ঝটিকা সফরে ঢাকায় সৌদি পররাষ্ট্র মন্ত্রী

ঢাকা থেকে জেসমিন পাপড়ি
2016.03.09
BD-Saudi সৌদি আরবের সৌদি আরবের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবদেল আল জুবায়ের ঢাকায় মঙ্গলবার প্রধানমন্ত্রীর সাথে সাক্ষাত করেন।
ফোকাস বাংলা

মাত্র তিন ঘণ্টার এক ঝটিকা সফরে ঢাকায় এসেছিলেন সৌদি আরবের সৌদি আরবের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবদেল আল জুবায়ের। সংক্ষিপ্ত হলেও দীর্ঘ ২৩ বছর পর মুসলিম বিশ্বের প্রভাবশালী দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর এ সফরকে তাৎপর্যপূর্ণ বলে মনে করছেন কূটনীতিবোদ্ধারা।

তারা বলছেন, সদ্য গঠিত সন্ত্রাসবিরোধী জোটের অবস্থান পরিষ্কারসহ দেশটিতে আরো বাংলা্দেশি শ্রমিক নিয়োগের সুযোগ তৈরি করবে সৌদি পররাষ্ট্র মন্ত্রীর এ সফর।


এয়াপোর্ট থেকেই প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর

এত তড়িৎ সফরের জন্য বোধ হয় প্রস্তুত ছিল না পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ও। একেবারে শেষ মুহুর্ত পর্যন্ত চলে প্রস্তুতি পর্ব। গত সপ্তাহে জাকার্তায় অনুষ্ঠিত  ৫ম এক্সট্রা-অর্ডিনারি ওআইসি সম্মেলন শেষে দেশে ফেরার পথে ঢাকায় যাত্রাবির‌তি করার সিদ্ধান্ত নেন সৌদি পররাষ্ট্র মন্ত্রী। রোববার ওই বি‌শেষ স‌ম্মেল‌নের ফাঁকে তার স‌ঙ্গে বৈঠক ক‌রেন বাংলাদেশর পররাষ্ট্রমন্ত্রী এএইচ মাহমুদ আলী। সৌ‌দি পররাষ্ট্রমন্ত্রীর ঢাকায় যাত্রা‌ বির‌তির কথা জেনেই গত সোমবার রা‌তে জরুরি ভিত্তি‌তে ঢাকা ফেরেন তিনি।

এরপর মঙ্গলবার বিকেল ৫টা ৫৫ মিনিটে ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অবতরণ করেন সৌদি পররাষ্ট্র মন্ত্রীকে বহনকারী বিশেষ বিমান। সেখান থেকে তিনি সরাসরি চলে যান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বাসভবনে। রাতে পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাহমুদ আলীর সঙ্গে রাতে খাবার গ্রহণের কথা থাকলেও শেষ পর্যন্ত বাতিল হয় সে পর্ব। প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাত শেষ করেই তিনি ফেরার পথ ধরেন।

সৌদি পররাষ্ট্র মন্ত্রী আল জুবেইর বিমানবন্দরে নেমেই  সাংবাদিকদের বলেন, সংক্ষিপ্ত এ সফরে “দুদেশের মধ্যে সমন্বয় এবং সহযোগিতা কীভাবে বাড়ানো যায় সে বিষয়ে আলোচনা হবে।”


সন্ত্রাস দমনে সহযোগিতার দৃঢ় প্রতিশ্রুতি বাংলাদেশের

গত বছরের শেষ দিকে গঠিত সৌদি নেতৃত্বাধীন সন্ত্রাসবিরোধী জোটে যোগ দেয় বাংলাদেশ। মূলত: এ বৈঠকে যোগ দেওয়ার পরেই দুদেশের সম্পর্কে নতুন মাত্রা যোগ হয় বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা।

প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সৌদি মন্ত্রীর  বৈঠকেও সন্ত্রাস মোকাবেলার বিষয়টি উঠে আসে। এসময় সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের দৃঢ় অবস্থানের কথা তাকে জানান শেখ হাসিনা। সন্ত্রাস দমন প্রচেষ্টায় সৌদি আরবকে সর্বাত্মক সমর্থন দেওয়ার আশ্বাস দেন তিনি।

গণভবনে বৈঠকের পর প্রধানমন্ত্রীর প্রেস সচিব ইহসানুল করিম সাংবাদিকদের বলেন, “সন্ত্রাসবাদের বিষয়ে তার সরকারের জিরো টলারেন্স নীতির কথা উল্লেখ করে সৌদি পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে প্রধানমন্ত্রী বলেন, সন্ত্রাসবাদ মোকাবেলায় বাংলাদেশ সহায়তা করবে। বাংলাদেশ সব ধরনের সন্ত্রাসের নিন্দা করে এবং এ ব্যাপারে কোনো ছাড় না দেওয়ার নীতি অনুসরণ করে আসছে।”

সৌদি পররাষ্ট্র মন্ত্রীকে শেখ হাসিনা বলেন, কিছু লোক ধর্মের নামে শান্তির ধর্ম ইসলামের সত্যিকার আদর্শকে কালিমালিপ্ত করছে। জবাবে সৌদি পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ইসলাম ভালোবাসা, শান্তি ও ক্ষমার শিক্ষা দেয়। কিন্তু উগ্রপন্থীরা ইসলামের মূল্যবোধকে ধ্বংস করছে। তারা এ ক্ষেত্রে গণমাধ্যমসহ বিভিন্ন খাতকে যুক্ত করার অপচেষ্টা চালাচ্ছে। সন্ত্রাসবাদ নিয়ন্ত্রণ করা না গেলে তা এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় ছড়াতে থাকবে

বৈঠকে সৌদিপ্রবাসী বাংলাদেশি শ্রমিকদের পাশাপাশি বিনিয়োগ এবং দুই দেশের সহযোগিতার নতুন নতুন ক্ষেত্র নিয়েও কথা হয়। দুই দেশের সহযোগিতাকে আরও এগিয়ে নিতে ব্যবসা-বাণিজ্যের নতুন ক্ষেত্র বের করার পরামর্শ দেন প্রধানমন্ত্রী। বাংলাদেশে সৌদি আরবের আরও বিনিয়োগ এবং উচ্চ পর্যায়ের নেতাদের সফর বিনিময়েও জোর দেন তিনি।


আরো বাংলাদেশি শ্রমিক নিয়োগ দেবে সৌদি

বাংলাদেশের কর্মীদের জন্য সৌদি অন্যতম প্রধান শ্রম বাজার। তবে বেশ কয়েক বছর ধরেই সৌদি আরবে বাংলাদেশি কর্মী যাওয়ায় শিথিলতা দেখা যায়। নামমাত্র সংখ্যক নারী কর্মী ছাড়া এদেশ থেকে সব ধরনের শ্রমিক নেওয়া বন্ধ রাখে সৌদি সরকার। তবে সম্প্রতি নারী শ্রমিকের পাশাপাশি পুরুষ শ্রমিক নেওয়ার বিষয়েও আগ্রহ দেখায় দেশটি। সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, সৌদি পররাষ্ট্র মন্ত্রীর এ আশ্বাস এ বিষয়ে আরো গতি আনবে।

প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকেও বাংলাদেশ থেকে আরো বেশি শ্রমিক নেবার কথা জানান সৌদি পররাষ্ট্রমন্ত্রী আদেল আল জুবেইর।

বুধবার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক বিবৃতিতে সে কথা জানানো হয়। এতে বলা হয়, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সাক্ষাতে বাংলাদেশ থেকে আরো শ্রমিক নেয়ার ব্যাপারে সৌদি সরকারের আগ্রহের কথা জানান দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রী। এ প্রসঙ্গে সম্প্রতি সৌদি আরবে কর্মরত বহু বাংলাদেশি শ্রমিককে কাগজপত্র বৈধ করার সুযোগ দেওয়ায় ধন্যবাদ জানান শেখ হাসিনা।


বিরল ব্যাপার

সংক্ষিপ্ত হলেও সৌদি পররাষ্ট্র মন্ত্রীর এ সফরকে বিরল ও তাৎপর্যপূর্ণ মনে করছেন আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকরা। সৌদি আরব ও উপসাগরীয় অঞ্চলের দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক দৃঢ় করতে সফরটি ভূমিকা রাখবে বলে মনে করেন তারা।

এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ড. দেলোয়ার হোসেন বেনারকে বলেন, “বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির জন্য সৌদি পররাষ্ট্র মন্ত্রীর এই সফরটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, ১৯৮৩ সালের পরে এই প্রথম  কোন সৌদি পররাষ্ট্র মন্ত্রীর বাংলাদেশ সফর এটি। উপসাগরীয় অঞ্চলের দেশগুলোর উপর সৌদি আরবের একটি ব্যাপক প্রভাব রয়েছে। উপসাগরীয় অঞ্চল ও মধ্যপ্রাচ্যে বাংলাদেশেরও স্বার্থ রয়েছে। তাই এ সফরের মাধ্যমে সৌদির সঙ্গে বাংলাদেশের দ্বিপাক্ষিক বিষয়গুলো ছাড়াও আঞ্চলিক নানা বিষয়েও আলোচনা হওয়ার সুযোগ ছিল।”

সন্ত্রাস বিরোধী জোট প্রসঙ্গ টেনে এই আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষক আরো বলেন, “সৌদি নেতৃত্বাধীন সদ্য গঠিত ৩৪টি দেশের সন্ত্রাসবিরোধী জোটের বিষয়টি এখনো পরিষ্কার নয়, জোটটির কার্যক্রমও দেখছি না। এটা এখনো কূটনৈতিক পর্যায়ের বিদ্যমান রয়েছে। সেদিক থেকে বাংলাদেশের জন্য অনেকটা স্বস্তির বিষয়। কারণ, অনেকটা কূটনৈতিক বিবেচনা থেকে বাংলাদেশ এ জোটকে সমর্থন করে যোগ দিয়েছে। পাশাপাশি সৌদির সঙ্গে আমাদের দীর্ঘদিনের সম্পর্ক ও ইতিহাসের ধারাবাহিকতা ও মধ্যপ্রাচ্যের বাংলাদেশের বিরাট শ্রম বাজারের বিষয়টিও বিবেচনা করতে হয়েছে”।

ড. দেলোয়ার বলেন, “বাংলাদেশের জাতীয় স্বার্থ বিবেচনা করলে, এদেশের কূটনীতির ইতিহাস জানলে, তাহলে সৌদি আরবের মত একটি শক্তিশালী রাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রীর বাংলাদেশ সফর, সেটা এক বা দুই ঘণ্টার হোক–আমাদের মত দেশের জন্য বিরাট বড় ঘটনা।”


আছে ভিন্ন প্রশ্ন!

এদিকে সৌদি পররাষ্ট্র মন্ত্রীর ঢাকা সফর আর যুদ্ধাপরাধী মীর কাসেমের বিরুদ্ধে আপিল বিভাগ রায় ঘোষণার দিন একই হওয়ায় ভিন্ন প্রশ্নও তুলেছে একটি মহল। সফর মীর কাসেমর মত ‍যুদ্ধাপরাধীকে বাঁচানোর কোন উদ্দেশ্য কিনা এমন প্রশ্ন শোনা যায় কিছু মানুষের মুখে। যদিও তারা প্রকাশ্যে বক্তব্য দিতে চাননি। বেনারের সঙ্গে আলাপে অনেকের কণ্ঠেই এ শঙ্কা শোনা যায়। তবে সে শঙ্কাকে উড়িয়ে দিয়েছেন যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে সক্রিয়রা। আর আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষকরা তো পাত্তাই দেননি এ অভিযোগ।

এ বিষয়ে ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির নির্বাহী সম্পাদক শাহরিয়ার কবির বেনারকে বলেন, “পশ্চিমা কয়েকটি দেশের মত সৌদি আরব কখনও প্রকাশ্য যুদ্ধাপরাধীদের পক্ষ নেয়নি। তাই মীর কাসেমের পক্ষে সাফাই গাওয়ার প্রশ্নই নেই। যদি তারা সেটা করত, তাহলে গোলাম আজম কিংবা মতিউর রহমান নিজামীর মত জামায়াত ইসলামীর শীর্ষ নেতাদের জন্যই করতে পারত। মীর কাসেম বিপুল অর্থ সম্পদের মালিক হলেও তিনি জামায়াতের ‘অত’ বড় নেতা নন। তাই সৌদি পররাষ্ট্র মন্ত্রীর এ সফর নিতান্তই কূটনীতিক সফর।”

সৌদি পররাষ্ট্র মন্ত্রী জাকার্তা থেকে ফেরার পথে দিল্লীতেও যাত্রা বিরতি করেন। এসময় তিনি ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সঙ্গে বৈঠক করেন। বৈঠকে দ্বিপাক্ষিক নানা বিষয়ের পাশাপাশি আঞ্চলিক বিষয়গুলোও গুরুত্ব পায় বলে গণমাধ্যমে প্রকাশ হয়। দিল্লী থেকেই ঢাকা আসেন আবদেল আল জুবায়ের।


ঢাকা থেকে সরাসরি কার্গো বিমান নিষিদ্ধ যুক্তরাজ্যে

নিরাপত্তা যথেষ্ট নয় কারণ দেখিয়ে ঢাকার শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে কার্গো বিমানের (পণ্যবাহী উড়োজাহাজ) যুক্তরাজ্যে সরাসরি  ফ্লাইট নিষিদ্ধ করা হয়েছে।

যুক্তরাজ্য সরকারের ডিপার্টমেন্ট অব ট্রান্সপোর্টের ওয়েবসাইটে এক বিজ্ঞপ্তিতে এ মঙ্গলবার ঘোষণা দেওয়া হয়।
বলা হয়, সম্প্রতি ঢাকা আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের নিরাপত্তা পরিস্থিতি পর্যালোচনায় দেখা গেছে আন্তর্জাতিক মানদণ্ড নিশ্চিতের জন্য প্রয়োজনীয় কিছু ঘাটতি রয়েছে।

তবে এই পদক্ষেপকে সাময়িক বলে উল্লেখ করা হয়।

পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া নাগাদ এ সিদ্ধান্ত বহাল থাকবে বলে যুক্তরাজ্য সরকার জানিয়েছে।

এ ব্যপারে বিমান ও পর্যটন মন্ত্রী রাশেদ খান মেননের কাছে জানতে চাওয়া হলে তিনি বেনার নিউজকে বুধবার বলেন, “গত বছর অক্টোবরে বিমান বন্দরে নিরাপত্তা মান বাড়ানোর কথা তোলার পর আমরা অনেকগুলো পদক্ষেপ নিয়েছি, স্ক্যান মেশিন সহ কিছু যন্ত্রপাতিও বসানো হয়েছে”।

“আমরা জানতে পেরেছি তারা একটা  সন্ত্রাসী পরিকল্পনার খবর পেয়েছে যে, বাংলাদেশ থেকে লন্ডনগামী একটি কার্গোতে ক্ষতিকর কিছু নেয়া হচ্ছে”।

“কিন্তু দূর্ভাগ্যের বিষয় তারা আমাদের সরাসরি কার্গো পরিবহন বন্ধ করে দিয়েছে”। “তবে তারা আস্বস্ত করেছে যে এটা সাময়িক এ মাসেই নিষেধাজ্ঞা তুলে নেবে”।

 

*ঢাকা থেকে কামরান রেজা চৌধুরী এই প্রতিবেদনে অবদান রেখেছেন।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।