সিটি নির্বাচনে বেশ কিছু প্রার্থী মামলার আসামী ও ঋণখেলাপী

ঢাকা থেকে শাহরিয়ার শরীফ
2015.04.02
BD-politics রিটার্নিং অফিসারের কার্যালয়ে ঢাকা-উত্তর সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনের বাছাই-এর কাজ চলছে। ২ এপ্রিল, ২০১৫
বেনার নিউজ

প্রধান বিরোধী দল বিএনপি আন্দোলন-অবরোধ চালু রেখেও আসন্ন সিটি নির্বাচনে প্রার্থী দিয়েছে। এতে ঢাকা ও চট্টগ্রামে নির্বাচনের ডামাডোল বেজে উঠেছে, জনজীবনে নেমেছে কিছুটা স্বস্তি।
রাজধানী ঢাকার দুটি এবং চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচন নিয়ে দেশের রাজনীতি সরগরম হয়ে উঠেছে। কিন্তু এই নির্বাচনে মেয়র ও কাউন্সিলর পদে মনোনয়ন ফরম জমা দেওয়া শতাধিক প্রার্থী ঋণখেলাপী ও বিভিন্ন মামলার আসামী।

বিশ্লেষণে দেখা গেছে, আসামীদের মধ্যে রাজনৈতিক কারণে হয়রাণিমূলক মামলা যেমন আছে, তেমনি আছে আসামী হওয়ার মত সত্যিকার অপরাধী প্রার্থীও।

“প্রার্থীতা বাতিল হওয়ার মুল কারণ মামলার আসামী হওয়া ও ঋণখেলাপী থাকা। এ ছাড়াও রয়েছে বিল খেলাপী, শিক্ষাগত যোগ্যতায় ঘাটতি থাকাসহ বিভিন্ন কারণ,” বেনারকে জানান ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের রিটার্নিং কর্মকর্তা মিহির সারোয়ার মোর্শেদ।

ঢাকার দুটিসহ তিন সিটি করপোরেশনে মেয়র, কাউন্সিলর পদে ২৯ মার্চ ছিল মনোনয়নপত্র দাখিলের শেষ দিন। ঢাকার দুই সিটিতে বৈধ মেয়র প্রার্থীর সংখ্যা ৪২। চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচনে মনোনয়নপত্র যাচাই-বাছাইয়ে মেয়র পদে ১২ জনের প্রার্থিতা বৈধ ঘোষণা করা হয়েছে।

ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনে ৯৩ টি কাউন্সিলর পদে মনোনয়ন ফরম জমা দিয়েছিলেন এক হাজার ৩১৩ প্রার্থী। তাঁদের মধ্যে গতকাল ১৯৯ জনের মনোনয়ন অবৈধ ঘোষণা করা হয়েছে।
গতকাল ২ এপ্রিল ঢাকা উত্তরের  রিটার্নিং কর্মকর্তার কার্যালয় থেকে  ২৮ নম্বর ওয়ার্ডের   কাউন্সিলর   পদপ্রার্থী   সাইদুর   রহমানকে   গ্রেপ্তার   করেছে   পুলিশ।  গ্রেপ্তারের আগে   তাঁর   বিরুদ্ধে   মামলা   রয়েছে   বলে   রিটার্নিং   কর্মকর্তাকে   জানায়   পুলিশ।   এরপর   তাকে   সেখান   থেকে   গ্রেপ্তার   করা   হয়।

সাইদুর   রহমান   নিজেকে   বিএনপির নেতৃত্বাধীন ২০   দলীয়   জোটের   কর্মী   বলে   দাবি   করেন।   শের - এ - বাংলানগর   থানার   ওসি  ( তদন্ত )  সাব্বির   গ্রেপ্তারের   বিষয়টি   নিশ্চিত   করেছেন।

“ আমি  ‘শক্ত   প্রতিদ্বন্দ্বী’  হওয়ায়   আমার   বিরুদ্ধে   ষড়যন্ত্র   করছে   একটি   মহল।  আমি কোনো   অপরাধে   জড়িত   নই,”  সাংবাদিকদের জানান সাইদুর   রহমান।

রিটার্নিং   কর্মকর্তার কার্যালয়   সূত্র   জানায়,  সাইদুরের  বিরুদ্ধে   হত্যা   মামলা   ও   পুলিশের   ওপর   আক্রমনের   একটি   মামলা   রয়েছে।   এই   তথ্য    হলফনামায়   উল্লেখ   না   করায়   তার   মনোয়নপত্রও   বাতিল   করা হয়েছে।   সাইদুর   জানান,  তার বিরুদ্ধে এ রকম কোনো মামলা হওয়ার কথা তিনি জানেন না। তাঁর বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানাও জারি করা হয়নি।

এর আগে মামলার সাজাপ্রাপ্ত আসামী নাসিরউদ্দিন আহম্মেদ পিন্টুর মনোনয়ন বাতিল করে নির্বাচন কমিশন। তিনি ২০ দলীয় জোটের সম্ভাব্য মেয়র প্রার্থী ছিলেন। পিন্টুর মনোনয়নপত্র বাতিল করা হয় তাঁর বিরুদ্ধে থাকা মামলার তথ্যাদি যাথাযথভাবে উল্লেখ না করায়।

গত ২৯ মার্চ ঘোড়ার গাড়িতে করে মনোনয়নপত্র জমা দিতে গিয়ে আচরণবিধি লঙ্ঘন করায় নাইমকে ২০ হাজার টাকা জরিমানা করেছিলেন নির্বাচন কমিশন পরিচালিত ভ্রাম্যমাণ আদালত।
ঋণখেলাপের দায়ে নাইমের মনোনয়নপত্র গতকাল বাতিল হয়েছে।

গতকাল সরেজমিন দেখা যায়, ১৯ নম্বর ওয়ার্ডের (সিদ্ধেশ্বরী) কাউন্সিলর প্রার্থী কবিরউদ্দিন আহমেদ, মো. আবুল বাশারসহ কয়েকজনের প্রার্থীতা বাতিল করা হয় ঋণখেলাপী হওয়ায়।

একই ওয়ার্ডের প্রার্থী সৈয়দ মাহমুদুল হক শিক্ষাগত যোগ্যতার কথা উল্লেখ করলেও মাধ্যমিকের সনদ জমা দেননি। মাহমুদুল জানান, তাঁর সনদ হারিয়ে গেছে। সাধারণ ডায়েরি করে সেই কপি জমা দিয়েছেন। নির্বাচন কমিশন জানায়, এটা গ্রহণযোগ্য নয়। সনদ সংগ্রহ করে জমা দিলে তাঁর প্রার্থীতা বৈধ করার জন্য নির্বাচন কর্মকর্তারা সুপারিশ করবেন বলে জানান।  

২০ নম্বর ওয়ার্ডের প্রার্থী জিএম আতিকুর রহমান একটি ঋণের নিশ্চয়তা দানকারী হিসেবে খেলাপী হয়ে বাছাইয়ে বাদ পড়েন। তিনি জানান, ৩১ মার্চ তিনি ঋণ শোধ করেছেন। কিন্তু নির্বাচন কমিশন জানায়, তফসিল অনুযায়ী ২৯ মার্চ ছিল শেষদিন, ২৮ মার্চ তাঁর ঋণ পরিশোধ হওয়ার কথা ছিল।

একই কারণে বাদ পড়েন ওই ওয়ার্ডের আরেক প্রার্থী রেজাউল করিম রেজা ও শফিকুল ইসলাম।

ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের সরকার সমর্থক মেয়রপ্রার্থী সাঈদ খোকনের নামে কোনো ফৌজদারী মামলা নেই। তবে অতীতে পাঁচটি মামলা ছিল।
বিরোধী জোট সমর্থক প্রার্থী মির্জা আব্বাসের নামে বর্তমানে ফৌজদারী মামলার সংখ্যা ৩৭টি ও অতীতে ছিল ২৪টি। দক্ষিণের তিন প্রার্থীর মধ্যে সবচেয়ে ধনী মির্জা আব্বাস। তাঁর বার্ষিক আয় প্রায আট কোটি টাকা।
স্নাতক শিক্ষাগত যোগ্যতার মির্জা আব্বাসের দায়-দেনার মোট পরিমাণ ৭৫ কোটি ৬৫ লাখ ২৫ হাজার ৯০৩ টাকা।

এ ছাড়া বিএনপির অপর নেতা আব্দুস সালামের অতীতে ফৌজদারী মামলা না থাকলেও বর্তমানে তিনটি ফৌজদারী মামলা তদন্তাধীন।
ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র প্রার্থী আনিসুল হক হলফনামায় জানিয়েছেন, তার নামে কোনো মামলা নেই। তিনি  ৭৫ লাখ ৮২ হাজার টাকা বার্ষিক আয়ের তথ্য দিয়েছেন। আনিসুল হকের বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের নামে ঋণের পরিমান ১৫১ কোটি টাকার বেশি এবং এর সবই নিয়মিত ঋণ বলে তিনি উল্লেখ করেছেন। এছাড়া তার জামানতবিহীন দায়ের পরিমাণ ৫ কোটি ২৯ লাখ টাকা।

হলফনামায় দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, মিন্টুর বিরুদ্ধে ১৩টি মামলা রয়েছে, যার মধ্যে তিনি পাঁচটিতে জামিনে রয়েছেন। বাকিগুলো ‘পেন্ডিং’ রয়েছে বলে তিনি কমিশনকে জানিয়েছেন।
এছাড়া আগের তিন মামলার মধ্যে দুটিতে অব্যাহতি পেয়েছেন মিন্টু, একটির কার্যক্রম হাই কোর্টের আদেশে স্থগিত।

৫ কোটি ১৮ লাখ টাকা বার্ষিক আয়ের তথ্য মিন্টু হলফনামায় দিয়েছেন। তার বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের নামে ঋণের পরিমাণ ২২৯ কোটি ৪৫ লাখ টাকা। আর বিভিন্ন খাতে মিন্টুর দায়ের পরিমাণ দেখানো হয়েছে ৬ কোটি টাকা।
ঢাকায় বিএনপির চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা আবদুল আউয়াল মিন্টুর মনোনয়নপত্র বাতিল হয়েছে তাঁর প্রার্থিতার সমর্থনকারী আবদুর রাজ্জাক ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন এলাকার ভোটার না হওয়ায়।

তবে পুলিশের প্রতিনিধি মিরাশ উদ্দিন রিটার্নিং কর্মকর্তার অনুমতি নিয়ে বলেন, মিন্টুর বিরুদ্ধে গুরুতর শাস্তিযোগ্য অপরাধের ১২টি মামলা রয়েছে। এর মধ্যে পাঁচটি মামলায় তিনি জামিনে আছেন। আর সাতটি মামলায় তিনি তদন্তাধীন ফেরার। পুলিশ তাঁকে খুঁজছে। আইনের চোখে তিনি পলাতক।

এ সময় মিন্টুর পক্ষে একজন দাঁড়িয়ে বলেন, আদালতের ওয়ারেন্ট ছাড়া কেউ পলাতক হতে পারেন না। আর দোষী সাব্যস্ত হওয়ার আগ পর্যন্ত তিনি প্রার্থী হওয়ার যোগ্য।
এরপর রিটার্নিং কর্মকর্তা শাহ আলম পুলিশকে তাঁদের বক্তব্য লিখিতভাবে জমা দেওয়ার পরামর্শ দেন। পাশাপাশি তিনি প্রশ্ন করেন, ওয়ারেন্ট ছাড়া কীভাবে মিন্টু পলাতক হন? জবাবে পুলিশের প্রতিনিধি বলেন, পুলিশের ক্ষমতা আছে বিনা ওয়ারেন্টে গ্রেপ্তার করার।

নির্বাচনী তফসিল অনুযায়ী আগামী ৯ এপ্রিল পর্যন্ত প্রার্থীতা প্রত্যাহারের সুযোগ রয়েছে। প্রকৃতপক্ষে তারপরই জানা যাবে আগামী ২৮ এপ্রিল অনুষ্ঠেয় এই দুটি সিটি করপোরেশন নির্বাচনে চূড়ান্ত প্রার্থীসংখ্যা।

২০১১ সালের ১ ডিসেম্বর দায়িত্ব হস্তান্তর করেন ঢাকা সিটি করপোরেশনের নির্বাচিত মেয়র সাদেক হোসেন খোকা। এরপর দুভাগ করে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন ও ঢাকা দক্ষিন সিটি করপোরেশন করা হয়। দুজন সরকারি কর্মকর্তাকে দুই সিটি করপোরেশনের দায়িত্ব দেওয়া হয়। একেকজন দায়িত্ব পালন করেছেন ছয় মাস মেয়াদের জন্য। আর এভাবেই কেটে গেছে প্রায় সাড়ে তিন বছর।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।