সীমিত গণতন্ত্রের পথে সরকার, উন্নয়ন করে গণতন্ত্রের ঘাটতি পুষাতে চায়
2015.05.21

সিঙ্গাপুর ও মালয়েশিয়ার বিদ্যমান গণতন্ত্রের সঙ্গে বাংলাদেশের গণতন্ত্রের তুলনা নিয়ে রাজনীতিতে আলোচনা-সমালোচনার ঝড় উঠেছে। বাংলাদেশের সরকারি দল আওয়ামী লীগ ও বিরোধী দল বিএনপির নেতারা এ নিয়ে পরস্পরবিরোধী বক্তব্য দিচ্ছেন।
রাজনীতি সচেতন ব্যক্তিরা আঁচ করতে পারছেন যে, উন্নয়ন দিয়ে গণতন্ত্রের ঘাটতি পুষিয়ে দিতে চাইছে বর্তমান সরকার। সরকারের বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে ও সরকারের মন্ত্রী বা আওয়ামী লীগ নেতাদের বক্তব্যে এমন আভাস পাওয়া যাচ্ছে।
গত ১৬ মে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ১৪ দলের সমন্বয়কারী মোহাম্মদ নাসিম বলেন, “আমরা গণতন্ত্রে বিশ্বাসী। তবে বেশি গণতন্ত্রে বিশ্বাস করি না। সিঙ্গাপুর এবং মালয়েশিয়া যে পথে এগিয়ে গেছে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশেও সে পথে গণতন্ত্র চলবে।”
মোহাম্মদ নাসিম সরকারের স্বাস্থ্যমন্ত্রী এবং আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য। গণতন্ত্র নিয়ে সরকারের এমন মনোভাব নিয়ে গত কয়েক মাস আলোচনা চললেও তাঁর এ বক্তব্যের মাধ্যমে তা আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ পেল।
“গণতন্ত্র মানে গণতন্ত্র, এর কোনো বিকল্প হয় না।অন্য কোনও কিছু দিয়ে গণতন্ত্রকে খাটো বা সীমাবদ্ধ করা যায় না,” বেনারকে জানান সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার।
তাঁর মতে, আফগানিস্তানে কিন্তু তালেবানদের উত্থানের বড় কারণ ছিল দুর্নীতি ও নির্বাচনে কারচুপি। মানুষ যখন ন্যায়বিচার পায় না, তখন ধর্মাশ্রয়ী হয়। অসুস্থ রাজনৈতিক পরিবেশ, দুর্নীতি ও দুঃশাসন ধর্মীয় উগ্রবাদকে উৎসাহিত করে।
অবশ্য মোহাম্মদ নাসিম বলেন, “যে গণতন্ত্র মানুষ পুড়িয়ে মারে। যে গণতন্ত্র পেট্রল বোমা মারে। যে গণতন্ত্র বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের আশ্রয় দেয়। সে গণতন্ত্রে আমরা বিশ্বাস করি না।”
শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ২০১৯ সালের নির্বাচনে বিএনপিকে ‘হোয়াইট ওয়াশ’ করা হবে বলেও জানান স্বাস্থ্যমন্ত্রী।তাঁর মতে, “আমাদের একমাত্র লক্ষ্য ২০১৯ সালে জনগণের রায় নেওয়া।”
“গোটা জাতি এবং কূটনীতিকরা জানেন যে, আওয়ামী লীগ সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা রক্ষার কথা বলে ২০১৪ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি নির্বাচন করেছিল। কিন্তু নির্বাচনের পর আলোচনা বা সংলাপ দূরে থাক, ২০১৯ সাল দেখিয়ে দেওয়াটা রাজনৈতিক প্রতারণার শামিল.” বেনারকে জানান বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মাহবুবুর রহমান।
এদিকে সরকার গণতন্ত্রের বিপরীতে উন্নয়নকে দাঁড় করানোর চেষ্টা করছে বলেও অভিযোগ করেছে বিএনপি। দলটির অভিযোগ, উন্নয়নের নামে সরকার দেশের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে ধ্বংস করছে। গত ১৮ মে রাজধানীর নয়াপল্টনে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে বিএনপির আন্তর্জাতিক-বিষয়ক সম্পাদক আসাদুজ্জামান রিপন এই অভিযোগ করেন।
এর একদিন আগে ১৪ দলের মুখপাত্র ও স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম গণতন্ত্র নিয়ে মালয়েশিয়া ও সিঙ্গাপুরের দৃষ্টান্ত অনুসরণ করা প্রসঙ্গে যে বক্তব্য দেন তারই আনুষ্ঠানিক জবাব ছিল এটি।
মোহাম্মদ নাসিমের বক্তব্যের সমালোচনা করে আসাদুজ্জামান বলেন, “উন্নয়নের বিপরীতে গণতন্ত্রকে দাঁড় করানোর চেষ্টা করা হচ্ছে। গণতন্ত্র কখনো উন্নয়নের প্রতিপক্ষ হতে পারে না। এটা অত্যন্ত ভয়াবহ ও স্বৈরশাসকের চিন্তাভাবনা।”
আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ১৪-দলীয় জোট সীমিত গণতন্ত্রের নামে মানুষের সাংবিধানিক অধিকারকে আইনি কাঠামোতে এনে আরও সংকুচিত করতে চায় কি না, তা স্পষ্ট করার দাবি জানান আসাদুজ্জামান।
মালয়েশিয়া আর বাংলাদেশের প্রেক্ষাপট এক নয়-এ কথা উল্লেখ করে বিএনপির ওই নেতা বলেন, গণতান্ত্রিক চেতনা নিয়েই বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছিল। আওয়ামী লীগ জনগণের ক্ষমতায় বিশ্বাস করে না বলেই কম গণতন্ত্রের কথা বলছে।
তবে সুশীল সমাজের অনেকেই মনে করছেন, গণতন্ত্র নিয়ে সরকারের এমন মনোভাব ঠিক নয়। গণতন্ত্র ছাড়া উন্নয়ন হতে পারে কিনা, সেই প্রশ্নটি নিয়ে গত কয়েক মাস রাজনীতি ও অর্থনীতিতে আলোচনা চলছে। আবার উন্নয়নের সঙ্গে দুর্নীতির প্রসঙ্গগুলোও আসছে ঘুরেফিরে।
দেশি–বিদেশি অর্থে সরকার ফাস্ট ট্র্যাকভুক্ত আটটি প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। এই কর্মসূচিভুক্ত আগের ছয়টি প্রকল্প হচ্ছে পদ্মা সেতু, কক্সবাজারের সোনাদিয়ায় গভীর সমুদ্রবন্দর, ঢাকায় মেট্রোরেল, বাগেরহাটের রামপালে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র; পাবনার রূপপুরে পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র এবং এলএনজি (তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস) আমদানির জন্য কক্সবাজারের মহেশখালীতে টার্মিনাল নির্মাণ।
এরপর সরকার মাতারবাড়ী সমন্বিত বিদ্যুৎকেন্দ্র এবং পায়রা বন্দর প্রকল্প অগ্রাধিকার ভিত্তিতে বাস্তবায়নের জন্য ‘ফাস্ট ট্র্যাক’ কর্মসূচির অন্তর্ভুক্ত করার সিদ্ধান্ত নেয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ‘ফাস্ট ট্র্যাক প্রজেক্ট মনিটরিং টাস্কফোর্স’ কাজ করছে। এর সমন্বয় করছেন প্রধানমন্ত্রীর মুখ্যসচিব আবুল কালাম আজাদ।
গণতন্ত্র ছাড়া উন্নয়ন হতে পারে কি না—এমন প্রশ্নের জবাবে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা জামিলুর রেজা চৌধুরী বেনারকে বলেন, “বাংলাদেশের মানুষের ডিএনএতে জড়িয়ে আছে গণতন্ত্র। সিঙ্গাপুরের দৃষ্টান্ত প্রসঙ্গে তিনি বলেন, সেখানেও সরকারি দলের জনপ্রিয়তা অনেক কমেছে, যা গণতন্ত্রের প্রতি ওই দেশের মানুষের আগ্রহের বহিঃপ্রকাশ।”
গণতন্ত্র ছাড়া উন্নয়ন হতে পারে কি না-এমন প্রশ্নের জবাবে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা এম হাফিজউদ্দিন খান বেনারকে বলেন, “উন্নয়ন মানে রাস্তাঘাট, বড় প্রকল্প বা শুধু সেতু-কালভার্ট নয়। সমাজে শান্তি-শৃঙ্খলা, সুশাসন তথা আইনের শাসন ছাড়া কোনো উন্নয়নের সুফল মানুষ পাবে না। আর এ জন্য স্বচ্ছ ও জবাবদিহিমূলক গণতন্ত্র দরকার।”