ডাকাতিতে জড়িত দুইজন গ্রেফতার, জঙ্গি সম্পৃক্ততা পাচ্ছে পুলিশ
2015.04.24

ঢাকার অদূরে পোশাক কারখানা অধ্যুষিত আশুলিয়ার কাঠগড়া বাজারে বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংকের ডাকাতির জন্য জঙ্গিদের দায়ী করেছে পুলিশ। তবে কোন জঙ্গি সংগঠন এ ঘটনা ঘটিয়েছে তা জানাতে পারেনি পুলিশ। এর আগে বুধবার ওই ডাকাতির জন্য জামায়াত-শিবিরকে দায়ী করেছিল পুলিশ।
তবে কাঠগড়া এলাকাবাসী ও ব্যাংকের কর্মীরা বলছেন, ডাকাতি ঘটনার শুরু থেকেই প্রচণ্ড উন্মত্ততা নিয়ে মানুষকে আঘাত করছিল ডাকাতেরা। এতেই এত হতাহতের ঘটনা ঘটে।
গত মঙ্গলবার দুপুরে কমার্স ব্যাংকের কাঠগড়া বাজার শাখায় হামলা চালায় একদল ডাকাত। ডাকাতদের হামলায় সাতজন নিহত হন। জনতার পিটুনিতে মারা যান একজন সন্দেহভাজন ডাকাত। ডাকাতদের হামলায় গুরুতর আহত হয়ে ১৬ জন সাভারের এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছেন।
ওই ডাকাতির মামলায় গতকাল শুক্রবার পর্যন্ত চারজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন পুলিশের ঢাকা রেঞ্জের মহাপরিদর্শক (ডিআইজি) এস এম মাহাফুজুল হক নুরুজ্জামান। এদের মধ্যে সাইফুল ইসলাম (২৫) ও বোরহানউদ্দীন মৃধা (৩৫) নামে দুজনকে ঘটনার পরপরই ধরে ফেলে গণপিটুনি দিয়ে পুলিশের সোপর্দ করে জনতা।
আর বাবুল সরদার (৩২) ও মিন্টু প্রধান (২৮) নামে দুজনকে গত বৃহস্পতিবার রাতে আশুলিয়ার কলমা এলাকা থেকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এরপর তাদের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে টঙ্গীর আউশপুর থেকে গান পাউডার, গ্রেনেড ও বোমা তৈরির বিভিন্ন সরঞ্জাম, বিস্ফোরক মাপার যন্ত্র, চারটি চাপাতি, আটটি ছোরা, একটি পিস্তলের ম্যাগজিন, দুটি মোটরসাইকেল এবং বেশ কিছু ‘উগ্রপন্থী’ বই ও প্রচারপত্র (লিফলেট) উদ্ধার করা হয়।
ডাকাতি ঘটনার পরদিন বুধবার সাভার থানার মিলনায়তনে এক সংবাদ সম্মেলনে ঢাকার ডিআইজি নুরুজ্জামান ঘটনার জন্য জামায়াত-শিবিরকে দায়ী করে বলেন, ঘটনার বিশ্লেষণ করে তাঁর মনে হয়েছে ডাকাতি নয়, তাঁদের মূল উদ্দেশ্যই ছিল হত্যা আর নাশকতা সৃষ্টি করা। জামায়াত-শিবিরের কর্মীরা এ ঘটনার সঙ্গে জড়িত।
“গ্রেপ্তার হওয়া বোরহান শিবিরের কর্মী। তাদের কাছ থেকে জিহাদি বই উদ্ধার করা হয়েছে। বোরহানের পুরো পরিবারই জামায়াতের সঙ্গে যুক্ত। তাঁরা (ডাকাতেরা) যেসব অস্ত্র ব্যবহার করেছে তা অত্যাধুনিক,” জানান নুরুজ্জামান।
তাঁর মতে, এসব অস্ত্র ও স্বয়ংক্রিয় গ্রেনেড দেশের বাইরে থেকে আমদানি করা হয়েছে। সামরিক বাহিনীর বিভিন্ন ইউনিটে এগুলো ব্যবহার হয়ে থাকতে পারে। এর বাইরে এগুলো পাওয়ার সুযোগ নেই।
গতকাল শুক্রবার ঢাকা মহানগর পুলিশের মিডিয়া সেন্টারে ডিআইজি ওই ডাকাতির জন্য জঙ্গিদের দায়ী করে বলেন, গ্রেপ্তার দুজন এক সময় ইসলামি ছাত্রশিবির করলেও বর্তমানে তারা জঙ্গি সংগঠনের সঙ্গে জড়িত। রাজনৈতিক অস্থিরতা সৃষ্টি এবং সংগঠনের তহবিল গঠনের জন্য ওই দিন তারা ব্যাংকে হামলা চালিয়ে এত হতাহতের ঘটনা ঘটায়।
ওই সংবাদ সম্মেলনে ঢাকা জেলার পুলিশ সুপার হাবিবুর রহমান বলেন, “ঘটনার দিনই গ্রেপ্তার সাইফুল ও বোরহানকে জিজ্ঞাসাবাদে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে রাতে আশুলিয়ার কলমা এলাকার একটি বাড়িতে অভিযান চালিয়ে বাবুল ও মিন্টুকে গ্রেপ্তার করা হয়।”
পুলিশ সুপার জানান, পরে টঙ্গীর আরেকটি ভাড়া বাড়ি থেকে ওই গোলা-বারুদ উদ্ধার করা হয়। ডাকাতদের ধাওয়া করে জব্দ করা মোটরসাইকেলের কাগজপত্রও ওই বাড়িতে পাওয়া গেছে।”
ডাকাতেরা শুরু থেকেই চরম আক্রোশ নিয়ে ছোরা-বন্দুক চালাচ্ছিলেন বলে বেনারকে জানান কমার্স ব্যাংকের সিনিয়র সহকারী অফিসার ফারুক আহমেদ। তিনি বলেন, “ডাকাতেরা ব্যাংকের ভেতরে ঢুকেই দুই নিরাপত্তাকর্মী ইব্রাহিম ও কাজী বদরুল আলমকে এলোপাতাড়ি ছুরিকাঘাত করা শুরু করে। তাঁরা সেখানেই মারা যান বলে ফারুকের মনে হয়েছে। একই সময়ে আরও কয়েকজন ডাকাত ম্যানেজার ওয়ালিউল্লাহর কক্ষে ঢুকে বোমা সদৃশ একটা বস্তু টেবিলে রাখেন। এরপর ভল্টের চাবি চান ডাকাতেরা। তবে ম্যানেজার চাবি না দিয়ে ডাকাতদের এড়িয়ে কক্ষ থেকে বের হওয়ার চেষ্টা করলে ব্যাংকের ফটকে ম্যানেজারকে কুপিয়ে-ছুরিকাঘাত করে ফেলে রাখে ডাকাতেরা। তিনিও পরে মারা যান।”
কাঠগড়া বাজার মসজিদের খতিব তৈয়ব আলী ডাকাতদের হামলার খবর মাইকে ঘোষণা করেছিলেন। ব্যাংকের ঠিক উল্টোদিকেই মসজিদ।
ঘটনার বর্ণনা দিয়ে খতিব বলেন, ওই দিন জোহরের নামাজের পরে তিনি চটপটি বিক্রেতা মনির ও আরও তিন-চারজন ব্যাংকের সিঁড়ির সামনে মসজিদের পাশে দাঁড়িয়ে ছিলেন। এ সময় ব্যাংকের ভেতর থেকে একজন চিৎকার করতে করতে দৌড়ে আসেন। বলতে থাকেন ‘ডাকাত পড়ছে, বাঁচান’। তখন তাঁরা চার-পাঁচজন সিঁড়ি দিয়ে দোতলায় ব্যাংকের দিকে যাওয়া শুরু করেন। এ সময়ই ওপর থেকে গুলির শব্দ আসে। তারা পিছু হটে মসজিদের ভেতর থেকে রড নিয়ে আবারও ঢোকার চেষ্টা করেন। তখন সিঁড়ির সঙ্গে ব্যাংকের ফটকটি বন্ধ পান তারা। এরপর তিনি মসজিদের ভেতরে গিয়ে মাইকে ঘোষণা দেওয়া শুরু করেন ‘ব্যাংকে ডাকাত আইছে, ডাকাত আইছে’। এরপর অনেক লোক ব্যাংকের সামনে জড়ো হয়ে যায়।
খতিব আরও জানান, “তখন ব্যাংকের ভেতর থেকে কয়েকজন ভবনের ভেতরের সিঁড়ি দিয়ে নেমে যায়। আর দুজন গুলি করতে করতে ব্যাংকের মূল সিঁড়ি দিয়ে নামতে থাকে। একটি গুলি মসজিদের কাচেও লাগে। সিঁড়ি দিয়ে নামার সময় দুটি বোমার বিস্ফোরণ ঘটায় তারা। এতে মসজিদের পাশে দাঁড়ানো কয়েকজন আহত হন।
“আমার সঙ্গে দাঁড়িয়ে থাকা চটপটি বিক্রেতা মনির রাস্তার ওপর পড়ে যায় (পরে মারা যান)। তাঁর শরীর থেকে রক্ত বের হতে দেখি। ভয়ে আমিসহ আরও অনেকে মসজিদের ভেতর ঢুকে পড়ি। এরপর ডাকাতেরা গুলি ছুঁড়তে ছুঁড়তে বাজারের ভেতর দিয়ে সড়কের দিকে চলে যায়,” জানান খতিব তৈয়ব আলী।
ডাকাতদের বোমার আঘাতে বাম পা ছিন্ন ভিন্ন হয়ে গেছে সবজি ব্যবসায়ী শফিকুল ইসলামের। ইতিমধ্যেই বাম পায়ের পাতা কেটে ফেলা হয়েছে শফিকুলের। ডান পায়ের আঘাতও গুরুতর।
সাভারের এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে ভর্তি শফিকুল বেনারকে বলেন, “চুল কাটাতে যাচ্ছিলাম। মসজিদের মাইকে ডাকাত আসার খবর শুনে মসজিদের কাছে এগিয়ে যাওয়া মাত্র দেখেন একজন অস্ত্র উঁচিয়ে বলছে ‘আসলেই গুলি করব, কেউ আগাবি না’। এরপরেই একজন আমার পায়ের কাছে বোমা মারে।”
ঝালমুড়ি বিক্রেতা নুরুল ইসলামের পেটে ছুরিকাঘাত করেছে ডাকাতেরা। এনাম মেডিকেলে ষাট বছর বয়সী নুরুল বেনারকে বলেন “আমি বাবা বুড়া মানুষ। আমি ডাকাত ধরতেও যাইনি। পালানোর সুমায় হ্যারা আমার প্যাটে ছুরি মাইরা গেলোগা।”
এদিকে জনতার হাতে ধরা পড়া ডাকাত বোরহানউদ্দীনের বাসা গাজীপুরের কালিয়াকৈরের চন্দ্রা এলাকায়। বুধবার সেই এলাকায় গিয়ে জানা যায় চন্দ্রা এলাকার বিভিন্ন বাড়িতে ১৫/২০ বছর ধরে ভাড়া থাকেন বোরহান। আগে ট্রাকের কর্মী ছিলেন। এখন নিজেই পাঁচটি মিনি ট্রাকের মালিক বোরহান।
বোরহানের ভাড়া বাসার মালিক রূপজান বেগম বলেন, সবসময় মাথায় পাগড়ি-পাঞ্জাবি পরে থাকতেন বোরহান। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পরতেন। এলাকার সবাই তাঁকে খুব ভালো জানত। তাঁর নিজের পাঁচটি গাড়ি রয়েছে। সচ্ছলভাবেই চলতো বোরহানের সংসার।
বোরহানের বাড়ি মালিক ও প্রতিবেশীদের ধারণা, শুধু টাকার জন্য নয়, কোনো আদর্শের টানেই বোরহান ওই ডাকাতিতে জড়িয়েছেন। মঙ্গলবার রাতেই পুলিশ বোরহানের বাড়ি তল্লাশি করে এক ব্যাগ ‘জিহাদি বই’ উদ্ধার করেছে বলে জানান আশুলিয়া থানার ওসি মোস্তফা কামাল। এ ছাড়া বোরহানের পাঁচটি ট্রাকও জব্দ করা হয়েছে।
এদিকে বাসার মালিক রূপজান জানান, মঙ্গলবার দুপুরে ডাকাতির ঘটনার পরে বিকেলে বোরহানের স্ত্রী তাঁর চার বছরের শিশু কন্যাকে নিয়ে বাজার যাওয়ার কথা বলে বাসা থেকে এক কাপড়ে বের হয়ে যান। আর ফেরেননি।
ব্যাংক ডাকাতির ঘটনায় আহত আইয়ুব আলী নামে একজন আহত ব্যক্তি সাভারের এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে কিছুক্ষণ আগে মারা গেছেন। এ নিয়ে মৃতের সংখ্যা হলো নয়জন।
বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংকের আশুলিয়ার কাঠগড়া শাখায় ডাকাতদের হামলায় নিহত শাখা ব্যবস্থাপকের পরিবারকে পাঁচ লাখ টাকা দেবে ব্যাংক কর্তৃপক্ষ পাশাপাশি তার স্ত্রী মেরি খাতুনকে ব্যাংকে চাকরি দেওয়ারও সিদ্ধান্ত হয়েছে।
ব্যাংকের এক জরুরি বোর্ড সভায় এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। ওই ঘটনায় নিহত অন্য ছয় জনের পরিবারকেও এক লাখ টাকা করে দেবে ব্যাংক।
এর বাইরে ব্যাংকের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা এপ্রিল মাসের এক দিনের মূল বেতন নিহত শাখা ব্যবস্থাপকের পরিবারকে দেওয়ার সিদ্ধান্ত জানিয়েছে।
ইতোমধ্যে ২১ এপ্রিলের ঘটনায় নিহতদের প্রত্যেকের পরিবারকে এক লাখ টাকা অনুদান দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।