শীর্ষ সন্ত্রাসী জোসেফের ফাঁসি মওকুফ নিয়ে নানা প্রশ্ন ও কৌতুহল
2015.12.09

দেশের আলোচিত ‘শীর্ষ সন্ত্রাসী’ জোসেফের মৃত্যুদণ্ডের সাজা কমিয়ে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিয়েছে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ। একই সঙ্গে এই মামলার আরেক আসামি যাবজ্জীবন কারাদণ্ডাদেশ পাওয়া কাবিল সরকারকে খালাস দিয়েছে সর্বোচ্চ আদালত।
জোসেফ পুলিশ ঘোষিত দেশের ২৪ শীর্ষ সন্ত্রাসীর একজন, জেলে থাকলেও যাঁর অপরাধ জগতের সঙ্গে যোগাযোগ থাকার বিষয়টি নিয়ে আলোচনা রয়েছে।
গতকাল বুধবার হাই কোর্টের দেওয়া মৃত্যুদণ্ডের রায়ের বিরুদ্ধে জোসেফের করা আপিলে তার সাজা কমিয়ে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিয়েছেন প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহার নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের বেঞ্চ। রাজধানীর মোহাম্মদপুরের ফ্রিডম পার্টির নেতা ও ব্যবসায়ী মোস্তাফিজুর রহমান হত্যা মামলার আপিলে এই রায় আসে।
অভিজাত পরিবারের সন্তান জোসেফের বড় ভাই মেজর জেনারেল আজিজ আহমদ বর্তমানে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) মহাপরিচালক। তাঁদের বাবা বিমানবাহিনীর সাবেক কর্মকর্তা ওয়াদুদ আহমেদ।
জোসেফের বড় ভাই হারিস আহমেদের নামও রয়েছে পুলিশের শীর্ষ সন্ত্রাসীর তালিকায়। হারিস বর্তমানে ভারতে পালিয়ে আছেন বলে ধারণা করা হয়। নব্বইয়ের দশকে সন্ত্রাসীদের গুলিতে নিহত হন তাদের আরেক ভাই সাঈদ আহমেদ টিপু।
জোসেফ এক সময় নিজেকে ছাত্রলীগের মোহাম্মদপুর থানার নেতা হিসাবে দাবি করত। তবে সংগঠনের কোনো পদে তার নাম ছিল না।
আদালতের এই রায় নিয়ে ক্রিয়া–প্রতিক্রিয়া থাকলেও একাধিক আইনজীবীর সঙ্গে বেনার কথা বলেছে। কিন্তু এ বিষয়ে কেউ আনুষ্ঠানিক মন্তব্য করতে চাননি।
জোসেফের মুক্তির সম্ভাবনা বাড়ল
এ মামলার আরেক আসামি কাবিল সরকারের আপিল মঞ্জুর করে তাকে খালাস দিয়েছে সর্বোচ্চ আদালত। কাবিল যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিত ছিলেন এবং তার সাজার মেয়াদ কয়েক বছর বাকি থাকতেই তাঁকে ছেড়ে দেওয়া হল।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক আইনজীবী বলেন, জোসেফের বেলায়ও এই দৃষ্টান্ত প্রয়োগের একটি সুযোগ রয়ে গেল। জোসেফ ১৭ বছর জেলে রয়েছে। মৃত্যুদণ্ড থেকে যাবজ্জীবন হওয়ায় সেও কাবিলের মতো মুক্তি পেতে পারে।
তোফায়েল আহমেদ ওরফে জোসেফ ১৭ বছর আগে যখন গ্রেপ্তার হন, তার নামে তখন ঢাকার বিভিন্ন থানায় চাঁদাবাজি, খুন, অবৈধ অস্ত্র বহনের অভিযোগে অন্তত ১১টি মামলা ছিল। এর মধ্যে মোস্তাফিজুর রহমান হত্যা মামলা ছাড়া বাকিগুলোর নিষ্পত্তি হয়েছিল আগেই।
“এই হত্যা মামলায় সাজা কমে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হলেও এখনই জোসেফ মুক্তি পাচ্ছেন না,” সাংবাদিকদের জানান তার আইনজীবী এ এম আমিন উদ্দিন।
“ঘটনার সময় জোসেফের বয়স ছিল ২০ বছর। ১৭ বছর ধরে তিনি কারাগারে আছেন। এর মধ্যে ১১ বছর ধরে আছেন কনডেম সেলে। বিষয়টি অমানবিক,” বেনারকে জানান আসামিপক্ষের আরেক আইনজীবী এস এম শাজাহান।
মামলার নথি থেকে জানা যায়, ১৯৯৬ সালের ৭ মে মোহাম্মদপুরে খুন হয় ফ্রিডম পার্টির নেতা ও ব্যবসায়ী মোস্তাফিজুর রহমান।
পরদিন তার স্ত্রী রাশিদা পারভিন মোহাম্মদপুর থানায় মামলা করেন। ওই বছর ৮ অক্টোবর পুলিশ আদালতে অভিযোগপত্র দেয়।
ঢাকার দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল ২০০৪ সালের ২৫ এপ্রিল যে রায় ঘোষণা করে, তাতে জোসেফ ও মাসুদ জমাদারের মৃত্যুদণ্ড এবং কাবিল সরকার, আনিছ আহমেদ এবং জোসেফের ভাই হারিছ আহমেদের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়।
নিম্ন আদালতের রায়ের পর ওই বছর হাই কোর্টে আপিল করেন জোসেফ, মাসুদ ও কাবিল। আসামি আনিছ ও হারিছ শুরু থেকেই পলাতক ছিলেন।
আসামিদের ডেথ রেফারেন্স ও আপিলের শুনানি শেষে ২০০৭ সালের ২০ সেপ্টেম্বর হাই কোর্ট রায় দেয়। ওই রায়ে জোসেফ ও কাবিলের সাজা বহাল থাকে, ফাঁসির আসামি মাসুদ জমাদার খালাস পান।
হাই কোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে ২০০৯ সালে আপিল করেন জোসেফ ও কাবিল। ওই আপিলের শুনানি শেষে বুধবার চূড়ান্ত রায় ঘোষণা হয়।
“কাবিল সরকারের আপিল মঞ্জুর করে তাকে খালাস দেওয়া হয়েছে। এর ফলে তার মুক্তিতে আইনগত কোনো বাধা নেই,” সাংবাদিকদের জানান কাবিল সরকারের আইনজীবী খন্দকার মাহবুব হোসেন।
নিজামীর সাজা কমা নিয়ে আলোচনা
যুদ্ধাপরাধী মতিউর রহমান নিজামীর মৃত্যুদণ্ডের রায় কমিয়ে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়ার বিষয়টি নিয়ে যখন আলোচনা চলছে তার মধ্যে এই রায় কৌতুহল সৃষ্টি করেছে।
যদিও আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের একাধিক আইনজীবী মনে করেন, বিষয়টি কাকতালীয় হতে পারে।
একাত্তরে বুদ্ধিজীবী হত্যা, গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের দেওয়া ফাঁসির আদেশের বিরুদ্ধে জামায়াতে ইসলামীর আমির মতিউর রহমান নিজামীর করা আপিলের রায় আগামী ৬ জানুয়ারি ঘোষণা করবেন দেশের সর্বোচ্চ আদালত।
প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার নেতৃত্বাধীন সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের চার সদস্যের বেঞ্চ গত মঙ্গলবার নিজামীর আপিলের রায় ঘোষণার এই দিন ধার্য করেন।
ওই দিন অ্যাটর্নি জেনারেল সাংবাদিকদের বলেছেন, তাঁরা আশা করছেন, বুদ্ধিজীবী হত্যার অভিযোগে নিজামীরও মৃত্যুদণ্ডাদেশ বহাল থাকবে।
আর নিজামীর আইনজীবী খন্দকার মাহবুব হোসেন বলেছেন, যে সাক্ষ্যপ্রমাণ আছে, তাতে নিজামী নির্দোষ প্রমাণিত হয়ে খালাস পাবেন।
তবে একাধিক আইনজীবী জানান, বয়স বিবেচনায় নিজামীর ফাঁসির দণ্ড কমিয়ে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হতে পারে।
এর আগে অ্যাটর্নি জেনারেল সাংবাদিকদের জানিয়েছিলেন, বয়স বিবেচনায় তাঁর ফাঁসি মওকুফের পক্ষেও মত দিয়েছেন নিজামীর আইনজীবী। এ থেকে ধারণা তৈরি হয়েছে, তাঁর ফাঁসি মওকুফ হয়ে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হতে পারে।