দুর্ধর্ষ ব্যাংক ডাকাতির ঘটনায় ব্যবস্থাপক, গ্রাহকসহ নিহত ৮

ঢাকা থেকে শাহরিয়ার শরীফ
2015.04.21
BD-robbery আশুলিয়ায় কাঠগড়া বাজার শাখা বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংকে ডাকাতদের হামলায় মোট ৮ জন মারা যায়। ছবিতে ৬ জনের মৃতদেহ ও ব্যাংকের রক্তাক্ত মেঝে। ২১ এপ্রিল,২০১৫
বেনার নিউজ

রাজধানী ঢাকার উপকণ্ঠে পোশাক কারখানা অধ্যুষিত আশুলিয়ার কাঠগড়া এলাকায় একটি বেসরকারি ব্যাংকে দুর্ধর্ষ ডাকাতদের হামলায় মোট আটজন নিহত হয়েছে। এঁরা হলেন ব্যাংকের ব্যবস্থাপকসহ তিন ব্যক্তি ব্যাংকের ভেতরে মারা যান। ডাকাতদের প্রতিহত করতে গিয়ে গুলি-বোমায় নিহত হন আরও চারজন। এ ছাড়া জনতার পিটুনিতে মারা গেছে অজ্ঞাতপরিচয় এক সন্দেহভাজন ডাকাত।

মঙ্গলবার বেলা আড়াইটা থেকে পৌনে তিনটার মধ্যে বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংকের কাঠগড়া শাখায় গুলি করে ও কুপিয়ে টাকা লুট করে পালানোর সময় জনতার প্রতিরোধের মুখে পড়ে ডাকাতেরা। এসময় ধরা পড়েছে দুই ডাকাত।

ঘটনাস্থলে পুলিশের একাধিক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা ও সদস্য বলেন, তাঁদের কর্মজীবনে এ রকম ভয়াবহ, দুর্ধর্ষ প্রাণঘাতী ডাকাতির কথা মনে করতে পারেন না।

ব্যাংকের ব্যবস্থাপক মো. ওয়ালিউল্লাহ (৪৫), নিরাপত্তাকর্মী (গানম্যান) বদরুল (৩৮), ব্যাংকের গ্রাহক ও ছাপাখানার ব্যবসায়ী পলাশ (৪৮) ব্যাংকের ভেতরেই ডাকাতদের হামলায় মারা যান। এ ছাড়া ডাকাতদের ধরতে গিয়ে ব্যাংকের পাশের চটপটি বিক্রেতা মনির হোসেন (৬০) ও বাজারের ব্যবসায়ী নুরুজ্জামান (৪০) হাসপাতালে নেওয়ার আগেই মারা যান।

ডাকাতদের গুলি ও বোমা হামলায় ১৮ জন গুলি ও স্প্লিন্টারবিদ্ধ হয়ে সাভারের এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি হয়। এদের মধ্যে সন্ধ্যায় বাজারের দর্জি ব্যবসায়ী জমির উদ্দীন (২৫) ও নূর মোহাম্মদ (৪৫) চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান।

চিকিৎসাধীন বাকি ১৬ জনের মধ্যে সাইফুল নামে আহত এক ডাকাতও রয়েছেন। এনাম হাসপাতাল সূত্র জানিয়েছে, আহতদের মধ্যে পাঁচজনের অস্ত্রোপচার হয়েছে। তাদের অবস্থা আশঙ্কাজনক। আহত প্রায় সবারই পেটে ও পায়ে গুলি-স্প্লিন্টারের আঘাত রয়েছে।

ঢাকা-আরিচা মহাসড়কের বিশমাইল এলাকা থেকে ডান দিকে জিরাবোর দিকে পাঁচ কিলোমিটার গেলেই আশুলিয়ার কাঠগড়া বাজার। সড়ক থেকে বাজারের ভেতর দিয়ে পাঁচ শ গজ ভেতরে হাজি নজুমুদ্দিন সুপার মার্কেট। এই মার্কেটের দোতলায় গত বছরের ১৫ ডিসেম্বর থেকে এখানে ব্যাংকটির কাঠগড়া শাখা কার্যক্রম শুরু করে।

সরেজমিন সন্ধ্যায় ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখা যায়, ব্যাংকের ভেতরে সিঁড়ির মুখে দুটি নীল রঙের বোমা পড়ে আছে। কংক্রিটের সিঁড়ি দিয়ে দোতলায় উঠতেই টাইলসের মেঝেতে কয়েকটি স্যান্ডেল আর কালচে জমাট বাধা রক্ত। এরপর ব্যাংকে ঢোকার ফটক।

ব্যাংকের কলাপসিবল ফটক লাগিয়ে ভেতরে কাজ করছেন আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা। বাইরে থেকে দেখা গেল ফটকের মুখেই থকথকে রক্ত। এখানেই ব্যাংকের নিরাপত্তাকর্মী ও ব্যবস্থাপককে কুপিয়ে ফেলে রেখে হত্যা করা হয় বলে ব্যাংকের একজন কর্মী জানান।

“তিন-চারজন ডাকাত ব্যাংকের ভেতর ঢুকেই নিরাপত্তাকর্মীকে কুপিয়ে মেঝেতে ফেলে দেয়। বড় বন্দুক থাকলেও তা ব্যবহারের সুযোগ পাননি নিরাপত্তাকর্মী। এরপর ব্যবস্থাপকের কক্ষে ঢুকে বোমা দেখিয়ে ভল্টের চাবি চায়। একই সঙ্গে তারা সকলকে শুয়ে পড়তে বলে,” বেনারকে জানান ব্যাংকের ক্যাশ অফিসার তরিকুল ইসলাম।

তরিকুল বলেন, “তারা সবাই শুয়ে পড়লেও ব্যবস্থাপক তার কক্ষ থেকে বের হয়ে পালানোর চেষ্টা করেন। ফটকের সামনেই তাকে ধরে ফেলে ডাকাতরা এলোপাতাড়ি কুপিয়ে হত্যা করে। এরপর তারা ক্যাশ থেকে ছয় লাখের মতো টাকা লুটে নিয়ে গুলি করতে করতে বের হয়ে যায়।”

ডাকাতির খবর পেয়ে ব্যাংকের ঠিক উল্টোদিকের মসজিদের মাইক থেকে ডাকাতদের প্রতিরোধ করার আহ্বান জানানো হয়।

“কাঠগড়া বাজার জামে মসজিদেও মাইকে ক্রমাগত ‘ডাকাত ডাকাত’ বলে চিৎকার করা হয়। কাঠগড়া বাজারের গলিপথগুলো দিয়ে পিঁপড়ার মতো দৌড়ে আসে মানুষ। এর মধ্যেই অস্ত্র তাক করে এলোপাতাড়ি গুলি ছুড়তে ছুঁড়তে দৌড়ে চলে যায় ছয়জন তরুণ,” ঘটনার বর্ণনা দিয়ে বেনারকে জানান ব্যাংকের সিনিয়র সহকারী কর্মকর্তা ফারুক আহমেদ।

এর আগে ব্যবস্থাপকের কক্ষে ঢুকে বোমা রেখে ডাকাতেরা সবাইকে শুয়ে পড়ার আদেশ দিলে তিনি নিজেও শুয়ে পড়ার কথা জানান।

“জনতা একটি গাড়ি নিয়ে একটি মোটর সাইকেলে থাকা তিন ডাকাতের পিছু নেয়। তারা ঢাকা-আরিচা মহাসড়কের দিকে যেতে থাকে। আমতলা এলাকায় গাড়ি দিয়ে ধাক্কা মেরে মোটরসাইকেল আরোহী ডাকাতদের ফেলে দেওয়া হয়,” ডাকাতদের ধরতে গিয়ে গুলিতে আহত ব্যবসায়ী আব্দুস সালাম হাসপাতালে বেনারকে এ কথা জানান।

ওই ব্যবসায়ী আরও জানান, সেখানেই একজন ডাকাতকে ধরে ফেলে গণপিটুনি দেয় জনতা। দুজন দৌড়ে পালিয়ে যায়। এখানে মোটরসাইকেলে থাকা ব্যাগ থেকে পুলিশ পাঁচ লাখ ৯৪ হাজার টাকা উদ্ধার করে। ব্যাগে আরও দুটি বোমা পাওয়া যায়। র্যাবের বোমা নিষ্ক্রিয়করণ দল সেগুলোর নিয়ন্ত্রিত বিস্ফোরণ ঘটিয়েছে।

পুলিশ ও প্রত্যক্ষদর্শীদের প্রাথমিক ধারণা অনুযায়ী, তিনটি মোটরসাইকেলে মোট নয়জন ডাকাত এসেছিলেন। এদের মধ্যে তিনজন ব্যাংকের ভেতরে ঢোকেন। তিনজন মোটরসাইকেলের ইঞ্জিন চালু রেখে সড়কে অপেক্ষা করছিলেন। আর তিনজন ব্যাংকের ফটকে দাঁড়িয়েছিলেন। পুলিশ এদের ব্যবহৃত একটি বাজাজ ডিসকোভার এক শ’ সিসির মোটরসাইকেল উদ্ধার করেছে।

“জোহরের নামাজ পড়ে বের হতেই দেখি কয়েকজন তরুণ বোমা বিস্ফোরণ আর গুলি করতে করতে দৌড়ে পালাচ্ছে। আর শত শত লোক তাদের ধরার চেষ্টা করছে। কিন্তু গুলি-বোমার মুখে জনতা তাদের কাছে যেতে পারছিল না,” জানান ব্যাংকের ঠিক সামনের মসজিদে নামাজ পড়তে যাওয়া মো. ইয়াহিয়া।

“কিছু যুবক ব্যাংকে হামলা চালিয়ে টাকা লুটের চেষ্টা করে। কিন্তু ভল্টের চাবি না পেয়ে ব্যবস্থাপক ও নিরাপত্তাকর্মীকে কুপিয়ে টাকা নিয়ে পালানোর সময় কয়েকজন জনতার কাছে ধরা পড়ে। আর কয়েকজন গুলি করতে করতে চলে যায়। গুলিতে বেশ কয়েকজন মানুষ আহত হয়েছেন,” জানান আশুলিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোস্তফা কামাল।

ডাকাতদের ফেলে যাওয়া বোমাগুলো ছিল শক্তিশালী। আমতলা বাজারে রাস্তার ওপর নিয়ন্ত্রিত পরিবেশে দুটি বোমার বিস্ফোরণ ঘটায় র্যাব। এসময় বিকট শব্দে, কালো ধোঁয়ায় ছেয়ে যায় ওই এলাকা।

“এগুলো গ্রেনেড জাতীয় বোমা, তবে দেশেই তৈরি। এগুলোর মধ্যে স্প্লিন্টার রয়েছে যা অনেক বিধ্বংসী,” বোমাগুলো প্রসঙ্গে বেনারকে জানান র্যাবের বোমা নিষ্ক্রিয়করণ দলের সদস্য মেজর মো. খালিদ ইবনে হোসেন।


মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।