জঙ্গি দমনে এবার পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ইউনিট
2016.01.04

বাংলাদেশের জন্য একটি হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে জঙ্গিবাদ। তা দমনে বিচ্ছিন্নভাবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কাজ করে যাচ্ছে। তবে এবার এ কাজে পুলিশের সক্ষমতা বাড়াতে বিশেষায়িত বাহিনী গঠন করছে সরকার। ইতিমধ্যে ‘কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্স ন্যাশনাল ক্রাইম’ নামের নতুন এ ইউনিট গঠনের কাজ চলছে। প্রয়োজনীয় সরঞ্জামাটি কেনাকাটাও সম্পন্ন। শীঘ্রই ইউনিটটি কাজ শুরু করবে।
সরকারের এ উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়েছেন অপরাধ বিজ্ঞানীরা। তাদের মতে, এ ধরনের বিশেষায়িত বাহিনী এখন সময়ের দাবি।
যারা থাকবেন এ ইউনিটে
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে, জঙ্গি দমনে এই ইউনিটকে বিশেষভাবে শক্তিশালী করতে চায় সরকার। ইউনিটের প্রধান থাকবেন উপমহাপরিদর্শক (ডিআইজি) পদমর্যাদার একজন কর্মকর্তা।এছাড়াও ৬০০ সদস্যের এই ইউনিটে একজন অতিরিক্ত ডিআইজি, চারজন পুলিশ সুপার, ১০ জন অতিরিক্ত উপকমিশনার ও ২০ জন সহকারী কমিশনার থাকবেন। ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি) ও পুলিশের গোয়েন্দা শাখার বিশেষায়িত ইউনিটে কাজ করা কর্মকর্তারা এর সঙ্গে যুক্ত থাকবেন।
কর্ম পরিধি
সরকার এই বিশেষ ইউনিটকে প্রযুক্তিতে বিশেষভাবে দক্ষ করে গড়তে চায়। জঙ্গি ও সন্ত্রাসবাদ দমনে প্রযুক্তিনির্ভর এই বিশেষ ইউনিট গঠনকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে দেখছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। দেশে ও দেশের বাইরের সন্ত্রাসীদের তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ, তাদের অপতৎপরতা প্রতিরোধ, সন্ত্রাসীদের গতিবিধি সব সময় তদারক করা এবং তাদের গ্রেপ্তারে কাজ করবে এই ইউনিট।
জঙ্গি দমনে এ ধরনের একটি বিশেষ ইউনিট গঠনের দাবি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের মুখেও বিভিন্ন সময় শোনা গেছে।
সাবেক ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) মিডিয়া বিভাগের উপ-কমিশনারের (ডিসি) মুনতাসিরুল ইসলাম বেনারকে বলেন, ‘দেশে জঙ্গিবাদের প্রত্যেকটি ঘটনা পুলিশ অত্যন্ত সফলতার তদন্ত করছে। এক্ষেত্রে পুলিশের সক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন করার কোন সুযোগ নেই। তবে জঙ্গিবাদ নির্মূলের ক্ষেত্রে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার প্রয়োজন রয়েছে। এবং সেই হিসেবে পুলিশ বাহিনীতে পৃথক জঙ্গিবাদ ইউনিট থাকলে ভাল হয়’।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানান, জঙ্গি দমনে সক্ষমতা, অভিজ্ঞতা বা প্রশিক্ষণ পুলিশের সেভাবে নেই বলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পক্ষ থেকে বারবার জানানো হয়। জঙ্গি মামলা তদন্তের সক্ষমতাও নেই। যেসব পুলিশ সদস্যরা হরতাল ডিউটি ও নাশকতা দমনে কাজ করেন, তারাই চোর-ডাকাত, ছিনতাইকারীদের ধরেন, আবার তাদেরকেই জঙ্গি দমনের কাজে লাগানো হচ্ছে।
পুলিশের একজন উর্ধ্বতন কর্মকর্তা বেনারকে বলেন, বদলি হওয়া পুলিশের চাকরির ধর্ম। কিন্তু এই বদলি’ই অনেক ক্ষতির কারণ হয়ে ওছে। যেমন, দীর্ঘদিন ধরে যে কর্মকর্তা জঙ্গি দমনে কাজ করে দক্ষ হয়ে ওঠে, তাকে বদলি করে অন্য সংস্থায় পাঠানো হয়। ফলে, জঙ্গি নিয়ে তার শিক্ষণ-প্রশিক্ষণ, অভিজ্ঞতা কোন কিছুই কাজে আসে না। এ কারণেই ‘কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্স ন্যাশনাল ক্রাইম’ ইউনিট গঠন খুব জরুরি হয়ে পড়েছে।
এ ইউনিট গঠনের বিষয়টি নিশ্চিত করে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল জানান, দেশে জঙ্গিবাদ যে পর্যায়ে রয়েছে, তা মোকাবিলার জন্য একটি বিশেষায়িত ইউনিট খুব প্রয়োজন ছিল। সরকার সে ইউনিট গঠন শুরু করেছে। তবে শুরুতেই ছোট আকারে করা হবে।
তিনি জানান, বিভিন্ন দেশে গিয়ে প্রশিক্ষণ নিয়ে আসা পুলিশ কর্মকর্তাদের এ ইউনিটে আনা হবে। তারা সাইবার ক্রাইম, সন্ত্রাস ও জঙ্গি দমনে কাজ করবেন। যেকোনো ঘটনা ঘটার আগেই পুলিশের কর্মকর্তারা যাতে সব খবর পেয়ে যান, সে লক্ষ্যেই এ ইউনিট তৈরি করা হবে। তবে এ ইউনিটটি ঢাকা মহানগর পুলিশের অধীনে হলেও সারা দেশের জন্য তারা কাজ করবে।
জাতিসংঘের তাগিদ
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও ডিএমপির কার্যালয় সূত্রমতে, বাংলাদেশে জঙ্গি সংগঠনের কার্যক্রম বিস্তৃত হওয়ায়, জঙ্গি দমনে বিশেষ বাহিনী ইউনিট গঠনে জাতিসংঘ থেকে তাগিদ এসেছিল। যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের আদলে এ ইউনিট গঠনের জন্য পুলিশ বিভাগকে বলা হচ্ছিল। পুলিশ কর্মকর্তারা জানান, বিদেশে পড়াশোনা ও প্রশিক্ষণে যাওয়া পুলিশের কর্মকর্তাদের অর্ধেকেই ‘কাউন্টার টেররিজম’ বা এ-সংশ্লিষ্ট বিষযয়ে পড়াশোনা করে থাকেন। সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ বিষয়ে অনেকে পিএইচডিও করেছেন। তবে প্ল্যাটফর্ম না থাকায় এসব অভিজ্ঞ কর্মকর্তাদের মাঠপর্যায়ে কাজে লাগানো যাচ্ছিল না। এবার সেই সুযোগ থাকবে।
তারা জানান, দেশের কয়েকটি গোয়েন্দা সংস্থার ‘জঙ্গি’ সেল থাকলেও বিশেষায়িত ইউনিট নেই। শুধু তথ্য দেওয়ার মধ্যেই সীমাবদ্ধ গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর কার্যক্রম। এছাড়া র্যাবের গোয়েন্দা শাখায় জঙ্গি দমনে অল্প কয়েকজনের একটি বিশেষায়িত সেল রয়েছে।
সময়োপযোগী পদক্ষেপ
দেশে একের পর এক হামলার ঘটনা ঘটছে। পুলিশের হিসেবে গত চার মাসে ধর্মীয় ভিন্নমতাবলম্বী ব্যক্তি, সংখ্যালঘু সম্প্রদায় ও প্রতিষ্ঠানের ওপর এ ধরনের ১৯টি হামলা হয়েছে। জঙ্গিরা এসব ঘটনা ঘটিয়েছে বলে পুলিশের ধারণা।
বিশ্লেষকরা বলছেন, জঙ্গিরা এখন তত্ত্ব ও বার্তা প্রচার, অর্থায়ন, নতুন সদস্য নিয়োগ, তাদের প্রশিক্ষণ সবই ইন্টারনেটের মাধ্যমে ঘটাচ্ছে। তাদের দমনে ইন্টারনেটে বিশেষ দৃষ্টি দিতে হবে। এক্ষেত্রে প্রস্তাবিত ‘কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্স ন্যাশনাল ক্রাইম’ ইউনিট সময়ের দাবি।
এ বিষয়ে পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) নূরুল হুদা বলেন, ‘জঙ্গি দমনে এ ধরনের ইউনিট গঠন করা সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত। এ ইউনিট জঙ্গির বিষয়টি সার্বক্ষণিক তদারক করতে পারবে। পৃথিবীর সব দেশেই এমন বিশেষ ইউনিট রয়েছে।’
এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধ বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক মাহফুজুল হক মারজান বেনারকে বলেন, অপরাধীরা অপরাধের ধরন পরিবর্তন করেছে। জঙ্গিরা এখন প্রযুক্তিতে অনেক দক্ষ। অথচ আমরা তাদের মোকাবেলা করছি ব্রিটিশ আমলের পুলিশ দিয়ে।
তিনি বলেন, সন্ত্রাসবাদ ঠেকানোর জন্য বিশেষ বাহিনী গঠন ছিল সময়ের দাবি। সময়ের সঙ্গে অপরাধের ধরন যেমন পরিবর্তন হচ্ছে, তেমনই যুগোপযোগী পরিবর্তন আনতে হবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীতেও। তাই জঙ্গি দমনে এ ধরনের ইউনিট গঠন নিঃসন্দেহে প্রসংশার দাবি রাখে। তবে ছোট পরিসরে এবং রাজধানী কেন্দ্রিক নয়, বৃহত্তর পরিসরে এ ইউনিটকে ছড়িয়ে দিতে হবে দেশের প্রতিটি অঞ্চলে।
এদিকে, একাধিক কর্মকর্তা বলেন, বিশেষায়িত এ ইউনিট কর্মকর্তাদের ঝুঁকির কথা ভেবে তাদের উপযুক্ত ভাতা ও প্রণোদনার ব্যবস্থা রাখার প্রয়োজন। এছাড়া এ ইউনিটের কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণ, মোটিভেশন, বিশেষ ভাতা, পর্যাপ্ত সোর্স মানির বিষয়টিও ভাবতে হবে।