খালেদা বার্তা দিলেন- জামায়াতকে সঙ্গে নিয়েই পথ চলবে বিএনপি
2015.06.30

বিএনপির সঙ্গে জামায়াতের সম্পর্ক ছিন্ন করা নিয়ে ব্যাপক আলোচনা ও আন্তর্জাতিক চাপের মধ্যে জামায়াতের ইফতারে খালেদা জিয়ার যোগদানের বিষয়টি রাজনীতিতে আলোচনার নতুন খোরাক জুগিয়েছে। বিএনপির সঙ্গে জামায়াতের সম্পর্ক থাকবে, কী থাকবে না-সেই টানাপোড়েনের মধ্যে খালেদার এই সিদ্ধান্ত বার্তা দিয়েছে যে, তিনি জামায়াতের সঙ্গেই থাকছেন।
ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর ঢাকা সফরের পর রাজনীতিতে বিএনপির সঙ্গে জামায়াতের থিতিয়ে পড়া সম্পর্কের ভবিষ্যৎ নিয়ে বড় ধরনের প্রশ্ন ওঠে।
বিশ্লেষকদের বরাত দিয়ে গত ১০ জুন কলকাতা থেকে প্রকাশিত দৈনিক স্টেটসম্যানের এক খবরে বলা হয়, মোদী জামায়াতের সঙ্গ ত্যাগ করার ইঙ্গিতই দিয়েছেন বিএনপিকে।
“জামায়াতের ইফতারে যোগ দিয়ে খালেদা জিয়া প্রমাণ করলেন, তিনি ও জামায়াত এক সুতায় বাঁধা। এত কিছুর পরও খালেদা জিয়া পাল্টাবেন না,” বেনারকে জানান তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু।
তিনি বলেন, জামায়াতকে সঙ্গে নিয়ে তিনি আগুন সন্ত্রাস ও নাশকতার যেসব ঘটনা ঘটিয়েছেন, সরকার সেগুলোর বিচার করে খালেদা জিয়াকে কারাগারে পাঠাবে।
“আমরা ২০ দল করি। জামায়াত আমাদের সঙ্গে থাকবে কী থাকবে না, তা নিয়ে ক্ষমতাসীন দলের মাথা ব্যথার দরকার নাই,” বেনারকে জানান সুপ্রিম কোর্ট বার অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ও বিএনপির চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা খন্দকার মাহবুব হোসেন।
গত ১২ জুন বিএনপির অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা এবং বিএনপি সরকারের সময়কার নির্বাচিত রাষ্ট্রপতি এ কিউ এম বদরুদ্দোজা চৌধুরী বলেন, “বিএনপিকে বাঁচতে হলে জামায়াত নির্ভরতা ছেড়ে আবারও জিয়ার আদর্শে ফিরে আসতে হবে।”
তাঁর মতে, বিএনপির রাজনীতি এখন সম্পূর্ণ জামায়াত নির্ভর। ডা. বি চৌধুরী ২০০২ সালের ২১ জুন দেশের রাষ্ট্রপতি পদ থেকে সড়ে দাঁড়ান এবং বিএনপির সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করে বিকল্পধারা বাংলাদেশ নামে একটি রাজনৈতিক সংগঠন গড়ে তোলেন, যার প্রেসিডেন্ট তিনি।
সরকারের পক্ষ থেকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা থেকে শুরু করে বিভিন্ন মন্ত্রী ও দলের নেতারা বলছেন, জামায়াতের সঙ্গ ছাড়লে বিএনপির সঙ্গে সরকার আলোচনা করতে পারে।
গত বছরের ৫ জানুয়ারির একতরফা নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় এসে শেখ হাসিনা প্রথমেই শর্ত দেন, জামায়াতের সঙ্গ ছাড়লে বিএনপির সঙ্গে তিনি সংলাপ করবেন। সেই শর্তের নড়চড় এখনো হয়নি। আবার বিএনপিও জামায়াতের সঙ্গ ছাড়েনি।
“খালেদা জিয়া বিএনপিকে ছাড়তে পারলেও জামায়াতকে ছাড়তে পারবেন না,” বেনারকে জানান আওয়ামী লীগের প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক হাছান মাহমুদ।
তাঁর মতে, “খালেদা জিয়া জামায়াতে ইসলামীর ইফতার পার্টিতে গিয়ে যুদ্ধাপরাধী ও তাদের সহযোগীদের সঙ্গে ইফতার করে বুঝিয়েছেন, তিনি তাদের পাশেই আছেন।”
জাতীয় নির্বাচন-পরবর্তী বিভিন্ন সময় এশিয়া ও ইউরোপের কূটনীতিকরাও খালেদা জিয়াকে জামায়াতের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করার পরামর্শ দেন। পশ্চিমা অনেক দেশও আকারে–ইঙ্গিতে এ কথাই বলছেন।
কিন্তু খালেদা জিয়া জামায়াতের সঙ্গ ছাড়ার আহ্বান নাকচ করে দিয়ে বলে আসছেন, “জামায়াতের সঙ্গে তাঁদের দলের জোটবদ্ধতা স্থায়ী কিছু নয়”।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক তারেক শামসুর রহমান, যিনি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সরকার ও রাজনীতি বিভাগের অধ্যাপক বেনারকে জানান, “এখন পর্যন্ত বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়াসহ দলটির শীর্ষ নেতৃত্ব জামায়াতের সাথে ঐক্য বহাল রাখার পক্ষে বলেই আমার মনে হয়। তবে আমার মতে, জামায়াতের সঙ্গে এই সম্পর্কটা চূড়ান্ত বিচারে ঠিক নয়।”
ড. তারেক বলেন, জামায়াতের সঙ্গে ঐক্য প্রশ্নে বিএনপি আরও কৌশলী হতে পারে, দলের মধ্যে এমন আলোচনাও রয়েছে। তবে বিএনপি এখন রাজনৈতিকভাবে যে পরিস্থিতির মুখে পড়েছে তাতে জামায়াতের সঙ্গে সম্পর্ক রাখা বা না রাখার সিদ্ধান্ত নেওয়াটাও বেশ কঠিন।
এদিকে, সরকারই এখন জামায়াত নিষিদ্ধ করার প্রক্রিয়া শুরু করেছে। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইন সংশোধন করার উদ্যোগ নেওয়ায় যুদ্ধাপরাধীদের সংগঠন হিসেবে দলটি নিষিদ্ধ হতে যাচ্ছে।
এ প্রসঙ্গে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক সম্প্রতি জাতীয় সংসদে বলেছেন, মন্ত্রিসভার নিয়মিত বৈঠকে উত্থাপনের জন্য সংশোধনীর খসড়াটি আইন মন্ত্রণালয় থেকে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে পাঠানো হয়েছে।
জামায়াতকে সঙ্গে নিয়ে গড়া বিএনপির ২০-দলীয় রাজনৈতিক জোট এখন অনেকটাই নিষ্ক্রিয়। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের মামলায় একের পর এক ফাঁসির রায় ঘোষণা এবং দুটি ফাঁসির রায় কার্যকর হওয়ার পর রাজনীতিতে জামায়াত অনেকটাই কোণঠাসা হয়ে পড়েছে।
১৯৯৯ সালে চারদলীয় জোট গঠনের সময় ঘোষিত যৌথ ইশতেহারে একসঙ্গে আন্দোলন, নির্বাচন ও সরকার গঠনের কথা বলা হয় এবং সে অনুযায়ী ২০০১ সালের নির্বাচনের পর জামায়াতের প্রভাবশালী দুই নেতা মতিউর রহমান নিজামী ও আলী আহসান মুহাম্মদ মুজাহিদকে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের মন্ত্রিসভায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়।
এর পর থেকেই জামায়াত-বিএনপি সম্পর্ক নিয়ে বিতর্ক শুরু হয়। গত ১৪ বছর নানা টানাপোড়েনের মধ্য দিয়ে সম্পর্ক টিকে থাকলেও বিএনপির বড় একটি অংশের এখনকার মূল্যায়ন হচ্ছে, জামায়াতের সঙ্গে সরকার গঠন করায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে বিএনপির।
যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ইস্যুতে জামায়াতের সঙ্গে নেই বিএনপি। এ নিয়ে জামায়াতের নেতা-কর্মীদের মধ্যেও ক্ষোভ আছে।
তবে দুই দলের মধ্যে এসব দূরত্ব সত্ত্বেও বৃহত্তর স্বার্থে বিএনপি ও জামায়াত একসঙ্গে সরকারবিরোধী আন্দোলনের প্লাটফরমে থাকার পক্ষে।
এই জোট ২০১৪ সালে নির্বাচন বর্জন করে লাগাতার অবরোধ হরতাল করেছে এবং এ বছরও প্রথম তিন মাসে তাদের লাগাতার একই কর্মসূচি ছিল। দুই দফার এই লাগাতার আন্দোলনকে প্রশ্নের মুখে ফেলে দেয় যানবাহনে পেট্রল বোমা হামলাসহ নানা সহিংসতা ।
গত সংসদ নির্বাচন বর্জনকারী দল বিএনপির নেত্রী খালেদা জিয়া ভোটের হিসাব-নিকাশের কারণে জামায়াতের সঙ্গে এখনো ঐক্য রাখার পক্ষে বলেই বিশ্লেষকদের অনেকে মনে করেন।
বিএনপি নেতাদের অনেকে আবার বলেছেন, দেশের কিছু এলাকায় জামায়াতের শক্ত অবস্থান এবং সারা দেশেই দলটির সংগঠন এবং একটা ভোট ব্যাংক আছে। আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে ভোটের রাজনীতি থেকেই বিএনপি জামায়াতের সঙ্গে ঐক্য ধরে রাখছে।
সে জন্য কয়েক দিন আগে বিএনপির পক্ষ থেকে সংবাদ সম্মেলন করে বলা হয়, জামায়াতে সঙ্গে তাদের এ সম্পর্ক আদর্শিক কোনো জোট নয়। এটা ভোটের জোট।
“বিএনপির সঙ্গে জামায়াত জোটবদ্ধ । বিএনপি চেয়ারপারসন এই জোটের শীর্ষ নেতা। আমরা তাকে দাওয়াত দিয়েছি। তিনি এসেছেন। এখানে সম্পর্কের অবনতি কিংবা উন্নতির কিছু নেই,” গণমাধ্যমকে জানান জামায়াতের কেন্দ্রীয় প্রচার বিভাগের সহকারী সেক্রেটারি মতিউর রহমান আকন্দ।