শান্তির আহ্বান জানিয়ে সরকার ও বিরোধীদের সমাবেশ

ঢাকা থেকে শাহরিয়ার শরীফ
2016.01.05
BD-politics নয়া পল্টনের কার্যালয়ের সামনের রাস্তায় বিএনপির জনসভায় বক্তব্য রাখছেন খালেদা জিয়া। ৫ জানুয়ারি, ২০১৬
বেনার নিউজ

সরকারি দল আওয়ামী লীগ ও বিরোধী দল বিএনপির সমাবেশকে কেন্দ্র করে ঢাকায় সংঘাত বা সহিংসতার আশঙ্কা থাকলেও রাজনৈতিক কর্মসূচিগুলো সুষ্ঠুভাবে শেষ হয়েছে, যার পরিপ্রেক্ষিতে নাগরিক জীবনে স্বস্তি ফিরে এসেছে।

ওই দুটি সমাবেশে পারস্পরিক সমালোচনা থাকলেও সমঝোতার ইঙ্গিত দিয়েই তা শেষ হয়েছে। একপক্ষ আরেক পক্ষকে গণতন্ত্রের পথে আসার আহ্বান জানিয়েছে।

৫ জানুয়ারিকে বিএনপি ‘গণতন্ত্র হত্যা দিবস’ ও আওয়ামী লীগ ‘গণতন্ত্রের বিজয় দিবস’ ঘোষণা করে গতকাল রাজধানীতে পৃথক সমাবেশ আয়োজন করে, যা নিয়ে চাপা উত্তেজনা ছিল। ২০১৪ সালের ওই দিনে বিএনপি নির্বাচন বর্জন করলে আওয়ামী লীগ একতরফা নির্বাচনের মাধ্যমে সরকার গঠন করে।

গত বছর নির্বাচনের প্রথম বর্ষপূর্তিতে টানা প্রায় তিন মাস নাশকতা, সহিংসতা ও মানুষ পুড়িয়ে মারার ঘটনা ঘটে। সেই অভিজ্ঞতার আলোকে এবারও এক ধরনের ভয় ছিল।

মঙ্গলবার দিনভর শহর ছিল অনেকটাই ফাঁকা। যান চলাচল ছিল অন্যদিনের তুলনায় কম। মানুষের মুখে মুখে ছিল এই কর্মসূচি সংঘাতের দিকে যায় কিনা, এমন আশঙ্কা।

“যেকোনো বড় দুর্যোগ বা ধ্বংসের পর মেরামত বা নির্মাণের কাজ চলে। আমাদের দেশেও দুই পক্ষের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে যে ফাটল ও সংকট তৈরি হয়েছে সেখান থেকে বের হতে হবে,” গতকালের রাজনৈতিক কর্মসূচি রাজনীতিতে অগ্রগতি কিনা জানতে চাইলে বেনারকে এ কথা বলেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সরকার ও রাজনীতি বিভাগের অধ্যাপক আবদুল লতিফ মাসুম।

ওই অধ্যাপকের মতে, ২০১৯ সালেও যদি একটি সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন করার বিষয়ে সরকার জাতিকে আশ্বস্ত করতে পারে, শক্তি প্রয়োগের মনোভাব পরিহার করে সহনশীল হয়ে আস্থার পরিবেশ সৃষ্টি করে, তাহলে তা দেশের জন্য মঙ্গলজনক হবে।


গণতন্ত্র ফেরাতে খালেদা জিয়ার আহ্বান

অবিলম্বে আলোচনার মাধ্যমে নতুন জাতীয় নির্বাচনের পরিবেশ ও গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনার জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। তিনি বলেন, “আমরা চাই আলাপ-আলোচনা করে সমাধানের একটি পথ বের করতে, নিরপেক্ষ নির্বাচনের পরিবেশ ও গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনতে। এ জন্য একসঙ্গে কাজ করতে চাই। যেহেতু তারা জোর করে ক্ষমতায় বসে আছে, এ দায়িত্ব তাদের।”

দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দ্বিতীয় বর্ষপূর্তিতে মঙ্গলবার বিকেলে রাজধানীর নয়াপল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে আয়োজিত সমাবেশে খালেদা জিয়া এ আহ্বান জানান। ঢাকা মহানগর বিএনপি এ সমাবেশের আয়োজন করে।

খালেদা জিয়া বলেন, জ্বালাও-পোড়াও, ভাঙচুর নয়, তাঁরা সত্যিকারের গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনতে চান। তিনি সরকারের উদ্দেশে বলেন, “আর জুলুম-অত্যাচার নয়। গুম, খুন, জুলুম, অত্যাচার বন্ধ করে সঠিক পথে আসুন, গণতন্ত্রের পথে আসুন। না হলে কিন্তু জনগণ কখন জেগে উঠবে, বলা যায় না। তারপর এই জনগণকে কিন্তু ঠেকিয়ে রাখা যাবে না।”

‘কারও বিরুদ্ধে আমাদের রাগ-ক্ষোভ-দুঃখ নেই’ বলে উল্লেখ করে বিএনপির চেয়ারপারসন বলেন, “আসুন, সংলাপ করে, আলোচনা করে সমাধানের পথ বের করি, গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনি। এতে কারও ভয় পাওয়ার কোনো কারণ নেই। আপনারা ভালো থাকেন, ভদ্র থাকেন, তা হলে আপনাদের বিরুদ্ধে আমাদেরও ক্ষোভ থাকবে না। যা করেছেন, ভুল করেছেন, মনে মনে তা স্বীকার করে নেন।”

খালেদা জিয়া বলেন, বর্তমান সরকার কেবল গণতন্ত্রই হত্যা করেনি; মানুষ হত্যা করে, জোরজবরদস্তি ক্ষমতায় টিকে থেকে রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করছে। তিনি বলেন, “কথায় কথায় নতুন নতুন আইন, কেন? বিরোধী দলকে কীভাবে ফাঁদে ফেলা যায়, আটকানো যায়, সে জন্যই এই আইন। নতুন নতুন আইন করে আমাদের আটকানো যাবে না। যে আইনে জনগণের কল্যাণ হয় না, ব্যক্তিস্বার্থের জন্য হয়, তা মানুষ কখনো গ্রহণ করে না।”

গুম, খুন বন্ধ করতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর প্রতি আহ্বান জানিয়ে খালেদা জিয়া বলেন, “আপনাদের দিয়ে অন্যায় কাজ করাচ্ছে। এগুলো বন্ধ করুন। আমরা একসঙ্গে থাকতে চাই।” তিনি বলেন, বাংলাদেশ ছোট দেশ । সব ধর্মের মানুষ মিলেমিশে কাজ করলে দেশকে সুন্দরভাবে পৃথিবীর মানচিত্রে প্রতিষ্ঠা পাবে।

পৌর নির্বাচনে আওয়ামী লীগকে জয়ী করতে নির্বাচন কমিশন সব ধরনের ব্যবস্থা করেছে বলে অভিযোগ করে বিএনপির চেয়ারপারসন বলেন, আওয়ামী লীগ আর নির্বাচন কমিশন মিলে গণতন্ত্র হত্যা করেছে। তিনি বলেন, দলীয় প্রতীকে পৌরসভায় মেয়র নির্বাচন দিয়ে আওয়ামী লীগ নিজেদের জনপ্রিয়তা দেখাতে চেয়েছিল। জনপ্রিয়তা দেখানোর জন্য নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন হওয়া উচিত।

খালেদা জিয়া বলেন, আওয়ামী লীগের অধীনে কোনো সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়। প্রথম দুই দফার উপজেলা নির্বাচন ও পাঁচ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে প্রমাণ হয়েছে, নির্বাচন একটু সুষ্ঠু হলেই বিএনপি জয়ী হয়।

সমাবেশে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, গণতন্ত্র আজ কারাগারে রুদ্ধ। গত এক বছরে ৪৪০ জন হত্যার শিকার হয়েছেন। ২৬৭ জনকে গুম ও ৩৩৭ জনকে পঙ্গু করা হয়েছে।


শান্তিপূর্ণ রাজনীতি এগিয়ে নিন: সৈয়দ আশরাফ

শান্তিপূর্ণ রাজনীতি এগিয়ে নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম। তিনি বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে উদ্দেশ করে বলেন, “আসুন, আমরা শান্তিপূর্ণ রাজনীতি এগিয়ে নিয়ে যাই। দেশে নির্বাচন হবে, সুষ্ঠু নির্বাচন হবে। ওই নির্বাচনে একটি জীবনও হত্যার প্রয়োজন হবে না। জননেত্রী শেখ হাসিনা গণতন্ত্রে বিশ্বাস করেন। আমরাও সেই গণতন্ত্রে বিশ্বাস করি।”

মঙ্গলবার বায়তুল মোকাররম মসজিদের দক্ষিণ ফটকে আয়োজিত আওয়ামী লীগের সমাবেশে সৈয়দ আশরাফ এসব কথা বলেন।

২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের বর্ষপূর্তিকে আওয়ামী লীগ ‘গণতন্ত্রের বিজয় দিবস’ হিসেবে পালন করে। গতকাল এ উপলক্ষে ঢাকায় দুটি সমাবেশ করে দলটি। অপর সমাবেশটি হয়েছে ধানমন্ডির রাসেল স্কয়ারে।

গত বছরের ৫ জানুয়ারিকে কেন্দ্র করে বিএনপির টানা হরতাল-অবরোধের সমালোচনা করে সৈয়দ আশরাফ বলেন, কিসের জন্য এ আন্দোলন? ৬৪ জনকে হত্যা করলেন, দেড় হাজার মানুষকে আহত করলেন। অর্থনীতির ক্ষতি হলো ১৭ হাজার ১৫০ কোটি টাকার। গাড়ি পোড়ালেন ৭০০। পরীক্ষা বন্ধ করলেন। কিসের জন্য? গণতন্ত্রের জন্য? গণতন্ত্রের জন্য মানুষ হত্যা করতে হয় না। ৭০০ গাড়ি পোড়াতে হয় না।

খালেদা জিয়াকে উদ্দেশ করে আশরাফ বলেন, “আপনি বাংলাদেশকে অকার্যকর করতে চেয়েছিলেন, যাতে আমরা দেশকে এগিয়ে নিয়ে যেতে না পারি। এ জন্য আপনি রক্তের হোলিখেলা খেলেছিলেন। বাংলাদেশের মানুষ আপনার অপকর্ম কোনো দিন ভুলে যাবে না।”

বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ বিএনপির নেত্রীর উদ্দেশে বলেন, “২০১৯ সালের ২৯ জানুয়ারির আগের ৯০ দিনের মধ্যে যেকোনো দিন নির্বাচন হবে। আপনার ভাবে বোঝা যায়, আপনি নির্বাচন করবেন। আপনি বলেছেন আন্দোলনের মধ্যে দিয়ে নয়, নির্বাচনের মধ্য দিয়ে সরকারের পতন ঘটাবেন। বেগম খালেদা জিয়া, আমরা ওই দিনটার জন্য অপেক্ষায় আছি।”

দুই দলের কর্মসূচি সম্পর্কে জানতে চাইলে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা হাফিজউদ্দিন আহমেদ খান বেনারকে বলেন, “বিএনপি বেশ কিছুদিন নরম সুরে কথা বলছে, হরতাল বা অবরোধ করছে না। আগেই তারা শান্তিপূর্ণ সমাবেশের কথা বলেছে। এগুলো ভালো লক্ষণ।”  

তবে তাঁর মতে, এর পাশাপাশি সরকারকেও তার অবস্থান ও মনোভাব পরিবর্তন করতে হবে। বিরোধী দলকে নিয়ে আলোচনা বা সংলাপে বসে কয়েকটি মৌলিক বিষয়ে ঐকমত্যে পৌঁছাতে হবে।

গত জানুয়ারি পরবর্তী রাজনৈতিক সংকটে গঠিত কয়েকজন বিশিষ্ট নাগরিকের সংগঠন উদ্বিগ্ন নাগরিক সমাজের একজন ছিলেন হাফিজউদ্দিন খান।

ওই সংগঠনটি দেশের রাজনীতি ও শাসনব্যবস্থার উন্নয়নে একদিকে সংবিধানের কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় সংশোধন এবং কমপক্ষে আটটি সাংবিধানিক ও বিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠান সংস্কারের কথা বলেছিল। এগুলো হচ্ছে জাতীয় সংসদ, সুপ্রিম কোর্ট, নির্বাচন কমিশন, সরকারি কর্মকমিশন, দুর্নীতি দমন কমিশন, তথ্য কমিশন, মানবাধিকার কমিশন ও আমলাতন্ত্র।   

এ প্রসঙ্গে হাফিজউদ্দিন বলেন, সংলাপ বা সংস্কার শুধু নির্বাচনকেন্দ্রিক হলেই চলবে না। দেশে এখন গণতন্ত্র নেই, নির্বাচিত একনায়কতন্ত্র চলছে। এ জন্য সাংবিধানিক সমস্যা যেমন দায়ী, তেমনি দায়ী রাজনৈতিক দলগুলোর কারসাজি। এই অবস্থা থেকে বের হয়ে প্রতিষ্ঠানগুলো সংস্কার বা পুনর্গঠন ছাড়া সুশাসন নিশ্চিত করার আর কোনো উপায় নেই।   


মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।