দুমাস পর বিদেশে সালাহ উদ্দিনের বেঁচে থাকার খবর দিলেন তার স্ত্রী
2015.05.12

“আমার স্বামী সুস্থ আছেন বলে আমাকে জানিয়েছেন,”—এই সুখবরটি শোনার অপেক্ষায় ছিল দেশের বিবেকবান মানুষেরা। সালাহ উদ্দিনের স্ত্রী হাসিনা আহমদের মুখেই ১২ মে শোনা গেল প্রতীক্ষিত ওই খবরটি।
দুই মাসের বেশি সময় ধরে নিখোঁজ থাকা বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব সালাহ উদ্দিন আহমেদ বেঁচে আছেন—এই খবর পাওয়ার পর রাজনৈতিক অঙ্গনে পাল্টাপাল্টি বক্তৃতা–বিবৃতি শুরু হয়েছে। কিন্তু দলমত-নির্বিশেষে সাধারণ মানুষ এই খবরে বেশ খুশি।
রাজনীতিতে জনপ্রিয় এই মুখ এবং দলের শীর্ষপদে থাকা একজন নেতার এমন পরিণতি নিয়ে দেশে–বিদেশে কঠোর সমালোচনা হচ্ছিল। হাসিনা আহমেদ ১২ মে দুপুরে সংবাদ সম্মেলন করে জানান, ভারতের মেঘালয় রাজ্যের শিলংয়ের মিমহানস মানসিক হাসপাতাল থেকে ফোন করেন তাঁর স্বামী সালাহ উদ্দিন।
দ্য শিলং টাইমসের অনলাইনে ১২ মে প্রকাশিত খবরের শিরোনাম ছিল ‘বাংলাদেশি ম্যান হেল্ড’।ওই খবরে বলা হয়, মঙ্গলবার সকালে পুলিশ শিলংয়ের গলফ লিংক এলাকা থেকে বাংলাদেশি নাগরিক সালাহ উদ্দিনকে গ্রেপ্তার করেছে।বিষয়টি তদন্তাধীন।
২০১৩ সালের ২৩ অক্টোবর বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে বন্দী বিনিময় চুক্তির অনুসমর্থন দলিল স্বাক্ষর ও বিনিময় হয়েছে। চুক্তির বিধান অনুযায়ী আইনানুগ কর্তৃপক্ষের অনুরোধে একদেশ অন্য দেশের কাছে দণ্ডপ্রাপ্ত বা বিচারাধীন ব্যক্তিকে অপরাধের সাজার মেয়াদ ন্যূনতম এক বছর হলে বহিঃসমর্পণ করতে পারবে।
তবে, চুক্তিতে বর্ণিত বিধানাবলি সাপেক্ষে রাজনৈতিক চরিত্রের অপরাধের ক্ষেত্রে বহিঃসমর্পণ অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করার সুযোগ থাকবে। কোনো দণ্ডপ্রাপ্ত বা অভিযুক্তকে স্বল্প সময়ের জন্য সাময়িকভাবে বহিঃসমর্পণ করা যাবে।
ওই চুক্তি অনুযায়ী উলফা নেতা অনুপ চেটিয়ার ব্যাপারে দুই দেশ যথাযথ ব্যবস্থা নিতে পারবে বলা হলেও আজও তাঁকে ভারতের কাছে দেয়নি বাংলাদেশ। আবার নারায়ণগঞ্জে সাত খুনের মামলার আসামি নূর হোসেনকেও ফেরত দেয়নি ভারত। এরই মধ্যে সালাহ উদ্দিনের বিষয়টি দুই দেশের সামনে এসেছে।
তবে খুব শিগগির সালাহ উদ্দিন ঢাকায় ফিরতে পারছেন না বলে দুই দেশের একাধিক সূত্র নিশ্চিত করেছে। ওই সব সূত্র জানায়, তাঁর কাছে কোনো বৈধ কাগজপত্র নেই। এ জন্য তাঁকে দেশে ফিরতে হলে বাংলাদেশ সরকারের সহায়তা নিতে হবে।
“যেহেতু বৈধ কাগজপত্র ছাড়া তিনি ওই দেশে গেছেন, সেহেতু সেখানকার আইনি প্রক্রিয়া শেষ হওয়ার পর দুই দেশের মধ্যে যোগাযোগ হবে। এরপর বন্দী বিনিময় চুক্তি কীভাবে কার্যকর করা যায়, তা পর্যালোচনা করে দেখবে দুই দেশ,” বেনারকে টেলিফোনে জানান আইনমন্ত্রী আনিসুল হক।
সরকারের একাধিক সূত্র জানায়, বন্দী বিনিময় চুক্তি অনুযায়ী তাঁকে বাংলাদেশে পাঠানো হলেও পুলিশের জিম্মায় দেওয়া হবে। কারণ তিনি একাধিক মামলার আসামি। এ ছাড়া তাঁকে পুশব্যাক করেও এ দেশে পাঠানোর সুযোগ আছে।
সরকারি কর্মকর্তা হিসেবে ১৯৯১-৯৬ মেয়াদে প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার এপিএস ছিলেন সালাহ উদ্দিন। পরে তিনি চাকরি ছেড়ে কক্সবাজারের সাংসদ নির্বাচিত হন এবং যোগাযোগ প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব পান। তাঁর স্ত্রী হাসিনাও সংসদ সদস্য ছিলেন।
সরকারের নির্দেশে আইন শৃংখলারক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরাই সালাহ উদ্দিনকে নিয়ে গেছে বলে এত দিন বিএনপির পক্ষ থেকেও অভিযোগ করা হয়।
তবে সরকারের পক্ষ থেকে সে অভিযোগ নাকচ করা হয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, সালাহ উদ্দিনকে গ্রেপ্তার করা হয়নি। তবে তাকে আটক করতে খুঁজছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। সালাহ উদ্দিনের অন্তর্ধানে তার দলের ‘হাত রয়েছে’ বলেও সে সময় ইঙ্গিত দেন প্রধানমন্ত্রী।
এর আগে বিএনপির দুই প্রভাবশালী নেতা ইলিয়াস আলী এবং চৌধুরী আলম কয়েক বছর আগে নিখোঁজ হলেও তাঁদের আর পাওয়া যায়নি।
স্বামীর খোঁজ চেয়ে উচ্চ আদালতেও যান সাবেক সাংসদ হাসিনা আহমেদ। তবে পুলিশের পক্ষ থেকে আদালতকে বলা হয়, তারাও এই বিএনপি নেতার কোনো খোঁজ জানে না।
সালাহ উদ্দিনকে খুঁজে পাওয়া গেল কি-না সে বিষয়ে নিয়মিত অগ্রগতি প্রতিবেদন দিতে পুলিশকে নির্দেশ দিয়ে হাই কোর্ট গত ১২ এপ্রিল আবেদনটি নিষ্পত্তি করে দেয়।
এর মধ্যে ১৯ মার্চ ও ৭ এপ্রিল প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে গিয়ে দুই দফা স্মারকলিপি দিয়ে আসেন হাসিনা আহমেদ। তিনি প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করারও ইচ্ছা প্রকাশ করেন।
এরই মধ্যে ১২ মে দুপুরে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার সঙ্গে দেখা করতে তার গুলশানের বাসায় যান সালাহ উদ্দিনের স্ত্রী। প্রায় ৪৫ মিনিট পর বেরিয়ে এসে পরে তিনি নিজেই ফোন পাওয়ার কথা সাংবাদিকদের কাছে স্বীকার করেন।
গুলশানে নিজের বাসার নিচতলায় সংবাদ সম্মেলনে হাসিনা আহমেদ বলেন, “ভারতের মেঘালয় রাজ্যের মেঘালয় ইনস্টিটিউট অব মেন্টাল হেলথ অ্যান্ড নিউরোসায়েন্সেস হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ তাঁকে ফোন দিয়ে জানায়, সালাহ উদ্দিন তাঁদের হাসপাতালে আছেন। পরে সালাহ উদ্দিন টেলিফোনে স্ত্রীকে বলেন, আল্লাহর রহমতে তিনি বেঁচে আছেন।
বিএনপি জোটের সরকারবিরোধী আন্দোলনের মধ্যে গত ১০ মার্চ উত্তরার ৩ নম্বর সেক্টরের ১৩-বি নম্বর সড়কের একটি বাড়ির দোতলার ফ্ল্যাটে ঢুকে একটি বাসায় লুকিয়ে থাকা অবস্থায় সালাহ উদ্দিনকে তুলে নেওয়া হয় বলে তার পরিবারের অভিযোগ। সেখান থেকেই দলের পক্ষে বিবৃতি ও কর্মসূচি দিচ্ছিলেন দলের যুগ্ম মহাসচিব সালাহ উদ্দিন।
“মেঘালয়ের গলফ গ্রিন এলাকায় ঘোরাফেরার সময় সালাহ উদ্দিনকে পুলিশ আটক করে। প্রথমে তাঁর কথা শুনে পুলিশের মনে হয়েছে, তিনি অপ্রকৃতিস্থ। এরপর তাঁকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।চিকিৎসা শেষে তিনি সুস্থ বলে চিকিৎসকেরা জানান,” টেলিফোনে বেনারকে জানান শিলং টাইমসের সম্পাদক মানস চৌধুরী।তিনি পুলিশের হেফাজতে আছে বলেও জানান ওই সাংবাদিক।
এদিকে বিএনপি নেতা সালাহ উদ্দিন আহমেদকে নিয়ে এত দিন বিএনপি মিথ্যাচার করেছে বলে মন্তব্য করেছেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী ও ১৪ দলের মুখপাত্র মোহাম্মদ নাসিম। ১২ মে ১৪ দলের বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে মোহাম্মদ নাসিম বলেন, “খালেদা জিয়া এত দিন দাবি করেছেন, সালাহ উদ্দিন র্যাবের কাছে আছে। বেগম সালাহ উদ্দিন বলেছেন, তিনি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে আছে। এসব দাবি এখন মিথ্যাচারে পরিণত হয়েছে।”
আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য সুরঞ্জিত সেনগুপ্তও সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে বলেন, “আশা করি, তিনি শিগগিরই মেঘালয় থেকে আপন আলয়ে আসবেন। এসব তাদের (বিএনপি) অন্তরালের ব্যাপার।” জাতীয় সংসদ ভবনের মিডিয়া সেন্টারে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি এ কথা বলেন।
দলের শীর্ষস্থানীয় একজন নেতা ফিরে এলেও দলের পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিক কোনো প্রতিক্রিয়া জানানো হয়নি।
“আমরা এই খবরে খুশি। দেশের মানুষ তাঁর জন্য অপেক্ষা করছিল,” বেনারকে জানান খালেদা জিয়ার বিশেষ সহকারী শামসুর রহমান শিমুল বিশ্বাস।