বখাটের হাতে লাঞ্ছনার বিচার চেয়ে এবার পুলিশের হাতে লাঞ্ছিত নারী

ঢাকা থেকে শাহরিয়ার শরীফ
2015.05.11
BD-police ১ বৈশাখ নারী লাঞ্ছিতকারিদের শাস্তি নিশ্চিত করার দাবীতে গতকাল ছাত্র ইউনিয়ন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মিছিল নিয়ে ডিএমপি কার্যালয় ঘেরাও ক​রতে গেলে পুলিশ লাঠিচার্জ করে, এ থেকে রেহাই পাননি নারী কর্মীরাও। ১০ মে,২০১৫
বেনার নিউজ

বাংলা নববর্ষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় নারী লাঞ্ছনার বিচার চাইতে এসে উল্টো পুলিশের হাতে লাঞ্ছিত হয়েছেন বামধারার ছাত্রসংগঠন বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নের কয়েক ছাত্রী। নিপীড়কদের গ্রেপ্তার ও শাস্তিসহ ছয় দফা দাবিতে ১০ মে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) কার্যালয় ঘেরাও করতে গিয়েছিলেন তাঁরা।

এ ঘটনায় মো. আনিস নামে পুলিশের এক কনস্টেবলকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। ১১ মে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) গণমাধ্যম শাখা থেকে পাঠানো এক খুদে বার্তায় এ কথা জানানো হয়।

“এভাবে পুলিশের শেষ ধাপের কর্মীর ওপর দায়িত্ব চাপানো ঠিক নয়। ওই দিন পুলিশের কোন কর্মকর্তা দায়িত্বে ছিলেন তাকে দিয়েই শাস্তি শুরু করা উচিত,” বেনারকে বলেন মানবাধিকার কর্মী ব্যারিস্টার সারা হোসেন।

“পুলিশ বলছে, গণমাধ্যমে প্রকাশিত ওই লাঞ্ছিত নারী ঢিল ছুড়েছিল। যদি ঢিল ছুড়েও থাকে, তাঁকে পুরুষ পুলিশ লাথি মারবে বা চুলের মুঠি ধরবে কেন?” প্রশ্ন রাখেন সারা হোসেন।

বর্ষবরণের দিন নারী লাঞ্ছনাকারীদের কাউকে ২৮ দিনেও চিহ্নিত করতে পারেনি পুলিশ। উল্টো যাঁরা বিচার চেয়েছে তাঁদের ওপরই পুলিশের বর্বর হামলার ঘটনায় ক্ষোভ ও নিন্দার ঝড় উঠেছে। হামলার প্রতিবাদে ১২ মে দেশব্যাপী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গুলোতে ছাত্র ধর্মঘট ডেকেছে ছাত্র ইউনিয়ন।

“একটি শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদ ও ন্যায্য দাবি আদায়ে আয়োজিত সমাবেশে পুলিশের একাংশের পৈশাচিক তাণ্ডব এবং জেন্ডার অসংবেদনশীল আচরণ থেকে এটি সুস্পষ্ট যে রাজনৈতিক শিখন্ডি হিসেবে ধারাবাহিকভাবে ব্যবহৃত হওয়ার ফলে বাংলাদেশের পুলিশ এখন নিজেদেরকে সকল আইনের ঊর্ধ্বে হিসেবে ভাবতে শুরু করেছে, যা আইনের শাসন ও গণতান্ত্রিক অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য অশনিসংকেত হিসেবে প্রতিভাত হচ্ছে,” বেনারকে জানান ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ–টিআইবি’র নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান।

ড. ইফতেখার মনে করেন, সনাতন পদ্ধতিতে তথাকথিত ‘ক্লোজড’ করা বা সাময়িক বরখাস্তের মতো লোক-দেখানো পদক্ষেপ যথেষ্ট নয়। পুলিশের সকল কর্মকাণ্ডের স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা, নৈতিকতা এবং সর্বোপরি হারানো আস্থা পুনরুদ্ধারে অনতিবিলম্বে বিচার-বিভাগীয় তদন্ত হওয়া উচিত।

তবে ডিএমপির উপকমিশনার এস এম জাহাঙ্গীর আলম সরকার বেনারকে জানান, “রোববারের পুরো ঘটনা তদন্তে তিন সদস্যের একটি কমিটি গঠন করে তাদের সাত দিনের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে।”

ঘটনার সময় তোলা বিভিন্ন ছবি এবং ধারণ করা ভিডিওতে দেখা যায়, পুলিশ সদস্যরা লাঠিপেটা ও জলকামান ব্যবহার করছে। পাশাপাশি বিক্ষোভকারীদের বুট দিয়ে আঘাত করতেও দেখা যায়। ধাওয়া খেয়ে গাছের আড়ালে লুকিয়ে থাকা ছাত্রীটিকেও চুলের মুঠি ধরে টেনে বের করে পিটিয়েছে পুলিশ।

হামলাকারী পুলিশ সদস্যদের শাস্তি দেওয়ার দাবিতে ১১ মে সংবাদ সম্মেলন করেছে প্রগতিশীল ছাত্রজোট ও সাম্রাজ্যবিরোধী ছাত্র ঐক্য। এ ঘটনায় ৩৪ জন আহত হওয়ার কথা জানায় সংগঠন দুটি।

“ঘেরাও কর্মসূচিতে পুলিশের নৃশংস হামলা বর্বরতার সীমাকে ছাড়িয়ে গেছে। পয়লা বৈশাখে নারী লাঞ্ছনার বিচার করতে পারেনি যে পুলিশসহ রাষ্ট্রীয় প্রশাসন, সেই ঘটনার প্রতিবাদ করতে গিয়ে পুলিশের হাতে ছাত্রী লাঞ্ছিত হয়েছে। এ ঘটনা প্রমাণ করে পুলিশই নারী লাঞ্ছনাকারীদের মদদদাতা,” বেনারকে জানান প্রগতিশীল জোটের সমন্বয়ক ও ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতি হাসান তারেক।

ডিএমপির এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মিছিলকারীরা কীভাবে এতগুলো ব্যারিকেড পার হয়ে মিন্টো রোডে স্পর্শকাতর মন্ত্রিপাড়ায় এল, তাও খতিয়ে দেখা হবে। এ ছাড়া পুলিশের উপর ‘হামলার’ কারণে আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে গৃহীত আইনানুগ ব্যবস্থাও পর্যালোচনা করবে এই কমিটি।

পয়লা বৈশাখে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি এলাকায় প্রচণ্ড ভিড়ের মধ্যে একদল যুবক দীর্ঘ সময় ধরে নারীদের লাঞ্ছিত করে। তাদের বাধা দিতে গিয়ে আহত হন ছাত্র ইউনিয়নের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি লিটন নন্দীসহ দুজন।

শুরু থেকেই লিটন নন্দী ও অন্যরা অভিযোগ করে আসছিলেন, বারবার পুলিশের সাহায্য চাওয়া হলেও পুলিশ লাঞ্ছনাকারীদের ঠেকাতে বা ধরতে এগিয়ে আসেনি। দুজনকে ধরে পুলিশে সোপর্দ করা হলেও পরে তাদের ছেড়ে দেয় পুলিশ। বিষয়টি গণমাধ্যমে এলে পুলিশ কর্মকর্তারা প্রথমে বিষয়টিকে নাকচ করে দেওয়ার চেষ্টা করেন।

পরে পুলিশেরই সিসি ক্যামেরায় ধারণ করা ভিডিও ফুটেজে লাঞ্ছনার প্রমাণ মেলে। এ ঘটনার ২৭ দিনেও সেই লাঞ্ছনাকারীদের চিহ্নিত করতে পারেনি পুলিশ। লাঞ্ছনার ঘটনার পরদিন থেকে রাজধানীসহ সারা দেশে বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও ছাত্রসংগঠন দোষী ব্যক্তিদের গ্রেপ্তার ও শাস্তির দাবিতে সভা-সমাবেশ, মানববন্ধনসহ বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করে আসছে।

“যতসংখ্যক পুলিশ আমাদের বাধা দিয়েছে, বর্ষবরণের অনুষ্ঠানে তারা থাকলে নারী লাঞ্ছনার ঘটনা ঘটত না,” জানান ছাত্র ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি হাসান তারেক।

ছাত্র ইউনিয়নের মিছিলে পুলিশি হামলার নিন্দা জানিয়েছে বিরোধী দল বিএনপি। ১১ মে  নয়াপল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে দলের মুখপাত্র আসাদুজ্জামান রিপন বলেন, “প্রতিবাদী মিছিলে আইন প্রয়োগকারী সংস্থা যে আক্রমণের ঘটনা ঘটিয়েছে, তা খুবই লজ্জাজনক। তাতে উল্টো লাঞ্ছনাকারীরাই উৎসাহিত হচ্ছে। শাসক দলের লাঞ্ছনাকারীরা এতে আশকারা পাবে।”

“পুলিশের এই বর্বর ও ন্যক্কারজনক কর্মসূচি আমাদের স্তম্ভিত করেছে। এমন ঘটনা নারীর গতিশীলতা থামিয়ে দেওয়া ও দেশের উন্নয়নের গতি ব্যাহত করার অপপ্রয়াস,” বেনারকে জানান ডা. ফওজিয়া মোসলেম, যিনি দেশের  ৬৮টি নারী, মানবাধিকার ও উন্নয়ন সংগঠনের প্লাটফরম সামাজিক প্রতিরোধ কমিটির সহ–সভাপতি।  

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।