স্থানীয় নির্বাচনে দলীয় মনোনয়ন প্রথা চালু, বিরোধীদের আপত্তি
2015.10.13

বাংলাদেশে স্থানীয় সরকারের সবগুলো স্তরে দলীয় মনোনয়নের মাধ্যমে জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত করতে সোমবার আইন সংশোধন করেছে সরকার, যা নিয়ে বিরোধী দল বিএনপিসহ বাম দলগুলো তীব্র আপত্তি জানিয়ে সরকারের উদ্দেশ্য নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে।
এ বছরের ডিসেম্বরে ৩২৩টি পৌরসভায় দলীয় মনোনয়নের ভিত্তিতে প্রথম স্থানীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। এরপর মার্চ থেকে জুনের মধ্যে হবে ৪ হাজার ৫৫৩টি ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচন। দলীয় প্রতীক থাকায় এই দুটি নির্বাচনে ৬৫ হাজার ধরনের ২৭ কোটি ব্যালট পেপার ছাপতে হবে, যে প্রস্তুতি নির্বাচন কমিশনের নেই।
পাকিস্তানের স্বৈরশাসক আইয়ুব খানের সময় থেকে বাংলাদেশে অরাজনৈতিক পরিচয়ে স্থানীয় নির্বাচন হওয়ার রেওয়াজ চালু হয়, যদিও এখন রাজনৈতিক দলই এসব নির্বাচনে প্রার্থী ঠিক করে দেয়। শুধু ব্যালটে দলীয় প্রতীক থাকে না।
স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ, সরকারি দলের শীর্ষ নেতাসহ অনেকেই মত দিয়ে আসছেন, স্থানীয় সরকার নির্বাচন দলীয়ভাবে করা উচিত। তাঁরা বলছেন, যেহেতু নির্দলীয় এই নির্বাচনে দলীয় প্রার্থীরাই অংশ নেন, তাই এই স্ববিরোধিতার প্রয়োজন নেই।
সরকারের নতুন সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, নির্বাচনে মেয়র, চেয়ারম্যান, ভাইস চেয়ারম্যান ও ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য পদে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের দলীয় মনোনয়ন ও দলীয় প্রতীক থাকতে হবে। নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধিত ৪০টি দলের পক্ষ থেকে প্রার্থী হওয়ার সুযোগ থাকবে। তবে নিবন্ধিত দল না হওয়ায় জামায়াতে ইসলামী এই নির্বাচনে অংশ নেওয়ার সুযোগ পাবে না।
“সরকার তৃণমূল পর্যায়ে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের ক্ষমতায়ন এবং দেশে রাজনৈতিক ও গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি বিকাশের লক্ষ্যে স্থানীয় সরকারব্যবস্থায় পরিবর্তন আনার সিদ্ধান্ত নিয়েছে,” বেনারকে জানান মন্ত্রিপরিষদ সচিব মোশাররাফ হোসাইন ভূইঞা।
যুক্তরাজ্য, ভারতসহ বৃহৎ গণতান্ত্রিক দেশগুলোর সংসদীয় ব্যবস্থায় স্থানীয় সরকার নির্বাচনগুলো দলীয় মনোনয়নের ভিত্তিতে হওয়ার কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, ওই দুটি দেশের উদাহরণ দেওয়ার কারণ, বাংলাদেশে বিদ্যমান ব্যবস্থা এসব দেশের প্রশাসনিক ও রাজনৈতিক কাঠামোর অনুরূপ।
১৪ দলীয় সরকারি জোটের বাইরে থাকা বিরোধী দলগুলো সরকারের আকস্মিক এই উদ্যোগ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে। তারা অভিযোগ করছে, গত বছরের ৫ জানুয়ারি একতরফা নির্বাচনের মাধ্যমে সরকার ক্ষমতায় আসে। এখন দলগতভাবে স্থানীয় নির্বাচন করে তৃণমূলের নেতৃত্বও দখলে নিতে চায়।
“এই উদ্যোগ স্থানীয় সরকার ব্যবস্থাকে ধ্বংস করবে এবং ক্ষমতাসীন দলই স্থানীয় সরকার গ্রাস করে ফেলবে। এ ছাড়া প্রভাবশালী, বিত্তশালী ও রাজনৈতিক দাপট থাকা খারাপ লোক নির্বাচিত হয়ে আসার সুযোগ প্রশস্ত হবে,” বেনারকে জানান সুশাসনের জন্য নাগরিক—সুজনের সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার।
“দলীয় মনোনয়নের ভিত্তিতে নির্বাচন হওয়ায় আওয়ামী লীগ-বিএনপির বাইরে তৃণমূলে অন্যান্য রাজনৈতিক দল সংগঠিত ও শক্তিশালী হওয়ার সুযোগ পাবে,” জানান ১৪ দলের শরিক বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি এবং বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটনমন্ত্রী রাশেদ খান মেনন।
গতকাল সোমবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে মন্ত্রিসভার নিয়মিত বৈঠকে স্থানীয় সরকারের পাঁচটি প্রতিষ্ঠানের সংশোধন আইন একযোগে অনুমোদন করা হয়। আইনগুলো হচ্ছে: স্থানীয় সরকার (ইউনিয়ন পরিষদ) সংশোধন আইন, ২০১৫; উপজেলা পরিষদ (সংশোধন) আইন, ২০১৫; জেলা পরিষদ (সংশোধন) আইন, ২০১৫; স্থানীয় সরকার (পৌরসভা) সংশোধন আইন, ২০১৫ এবং স্থানীয় সরকার (সিটি করপোরেশন) সংশোধন আইন, ২০১৫।
এসব আইনের আওতায় পর্যায়ক্রমে ৩২৩টি পৌরসভা, ৪ হাজার ৫৫৩টি ইউনিয়ন পরিষদ, ৪৮৮টি উপজেলা, ১১টি সিটি করপোরেশন এবং ৬৪টি জেলা পরিষদ নির্বাচন দলীয়ভাবে অনুষ্ঠিত হবে।
দলীয় মনোনয়নে নির্বাচন করার পাশাপাশি মন্ত্রিসভা সিদ্ধান্ত নিয়েছে, প্রত্যেক স্থানীয় সরকার গঠন হওয়ার পাঁচ বছর পর কোনো কারণে নির্বাচন না হলেও জনপ্রতিনিধি আর ক্ষমতায় থাকতে পারবেন না।
গত সোমবার বিএনপির ব্রিফিংয়ে দলীয় পরিচয়ে স্থানীয় সরকার নির্বাচন অনুষ্ঠানের বিরোধিতা করে বলা হয়, সংসদের মেয়াদ উত্তীর্ণ হওয়ার পর যদি সাংসদেরা থাকতে পারেন, তাহলে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা তা পারবেন না কেন?
“দলীয় পরিচয়ে স্থানীয় সরকার নির্বাচন করার সিদ্ধান্তটি ইতিবাচক। তবে এর সুফল পেতে হলে রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে পরিবর্তন আনতে হবে”, বেনারকে জানান স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ তোফায়েল আহমেদ।
তাঁর মতে, রাজনৈতিক দলগুলো যদি যোগ্য প্রার্থী মনোনয়ন না দেয়, তাহলে পরিস্থিতি এখনকার চেয়ে ভালো কিছু হবে, এমনটি আশা করা যায় না।
অন্য দলের প্রতিক্রিয়া
“টাকার খেলা, পেশি শক্তির দাপট, প্রশাসনিক কারসাজি, সাম্প্রদায়িক বিভ্রান্তি সৃষ্টি ইত্যাদি থেকে নির্বাচনকে মুক্ত না করে এবং সেই সঙ্গে রাজনৈতিক দলে অভ্যন্তরীণ গণতন্ত্র চর্চার নিশ্চয়তা বিধান না করে, এমন সিদ্ধান্ত স্থানীয় সংস্থাগুলোকে দেশের লুটেরা ধনিকদের স্বার্থের কাছে বেশি করে বন্দী করবে,” জানান বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম।
বাংলাদেশের বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক মনে করেন, “বর্তমান পরিস্থিতিতে দলীয় প্রতীকে স্থানীয় নির্বাচন দলীয়করণ ও দলবাজীকে আরও পাকাপোক্ত করবে।”
তাঁর মতে, সরকার যে সবকিছুতে দলীয় আধিপত্য ও নিয়ন্ত্রণ নিরঙ্কুশ করতে চায় তা স্পষ্ট। রাজনৈতিক দল ও সমাজের বিভিন্ন অংশের মতামতের তোয়াক্কা না করে সরকার যেভাবে এই ধরনের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করল তা স্বেচ্ছাচারী মনোভাবেরই বহিঃপ্রকাশ।
জামায়াত অংশ নিতে পারবে না
নিবন্ধিত রাজনৈতিক দল না হওয়ায় স্থানীয় সরকার নির্বাচনে অংশ নিতে পারবে না জামায়াতে ইসলামী। সরকার রাজনৈতিক দলের পরিচয় ও প্রতীকে স্থানীয় নির্বাচন করার সিদ্ধান্ত নেওয়ায় এ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে।
“যতক্ষণ আদালতের নিষেধাজ্ঞা বহাল আছে, ততক্ষণ জামায়াতে ইসলামী নির্বাচনে অংশ নিতে পারবে না। সুপ্রিম কোর্ট মামলার নিষ্পত্তি করে বৈধ দল হিসেবে ঘোষণা দিলে তারা নির্বাচনে অংশ নিতে পারবে,” সাংবাদিকদের জানান নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ের সচিব সিরাজুল ইসলাম।
আইন সংশোধনের পর বর্তমানে নিবন্ধিত ৪০টি রাজনৈতিক দলের প্রার্থীরা দলীয় প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করতে পারবেন। জামায়াতের সেই সুযোগ আপাতত নেই। তবে জামায়াতের প্রার্থীরা স্বতন্ত্রভাবে নির্বাচনে অংশ নিতে পারবেন।
হাইকোর্ট ২০১২ সালের ১ আগস্ট জামায়াতের নিবন্ধন অবৈধ ঘোষণা করে সংক্ষিপ্ত রায় দেন। এরপর ২০১৩ সালের ২ নভেম্বর পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ করেন। এরপর নির্বাচন কমিশন নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলের নামের তালিকা থেকে জামায়াতের নাম বাদ দেয়।
হাইকোর্টের রায়ের পর জামায়াতে ইসলামী এর বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টে আপিল করে, যা বর্তমানে বিচারাধীন আছে।