূর্ণ ডিজিটাল আইডেনটিটি হবে।
এ বিষয়ে মন্ত্রীর সঙ্গে একতমত পোষণ করেন বিশেষজ্ঞরা। অন্যান্য নাগরিক সুবিধা পাওয়ার ক্ষেত্রেও এটি সহায়তা করবে বলে মনে করেন তারা।
কম্পিউটার বিশেষজ্ঞ ও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মোহাম্মদ কায়কোবাদ বেনারকে বলেন, “এদেশের মানুষের হাতে যখন মোবাইল দেয়া হয়, তখন ভাবা হয়নি কত শক্তিমালী যন্ত্র তাদের হাতে তুলে দেওয়া হচ্ছে। আজ মোবাইলের মাধ্যমে চাঁদাবাজি থেকে শুরু করে নানা ধরনের অপরাধ সংঘঠিত হচ্ছে। শুরু থেকে প্রতিটি সিম ও মোবাইল নিবন্ধিত থাকলে এসব অপরাধীদের সনাক্তকরণ সহজ হত। তাই বলবো, দেরিতে হলেও সরকার সিম ও মোবাইল নিবন্ধনের যে উদ্যোগ নিয়েছে তা প্রশংসনীয় সিদ্ধান্ত। জাতীয় নিরাপত্তার স্বার্থে এটি অত্যন্ত জরুরি। একইসঙ্গে এই নিবন্ধন জাতীয় পরিচয়পত্রের মত গ্রাহকের একটি আইডেন্টিটি হতে পারে।”
কম্পিউটার সফটওয়্যার ও তথ্যপ্রযুক্তি সেবা খাতের সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব সফটওয়্যার অ্যান্ড ইনফরমেশন সার্ভিসেসের (বেসিস) সভাপতি শামীম আহসান বেনারকে বলেন, “সিম-মোবাইল নিবন্ধনের ফলে এখন প্রত্যেকটি মানুষকে নজরদারিতে আনা সম্ভব হবে। আগে অপরাধীরা অপরাধমূলক কাজে একজন আরেকজনের সিম ব্যবহার করত। তাছাড়া এটা ডিজিটাল পরিচয়পত্র হিসেবে বিভিণ্ন নাগরিক সুবিধা পাওয়ার ক্ষেত্রে কাজে লাগতে পারে।”
প্রয়োজন বিপুল প্রস্তুতি
প্রশংনীয় উদ্যোগ হলেও প্রায় ১৩ কোটির বেশি মোবাইল সিমের নিবন্ধন মোটেই সহজ কাজ নয়। এর পাশাপাশি হ্যান্ডসেট নিবন্ধনের জন্যও সরকারের প্রস্তুতি যথেষ্ঠ নয়। তারা বলছেন, মোবাইল সেট নিবন্ধনের প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে গেলে সরকারকে বিপুল প্রস্তুতি নিতে হবে।
অধ্যাপক কায়কোবাদ বলেন, “শুরুতেই নিবন্ধন না করায় এখন সিম গ্রাহকের সংখ্যা প্রায় ১৩ কোটি। এদের সবার নিবন্ধন করা অনেক বড় ব্যাপার। একই সঙ্গে হ্যান্ডসেটের বিষয়টি আরো জটিলতা সৃষ্টি করবে। এর জন্য সরকারের আরো প্রস্তুতির প্রয়োজন ছিল। তবে চুরি হয়ে যাওয়া বা আইএমইআই নম্বরবিহীন মোবাইল সেট সনাক্ত করার কাজ প্রযুক্তি দিয়েই করা সম্ভব। বিশেষ যন্ত্র স্থাপনের মাধ্যমে মোবাইল অপারেটররাই এ ধরণের মোবাইল ফোন সনাক্ত করে সেগুলো অকার্যকর করার করে দিতে পারে।”
তবে শামীম আহসান বলেন, “শুরুতে নিবন্ধনের কাজে কিছুটা ঝামেলা হতে পারে। তবে ধীরে ধীরে মানুষ এতে অভ্যস্ত হয়ে উঠবে।”