খালেদার গাড়ি বহরে হামলা, সিটি নির্বাচনে সেনা মোতায়েন প্রশ্নে বিতর্ক
2015.04.20

ঢাকা ও চট্টগ্রামের তিনটি সিটি করপোরেশন নির্বাচনে সেনা মোতায়েন করা হবে কিনা, তা নিয়ে যখন রাজনৈতিক অঙ্গন সরগরম হয়ে উঠেছে। ঠিক তখনি সোমবার খালেদা জিয়ার নির্বাচনী প্রচারনা কালে তার গাড়ির বহরে হামলার ঘটনায় সেনা নিয়োগের দাবি আরো জোরদার হয়ে উঠলো।
রাজনৈতিক দলগুলো বিশেষ সরকারে সরকার ও প্রধান বিরোধী দল এই প্রশ্নে বিভক্ত। বরাবরের মতো এবারও বিরোধী দল বিএনপি সেনা মোতায়েনের দাবি জানিয়েছে। এর আগে বিএনপি ক্ষমতায় থাকার সময় বিরোধী দল আওয়ামী লীগও সেনা মোতায়েনের দাবি জানিয়েছিল। নির্বাচনে সেনা মোতায়েন নিয়ে নির্বাচন কমিশনারদের মধ্যেও পক্ষে-বিপক্ষে মত রয়েছে।
বিএনপি সমর্থিত আদর্শ ঢাকা আন্দোলন নির্বাচনের অন্তত সাত দিন আগে তিন সিটিতে সেনা মোতায়েনের দাবি জানিয়েছে। সুষ্ঠু নির্বাচনের লক্ষ্যে ঢাকা ও চট্টগ্রামের তিন সিটি করপোরেশনে বিএনপির মেয়র প্রার্থীরা চান নির্বাচনের আগে সেনা মোতায়েন হোক। সুশাসনের জন্য নাগরিক–সুজনও সুষ্ঠু নির্বাচনের স্বার্থে সেনা মোতায়েনের দাবি জানিয়ে আসছে।
“সিটি নির্বাচনে সেনা মোতায়েনের যৌক্তিকতা নেই,” মনে করেন আওয়ামী লীগ–সমর্থিত সহস্র নাগরিক কমিটির আহ্বায়ক ও সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হক। বেনারকে তিনি বলেন, এখন পর্যন্ত এমন কোনো ঘটনা ঘটেনি যে র্যাব–পুলিশের ওপর আস্থা রাখা যাবে না।
নির্বাচন উপলক্ষে বিএনপির পক্ষে শত নাগরিক কমিটি কাজ শুরু করলে সরকারি দল আওয়ামী লীগ সহস্র নাগরিক কমিটি গঠন করে।
বিএনপি নির্বাচনে সেনা মোতায়েনের দাবি জানালেও ১৯ এপ্রিল নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে বৈঠক করে এর বিপক্ষে মত দিয়েছেন আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর শীর্ষ কর্মকর্তারা।
“র্যাবকে সবাই কাজে ভয় পায়, সেনাকে নামে ভয় পায়। সুতরাং সেনা মোতায়েনের প্রয়োজন নেই,” সাংবাদিকদের জানান র্যাবের অতিরিক্ত মহাপরিচালক জিয়াউল আহসান।
বিরোধী দলের প্রার্থীরা ভয়ে থাকার কথা জানালেও ওই র্যাব কর্মকর্তার মতে, ভোটে সহিংসতার আশঙ্কা নেই।
“এ নির্বাচনে সব প্রার্থীই জেতার চেষ্টা করবে, এ জন্য কেউ গন্ডগোল করবে না। যে গন্ডগোল করবে তাকেই ধরা হবে,” জানান কর্নেল আহসান।
চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন (চসিক) নির্বাচনে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের স্বার্থে এক সপ্তাহ আগে থেকে সেনা মোতায়েনের দাবি জানিয়েছেন বিএনপি সমর্থিত মেয়র প্রার্থী এম মনজুর আলমের প্রধান নির্বাচনী এজেন্ট ও নগর বিএনপির সভাপতি আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী।
“ফেনী ও রাউজানসহ বিভিন্ন এলাকা থেকে সরকারি দলের ক্যাডাররা চট্টগ্রাম মহানগরীতে প্রবেশ করছে। তাদেরকে বিভিন্ন কেন্দ্রের দায়িত্ব দেয়া হচ্ছে। আওয়ামী লীগ সমর্থিত মেয়র প্রার্থীর পক্ষ থেকে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড চালানো হচ্ছে,” সেনা মোতায়েনের যুক্তি জানতে চাইলে বেনারকে বলেন আমির খসরু, যিনি ২০০১ পরবর্তী বিএনপি সরকারের সময়ে বাণিজ্যমন্ত্রী ছিলেন।
সেনা মোতায়েনের জন্য বিএনপি আমলে উচ্চ আদালতে রিট করতে হয়েছিল তত্কালীন বিরোধী দল আওয়ামী লীগকে। আওয়ামী লীগ প্রার্থীর রিট আবেদনের প্রেক্ষিতে বিএনপি সরকারের আমলে অনুষ্ঠিত চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচনে সেনা মোতায়েন হয়েছিল।
উল্লেখ্য, চট্টগ্রামের গত সিটি করপোরেশন নির্বাচনেও সেনা মোতায়েন করা হয়। তবে এরপর ২০১৩ সালে অনুষ্ঠিত সর্বশেষ আটটি সিটি নির্বাচন সেনা মোতায়েন ছাড়াই অনুষ্ঠিত হয়েছিল।
এদিকে তিন সিটি করপোরেশন নির্বাচনে সেনাবাহিনী মোতায়েন নিয়ে দ্বিধাদ্বন্দ্বে রয়েছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। ভোটের আগে-পরে নির্বাচন কমিশনের পরিকল্পনায় চার স্তরের নিরাপত্তার পরিকল্পনা নিলেও তাতে সেনা মোতায়েনের বিষয়টি রাখেনি ইসি।
আগামী ২৮ এপ্রিল অনুষ্ঠেয় ভোটগ্রহণ উপলক্ষে চার স্তরের নিরাপত্তায় নিয়োজিত থাকবে প্রায় ৬৫ হাজার বিভিন্ন বাহিনীর ফোর্স। নির্বাচনে সাধারণ ভোটকেন্দ্রে ২২ জন ও ঝুঁকিপূর্ণ কেন্দ্রে ২৪ জন করে আইন-শৃঙ্খলাবাহিনীর সদস্য মোতায়েন করা হবে।
এ বিবেচনায় ২ হাজার ৭শ’ ভোটকেন্দ্রে প্রায় ৬২ হাজার নিরাপত্তা রক্ষী নিয়োগ করতে হবে ইসিকে। এ ছাড়া তিন সিটির প্রতি সাধারণ ও সংরক্ষিত ওয়ার্ডে পুলিশ, আনসার ও ব্যাটালিয়ন আনসারের সমন্বয়ে একটি করে মোবাইল ও স্ট্রাইকিং ফোর্স থাকবে। সেই সঙ্গে ভোটকেন্দ্র বিবেচনায় ২২ প্লাটুন বিজিবি, ৭ প্লাটুন কোস্ট গার্ড ও র্যাবের ৬৮টি টিম কাজ করবে।
“রিটার্নিং কর্মকর্তা ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীসহ সবার মতামত শোনা হয়েছে। সবাই বলছে, নির্বাচনপূর্ব অবস্থা ভালো। এখন বুঝেশুনে দু’তিন দিনের মধ্যে সেনাবাহিনী মোতায়েনের বিষয়ে সিদ্ধান্ত হবে,” আইনশৃঙ্খলা বিষয়ে মত বিনিময় শেষে সাংবাদিকদের জানান প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী রকিবউদ্দীন আহমদ।
“নগরবাসী চায় একটি সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ এবং শান্তিপূর্ণ নির্বাচন। তাঁরা দীর্ঘ ১৩ বছর পর নির্বিঘ্নে ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে চায়। সেনা মোতায়েন করে সেই নিশ্চয়তা বাড়ানো যেতে পারে,” বেনারকে জানান সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সভাপতি ড. বদিউল আলম মজুমদার।
খালেদার গাড়ির বহরে হামলা, বুধবার হরতাল
বিএনপি-সমর্থিত মেয়র পদপ্রার্থী তাবিথ আউয়ালের পক্ষে নির্বাচনী প্রচারে নেমে হামলার মুখে পড়েছে বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার গাড়িবহর। সোমবার সন্ধ্যা ছয়টায় রাজধানীর কারওয়ান বাজারে এ হামলার ঘটনা ঘটে।
খালেদা জিয়ার গাড়িবহর হামলার মুখে পড়লেও কারও ওপর হামলা করা হয়নি বলে মন্তব্য করেছেন স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান।
“ঘটনাটি যাচাই বাছাই করা হচ্ছে। যদি কেউ এ ধরনের ঘটনা ঘটিয়ে থাকে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। ঘটনাটির সত্যতা আছে কি-না তাও খতিয়ে দেখা হচ্ছে,” এ হামলার ব্যাপারে জানতে যোগাযোগ করা হলে বেনারকে বলেন আসাদুজ্জামান।
প্রত্যক্ষদর্শীরা অবশ্য জানান, হামলাকারীরা খালেদা জিয়ার গাড়িতে ঢিল ছোড়ে। এতে তাঁর গাড়ির ডান পাশের কাচ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এলোপাতাড়ি ভাঙচুর করা হয় তাঁর নিরাপত্তাকর্মীদের (সিএসএফ) তিন-চারটি গাড়িসহ বেশ কয়েকটি গাড়ি। এতে খালেদার একজন নিরাপত্তাকর্মীসহ কয়েকজন আহত হন। তবে তিনি অক্ষত আছেন।
তাবিথের পক্ষে প্রচার চালাতে সোমবার কারওয়ান বাজারে যান খালেদা জিয়া।
“ওই এলাকায় স্লোগান দিয়ে বেশ কয়েকজন যুবক তাঁকে জুতা ও কালো পতাকা দেখান। একই সময়ে উত্তর পাশ থেকে ‘জয় বাংলা’ স্লোগান দিয়ে অর্ধ শতাধিক লোক মিছিল নিয়ে আসে। তাঁদের অনেকের হাতে ছিল লাঠি। খালেদা জিয়ার গাড়িবহরের কাছাকাছি গিয়েই তাঁরা হামলা শুরু করেন।
এলোপাতাড়িভাবে ইট ও ডাবের খোল ছুড়তে থাকেন,” ঘটনার বর্ণনা দিয়ে বেনারকে জানান ঘটনাস্থলের কাছে ডাব বিক্রেতা আব্দুর রশীদ (৫৫)।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, একই সময়ে খালেদা জিয়ার গাড়ির ঠিক পেছনে তাঁর নিরাপত্তায় নিয়োজিত একাধিক মাইক্রোবাসে হামলাকারীরা লাঠি, লোহার পাইপ দিয়ে এলোপাতাড়ি ভাঙচুর চালাতে থাকে।
এর আগে গত রোববারও খালেদা জিয়া প্রচার চালাতে উত্তরায় গেলে আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা কয়েক দফায় কালো পতাকা নিয়ে বিক্ষোভ দেখায়।
বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার গাড়িবহরে হামলার প্রতিবাদে বুধবার সারা দেশে হরতাল ডাকা হয়েছে। তবে সিটি করপোরেশন নির্বাচনের কারণে ঢাকা ও চট্টগ্রাম মহানগর হরতালের আওতামুক্ত থাকবে।
সোমবার সন্ধ্যায় নয়াপল্টনে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে এ হরতাল কর্মসূচির ঘোষণা দেন দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য মওদুদ আহমদ।ঘটনার প্রতিবাদে মঙ্গলবার সারা দেশে বিক্ষোভ সমাবেশ করার কথা জানান তিনি।