ব্রিটিশ রাষ্ট্রদূত হত্যা প্রচেষ্টা মামলার রায়: তিন জঙ্গি নেতার মৃত্যুদণ্ড বহাল
2016.02.11

প্রায় এক যুগ আগে সাবেক ব্রিটিশ হাইকমিশনার আনোয়ার চৌধুরীর উপর গ্রেনেড হামলার ঘটনায় নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গি সংগঠন হরকাতুল জিহাদ আল ইসলামীর নেতা মুফতি আব্দুল হান্নানসহ তিন জঙ্গি নেতার মৃত্যুদণ্ড বহাল রেখেছে বাংলাদেশের হাইকোর্ট। পাশাপাশি আরও দুইজনের যাবজ্জীবন দণ্ডাদেশও বহাল রাখা হয়েছে।
উচ্চ আদালতের রায়ে রাষ্ট্রপক্ষ সন্তোষ প্রকাশ করলেও আসামিপক্ষ বলছে- এ রায়ের বিরুদ্ধেও তারা আপিল করবে। আর এ রায়ের মাধ্যমে জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে বাংলাদেশ তার কঠোর অবস্থানকে বিশ্বের কাছে জানান দিল বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।
নিম্ন আদালতের রায়ের পর ওই রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করেছিল উক্ত মামলার দণ্ডপ্রাপ্তরা। ওই আপিল ও ডেথ রেফারেন্সের শুনানি শেষে বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম ও বিচারপতি আমির হোসেনের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ বৃহস্পতিবার এই রায় শোনান।
গ্রেনেড নিক্ষেপ এর অভিযোগে এর আগে সিলেটের একটি আদালত মুফতি হান্নান, শরীফ শাহেদুল আলম ওরফে বিপুল ও দেলোয়ার হোসেন ওরফে রিপনকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছিল। এছাড়া মুফতি হান্নানের ভাই মহিবুল্লাহ ওরফে মফিজুর রহমান ওরফে মফিজ ওরফে অভি এবং মুফতি মঈন উদ্দিন ওরফে আবু জান্দালকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়।
ওই রায়ের আট বছর পর আসামিদের আপিল খারিজ করে দিয়েসেই রায়ই বহাল রাখল হাইকোর্ট। দণ্ডপ্রাপ্ত পাঁচ আসামিই বর্তমানে কারাগারে রয়েছেন।
আপিল করবে ‘অসন্তুষ্ট’ আসামিপক্ষ
আদালতে আসামিপক্ষের শুনানিতে অংশ নেন আইনজীবী এ কে এম ফয়েজ, মোহাম্মদ আলী ও রাষ্ট্রনিযুক্ত আইনজীবী হাসনা বেগম। বৃহস্পতিবার হাই কোর্টের রায়ের পর মুফতি হান্নানসহ চার আসামির আইনজীবী মোহাম্মদ আলী বলেন, “আমরা এ রায়ে সন্তুষ্ট নই। আসামিরা সুবিচার বঞ্চিত হয়েছেন। রায়ের অনুলিপি পেলে সর্বোচ্চ আদালতে আপিল করব।”
সন্তুষ্ট রাষ্ট্রপক্ষ
আদালতের রায়ে আসামিপক্ষ সন্তুষ্ট না হলেও সন্তোষ প্রকাশ করেছেন সরকারপক্ষের আইনজীবীরা। এ মামলার রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম ও ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল শেখ এ কে এম মনিরুজ্জামান কবীর।
তিনি বলেন, বিচারিক আদালতের রায়ই বহাল রেখেছেন হাইকোর্ট। আসামিপক্ষ আপিল করেও শেষরক্ষা করতে পারেনি। এ রায়ের মাধ্যমে জঙ্গিবাদের পরাজয় ঘটলো।
পেছনের ঘটনা
এই মামলার বিবরণ থেকে জানা যায়, ২০০৪ সালের ২১ মে সিলেটে হযরত শাহজালালের (র.) মাজার প্রাঙ্গণে ব্রিটিশ হাই কমিশনার আনোয়ার চৌধুরী গ্রেনেড হামলার শিকার হন। ওই হামলায় ঘটনাস্থলে পুলিশের সহকারী উপপরিদর্শক কামাল উদ্দিন নিহত হন। পরে হাসপাতালে মারা যান পুলিশ কনস্টেবল রুবেল আহমেদ ও হাবিল মিয়া নামের আরেক ব্যক্তি।
এছাড়া হাইকমিশনার আনোয়ার চৌধুরী ও সিলেটের জেলা প্রশাসকসহ প্রায় ৪০ জন ব্যক্তি ওই হামলার ঘটনায় আহত হন।
ঘটনার দিনই সিলেট কোতোয়ালি থানায় অজ্ঞাতপরিচয় আসামিদের বিরুদ্ধে মামলা করে পুলিশ। তদন্ত শেষে ২০০৭ সালের ৭ জুন অভিযোগপত্র জমা দেওয়া হয়। এতে নিষিদ্ধঘোষিত সংগঠন হরকাতুল জিহাদ নেতা মুফতি আবদুল হান্নান ওরফে আবুল কালাম, হান্নানের ভাই মহিবুল্লাহ ওরফে মফিজুর রহমান ওরফে মফিজ ওরফে অভি, শরীফ শাহেদুল আলম ওরফে বিপুল ও দেলোয়ার হোসেন ওরফে রিপনকে আসামি করা হয়।
পরে সঠিক ঠিকানা না থাকায় মুফতি মঈন উদ্দিন ওরফে আবু জান্দাল ওরফে মাসুম বিল্লাহ ওরফে খাজার নাম অভিযোগ পত্র থেকে বাদ দেওয়া হয়। তবে পরে তাকে যুক্ত করে পুলিশ সম্পূরক অভিযোগপত্র দেয়। ওই বছর নভেম্বরে তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করে আদালত।
এরপর ২০০৮ সালের ২৩ ডিসেম্বর সিলেটের দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল মুফতি হান্নান, শরীফ শাহেদুল আলম ও দেলোয়ার হোসেনকে মৃত্যুদণ্ডাদেশ দেন। অন্য দুই আসামি মহিবুল্লাহ ও মুফতি মঈন উদ্দিনকেও যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেন। ওই মামলায় ৫৬ জনের সাক্ষ্যগ্রহণ করেন আদালত।
ওই রায়ের পর ২০০৮ সালে আসামিদের ডেথ রেফারেন্স (মুত্যুদণ্ড অনুমোদনের আবেদন) শুনানির জন্য হাই কোর্টে আসে। এছাড়া ২০০৯ সালে উচ্চ আদালতে আপিল করেন আসামিরা।
এরপর চলতি বছরের ৬ জানুয়ারি হাই কোর্টে এই মামলার শুনানি শুরু হয়। নয় দিন শুনানির পর গত ৩ ফেব্রুয়ারি রায়ের দিন ঘোষণা করে দেয় আদালত।
বিশ্বের কাছে উদাহরণ
আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষকরা বলছেন, এ রায় জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের কঠোর অবস্থানকে বিশ্বের কাছে তুলে ধরবে। তবে মামলার দীর্ঘসূত্রিতা নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন তারা।
এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ড. দেলোয়ার হোসেন বেনারকে বলেন, ‘সাবেক ব্রিটিশ হাইকমিশনারকে হত্যা চেষ্টার মামলার এই বিচারের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ বিশ্বের কাছে একটি উদাহরণ সৃষ্টি করল। জঙ্গিবাদসহ বিভিন্ন অপরাধ দমনে বাংলাদেশের উপর বিশ্বের আস্থা বাড়াবে এ রায়। এছাড়া উচ্চ আদালতের এ রায় দেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় সাহায্য করবে। সবচেয়ে বড় কথা বিচারহীনতার সংস্কৃতি থেকে বেরুতে এ রায় অন্যতম উদাহরণ হবে।’
তিনি বলেন, ‘জঙ্গিবাদ বা এ ধরনের ঘটনার বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা বা বিচারের সংস্কৃতি অত্যন্ত গুরুত্বপর্ণ। বিশেষ করে বাংলাদেশে বিচারহীনতার বিষয় আছে বলে অভিযোগ রয়েছে। সেখান থেকে বেরিয়ে আসতে এ ধরনের ঘটনার বিচার আরো কম সময়ে হওয়া অত্যন্ত জরুরি। যাতে কেউ প্রশ্ন তুলতে না পারে।’
সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে লড়তে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া গুরুত্বপূর্ণ
সাবেক হাইকমিশনার আনোয়ার চৌধুরীর উপর হামলার পর দিন ও বছর গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে জঙ্গিদের উৎপাতও বেড়েছে বাংলাদেশে। সম্প্রতি এ জঙ্গিবাদ আরো বাড়তে পারে বলে আশঙ্কাও প্রকাশ করেছেন মার্কিন গোয়েন্দা প্রধান। তবে গত কয়েকবছর ধরে জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে বাংলাদেশ যেভাবে লড়াই করে আসছে তাও বিশ্বে বারবার প্রশংসা পেয়েছে। বৃহস্পতিবার ঢাকায় নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূতও সেকথা পূনর্ব্যক্ত করেছেন। একইসঙ্গে সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে লড়তে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার প্রয়োজনীয়তার কথাও বলেছেন তিনি।
এক অনুষ্ঠানে ঢাকায় নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত মার্শা স্টিফেনস ব্লুম বার্নিকাট বলেন, গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে অন্যতম প্রধান হাতিয়ার। যদি বিরোধীদের শান্তিপূর্ণ রাজনৈতিক ব্যক্তিমত প্রকাশের স্বাধীনতা না থাকে তাহলে সন্ত্রাসীদের ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়।
এছাড়াও জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার 'জিরো টলারেন্সের' নীতির প্রসংশা করেন তিনি।
তবে প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে দমনের অভিযোগ এনে এদেশে আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলোর তৎপরতা বিস্তৃত হতে পারে বলে মার্কিন গোয়েন্দা প্রধানের বক্তব্য ধরেই তিনি বলেন, যখন বিরোধীপক্ষ দমনের শিকার হয়, তখন কট্টরপন্থি গোষ্ঠীর উন্মেষ ঘটে।
মার্কিন রাষ্ট্রদূত বলেন, যে গোষ্ঠী বাংলাদেশকে টার্গেট করছে, তারা যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপ এবং অন্যান্য বিশ্বের দেশকেও টার্গেট করছে। বাংলাদেশের গণতন্ত্র, এর সহনশীলতা এবং শান্তিপূর্ণভাবে ধর্ম পালনের যে ঐতিহ্য তা সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে একটা শক্ত রক্ষাকবচ।
তিনি বলেন, সম্প্রতি বাংলাদেশের যেসব শান্তিপূর্ণ গণতান্ত্রিক অভিব্যক্তির প্রকাশ দেখা গেছে তা প্রশংসনীয়। সুশীল সমাজ ও সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোকে নিয়ে গঠনমূলক রাজনৈতিক সংলাপ সহিংসতা ও অস্থিতিশীলতা মোকাবেলায় ভুমিকা রাখতে পারে।
তবে জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাসবাদ দমনে বাংলাদেশের সঙ্গে কাজ করে যাওয়ার ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রের অঙ্গীকার পুর্নব্যক্ত করেন মার্কিন রাষ্ট্রদূত।