বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী ধরাছোঁয়ার বাইরে, অপ্রতিদ্বন্দ্বী নেত্রী হয়ে উঠেছেন
2015.06.22
সাম্প্রতিক রাজনৈতিক লড়াই-এ বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বীদের পরাস্ত করার পর উঠে গেছেন আরো শক্ত অবস্থানে এবং হয়েছেন প্রবল আত্নবিশ্বাসী।
২০১৪ সালের জানুয়ারিতে ব্যাপক বিতর্কিত নির্বাচনে পূনরায় ক্ষমতায় আসীন হবার পর বিরোধী দলের ডাকা অবরাধ ও হরতালের মতো কর্মসূচিতে একের পর এক বাঁধা ও সংকট পাড়ি দিয়ে ক্ষমতায় টিকে গেছে তাঁর সরকার। যে কর্মসূচিতে প্রায় ২০০ মানুষের মৃত্যু ঘটেছে এবং দেশের অর্থনীতিতে ঘটেছে শত শত কোটি টাকার ক্ষয়ক্ষতি।
আইন ও সুশাসনের জন্য আন্দোলনকারী নাগরিক সংস্থা ‘সুজন’এর সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার বেনার নিউজকে বলেন, “তিনি তাঁর রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বীকে কার্যত নিশ্চিহ্ন করেছেন এবং অদূর ভবিষ্যতে তাঁর কর্তৃত্বকে শক্ত চ্যালেঞ্জ জানানোর আর কাউকে দেখা যাচ্ছে না”। তিনি বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়া ও সহযোগী জামায়াতে ইসলামীর কথা বলছিলেন।
মুলত হাসিনাকে ক্ষমতা থেকে সরানোর লক্ষ্যে দীর্ঘ অবরোধ ও হরতাল প্রচেষ্টা শোচনীয় ভাবে ব্যর্থ হবার পর বিএনপি ও জামায়ত নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার চেষ্টা করছে।
বিরোধী শিবির দূ্রাবস্থায়
দূর্নীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহারের অভিযোগে অজস্র মামলা ও চার্জশীটের যাতাকলে আটকে পড়ে আছেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া। জেল বা সাজা থেকে বাঁচবার জন্য অধিকাংশ সময় তিনি আইনজীবীদের সঙ্গে কাটাচ্ছেন।
গত বৃহস্প্রতিবার তিনি উচ্চ আদালতে নাইকো’র একটি দূর্নীতির মামলা খারিজের আবেদন আপিল করে হেরে গেছেন, আদালত তাঁকে বিচারাধীন আদালতে ২ মাসের মধ্যে আত্নসমর্পন করতে বলেছেন।
খালেদা জিয়া যখন ২০০৬ সালে প্রধানমন্ত্রী ছিলেন কানাডার গ্যাস উত্তোলনকারী কোম্পানী নাইকোকে কাজ পাইয়ে দেয়ার ফলে রাষ্ট্রের ক্ষতি হয়েছে ১৩৭ কোটি টাকা। এই অভিযোগে দূর্নীতি দমন কমিশন-দুদক ২০০৭ সালে খালেদা ও আরো ১১ জনের বিরুদ্ধে মামলাটি দায়ের করে।
খালেদা জিয়ার এহেন অবস্থার পাশাপাশি বিএনপির অধিকাংশ নেতা হয় কারাগারে অথবা গ্রেফতার এড়ানোর জন্য পালিয়ে বেড়াচ্ছেন ফলে দলের কার্যক্রম একেবারে নিস্ক্রিয় হয়ে পড়েছে।
বিএনপির গুরত্তপূর্ণ সহযোগী জামায়াতও কঠিন পরীক্ষার মুখোমুখি। তাদের দুই নেতাকে যুদ্ধাপরাধের দায়ে ফাঁসি দেয়া হয়েছে, দলের আমীর মতিউর রহমান নিজামী সহ আরো কয়েকজন শীর্ষস্থানীয় নেতাকে মৃত্যুদন্ড দেয়া হয়েছে, যেগুলি আপিলে শুনানীর অপেক্ষায়।
জামায়াতের জন্য আরো দুঃসংবাদ হচ্ছে, আইন মন্ত্রী গত এপ্রিলে সংসদে জানান, ৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধের বিরোধিতার জন্য সরকার নতুন আইন করে দলটি নিষিদ্ধ করার উদ্যোগ নিতে যাচ্ছে।
গতমাসে এক সেমিনারে সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও নির্দলীয় একটি গ্রুপের প্রধান এটিএম শামসুল হুদা বলেন, “কোনো সন্দেহ নেই শেখ হাসিনা অত্যন্ত ক্ষমতাবান নেত্রী হিসেবে উঠে এসেছেন, কিন্তু একজনের হাতে ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত হওয়া দেশের জন্য ভালো নয়”।
সমালোচকরা নীরব
তিনি অন্যান্য দল-নিরপেক্ষ বিশ্লেষক ও অভিমতকারীদের সুরেই বক্তব্য দেন, যারা দেশের গনতন্ত্রের ভবিষ্যত নিয়ে আশা হারিয়েছেন।
হতাশার সুরে সুজনের মজুমদার বলেন, “এটা খুবই দুঃখজনক পরিস্থিতি কিন্তু দেশের সুস্থ উন্নয়নের জন্য গনন্ত্রের কোনো বিকল্প নেই”।
এই হতাশা এখন ছড়িয়ে পড়েছে অধিকাংশ বিশ্লেষক ও সাংবাদিকদের মধ্যেও। তারা খারাপ কোনো পরিনতির ভয়ে হাসিনার সমালোচনা করা বন্ধ রেখেছেন।
প্রধানমন্ত্রীর দুঃসাহসী সমালোচনার জন্য আমার দেশ পত্রিকার সম্পাদক মাহমুদুর রহমান বিনা বিচারে ৩ বছর ধরে কারাগারে রয়েছেন।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন মতামতকারী লেখক বেনারকে জানান, “এটা খুব পরিস্কার যে আমরা কর্তৃত্ববাদী শাসনের দিকে যাচ্ছি। যেখানে বিরোধীদলের অবস্থা শোচনীয়, আন্তর্জাতিক মহল নির্বিকার সেখানে তাঁর কর্তৃত্বকে চ্যালেঞ্জ করার কেই নেই”।
আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়
আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে বাংলাদেশের জন্য দু’টি দেশ প্রধানত গুরুত্বপুর্ণ, যুক্তরাষ্ট্র এবং ভারত। মনে করা হচ্ছে যে, এই দু’দেশই বাংলাদেশের বর্তমান অবস্থা মেনে নিয়েছে।
জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানী হারুন-অর-রশীদ বেনার নিউজকে বলেন, “ভারত সব সময় তাঁর পাশে দাঁড়িয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের চূড়ান্ত হিসাব হচ্ছে, গতবছরের বিতর্কিত নির্বাচন সত্তেও হাসিনা সরকার জঙ্গি মোকাবেলায় ভালো করছে”।
তিনি আরো বলেন, “ ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী সাম্প্রতিককালে বাংলাদেশ সফর করে যাবার পর হাসিনার অবস্থান আরেকদফা জোরালো হলো। জঙ্গিদের ব্যাপারে তাঁর শুন্য-সহনশীলতার নীতি প্রকাশ্যেই প্রশংসিত হয়েছে, বিশেষ করে ভারতের বিচ্ছিন্নতাবাদীদের বিতাড়নের ক্ষেত্রে তাঁর ভুমিকার জন্য”।
অর্থনৈতিক অগ্রগতি
গনন্ত্রের চর্চাহীনতার জন্য বাংলাদেশের সাধারন মানুষের খুব একটা অভিযোগ নেই।এর বিপরীতে আগুন বোমার আতঙ্ক ও সন্ত্রস্ত অবস্থা এখন না থাকায় তাদের জীবন যাপনে সমস্যা হচ্ছেনা। সাম্প্রতিক বছরগুলিতে যে অবস্থার মধ্য দিয়ে তারা এসেছে, তার অবসান ঘটেছে।
ঢাকার কাওরানবাজারের এক মুদি দোকানদার আব্দুস সামাদ বেনারকে বলেন, “ কে ক্ষমতায় আছেন আমাদের কাছে এটা কোনো ব্যাপার না, আমারা শান্তিপূর্ণ পরিবেশে কাজ করে খেতে চাই এবং জীবন চালাতে চাই”।
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, বাংলাদেশের জন্মের পর ৪৪ বছর ধরে নিরবিচ্ছিন্নভাবে অস্থিরতা চলে আসছে। সাধারন মানুষ গনতন্ত্রের ব্যাপারে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছে।
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের নির্বাহী পরিচালক মুস্তাফিজুর রহমান বেনারকে বলেন, “এটা সত্য যে গনতন্ত্রের নামে অব্যাহত সহিংসতায় উন্নয়ন বিপর্যস্ত হয়েছে, বাণিজ্য ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে, বিদেশী বিনিয়োগ নিরুৎসাহিত হয়েছে এবং মানুষ হতাশ হয়েছে”।
মালয়েশিয়া ও সিঙ্গাপুরের উদাহরণ টেনে বলেন, পশ্চিমা ধাঁচের গনতন্ত্র ছাড়াই সেখানে উন্নয়ন ঘটেছে। তার মতে, “ অর্থনীতির সব শুচকেই দেখা যাচ্ছে বাংলাদেশে অগ্রগতি হচ্ছে এবং সাধারন মানুষ সার্বিক উন্নয়ন থেকে লাভবান হচ্ছে। কিন্তু আমরা এখনো চাই সুস্থ একটি সমাজ গঠনের জন্য এখানে অংশগ্রহনমুলক গনতন্ত্রের চর্চা থাকুক”।
ক্ষমতাসীন নেতারা ওই দুই দেশের মডেলে বাংলাদেশের উন্নয়ন করতে চান। গতমাসে স্বাস্থ্য মন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম দলীয় সভায় এক বক্তব্যে বলেন, “আমরা গনতন্ত্র চাই, তবে বেশি গনতন্ত্র চাই না।আমরা মালয়েশিয়া-সিঙ্গাপুরের মডেলে দ্রুত উন্নতি ঘটাতে চাই”।
সরকারী হিসাব মতে, রাজনৈতিক অস্থিরতা সত্তেও দেশের জিডিপি গ্রোথ ৬ ভাগের উপরে। বৈদেশিক মুদ্রার মজুদ ২৫ শত কোটি ডলার, যা সর্বকালের সর্বোচ্চ রেকর্ড। বিদ্যুৎ উৎপাদন ২০১০-এ ৫০০০ মেগাওয়াট থেকে ১১,৫০০ মেগাওয়াটে উন্নীত হয়েছে।এই সময়ে বিদ্যুতের ঘাটতি বলতে ছিলো না। ৫ বছর আগে যা ছিলো অচিন্তনীয়।
আরো গুরুত্তপূর্ণ অগ্রগতির ঘটনা হলো, বিপুল জনসংখ্যার দেশ একসময় খাদ্য আমদানীর উপর নির্ভরশীল ছিলো, এখন ইতিহাসে প্রথমবারের মতো খাদ্য রফতানীর দেশে রুপান্তরিত হয়েছে।
ঢাকা থেকে শাহরিয়ার শরীফ এই প্রতিবেদনে অবদান রেখেছেন।