ঢাকায় ৫০ লাখ পথচারির জন্য গণশৌচাগার মাত্র ৪৭টি

ঢাকা থেকে জেসমিন পাপড়ি
2015.09.30
BD-toilet ঢাকায় যে কয়টি পাবলিক টয়লেট চালু আছে সেগুলোও অপরিচ্ছন্ন ও অবহেলায় মানুষের ব্যবহার অযোগ্য হয়ে পড়ে আছে। সেপ্টেম্বর,২০১৫
বেনার নিউজ

রাজধানী ঢাকা, যেখানে বাস করে প্রায় পৌনে দুই কোটি মানুষ। এদের মধ্যে ৫০ লাখেরও বেশি পথচারি প্রতিদিন শহরে চলাচল করে। বিরাট এই সংখ্যার বিপরীতে শহরে গণশৌচাগার বা পাবলিক টয়লেট মাত্র ৪৭টি। যা শুধু অপ্রতুলই নয় ‘নাম কা ওয়াস্তে’ বলে অভিযোগ সাধারণ মানুষের।  

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ঢাকা শহরে রাস্তায় বের হলে ২০ মিনিটের রাস্তা যেতে ২ ঘণ্টার বেশি সময় পেরিয়ে যায়। এর মধ্যে কারো প্রস্রাব বা টয়লেট চাপলে বিপত্তির শেষ নেই। পাবলিক টয়লেটের দেখা মেলা ভার, আর দু-একটি পাওয়া গেলেও অপরিচ্ছন্ন পরিবেশে সেখানে যাওয়ার উপায় নেই। মহিলাদের জন্য তো নয়-ই। ফলে একটি উল্লেখ্যযোগ্য সংখ্যক লোক যত্রতত্র স্থানে টয়লেট করে থাকে। যে কারণে মল-মূত্রের গন্ধে ফুটপাতে হাঁটাও অস্বস্তিকর।

বেসরকারি সংস্থার ওয়াটার এইডের তথ্য অনুযায়ী, ঢাকা শহরে প্রতিদিন রাস্তায় চলাচল করা গড়ে এক লাখ মানুষের ব্যবহারের জন্য একটি করে পাবলিক টয়লেটও নেই।


দুর্গন্ধ আর নোংরা পরিবেশই বৈশিষ্ট্য

রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা যায়, শহরে যে কয়েকটি পাবলিক টয়লেট টিকে আছে সেগুলোর বেশিরভাগই ব্যবহারের অযোগ্য। এর কোনটির দরজা নেই, দরজা আছে তো ছিটকিনি নেই, পর্যাপ্ত আলো-বাতাস নেই, বিদ্যুৎ নেই, অপরিস্কার, ময়লা, দুর্গন্ধ, ভাঙা কমোড, ছাদ চুঁইয়ে পানি পড়ে, ইদুর-তেলাপোকার বসবাস, ময়লা পানি জমে থাকে, নেই পর্যাপ্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থা।

“গত কয়েকমাস আগে বাধ্য হয়ে কারওয়ান বাজারের পাবলিক টয়লেটে গিয়েছিলাম। কিন্তু সেখানকার সেই উৎকট গন্ধ এখনো আমাকে তাড়িয়ে বেড়ায়। ‘পাবলিক টয়লেট’ শব্দটাই এখন আমার কাছে ভীতিকর হয়ে উঠেছে। যেন আর কখনো সেখানে আমি যেতে বাধ্য না হই।” বেনারকে বলেন শহরের চাকুরিজীবী নারী তানিয়া আফরিন।  

জানা যায়, রাজধানীর জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেক নারী হলেও এখানকার পাবলিক টয়লেটগুলোর প্রায় ৭৫ শতাংশেই নারীদের জন্য কোনো আলাদা ব্যবস্থা নেই। ফলে তুলনামূলকভাবে কম  ‘টয়লেট’ ব্যবহার করায় নানা স্বাস্থ্যগত সমস্যায় ভুগছে কর্মজীবী ও পেশাজীবী নারীরা। দেশের মোট জনসংখ্যা ১০ শতাংশ প্রতিবন্ধী হলেও পাবলিক টয়লেটগুলোতে তাদের জন্য উপযুক্ত ব্যবস্থা নেই।


‘ফুটপাতগুলোই টয়লেট!’

পাবলিক টয়লেটের সুব্যবস্থা না থাকায় পথচারি, হকার, রিকশা চালক, ভিক্ষুক ও ভাসমান মানুষ বাধ্য হয়েই তারা ফুটপাতের পাশে, পার্কে, লেকে, সড়কের পাশে বিভিন্ন উন্মুক্ত জায়গায় মল-মূত্র ত্যাগ করছে। এতে  পরিবেশ দূষণ হচ্ছে ও জনস্বাস্থ্য ক্ষতির সম্মূখীন হচ্ছে।

রাজধানীর কারওয়ান বাজারের একটি বেসরকারী টেলিভিশনের প্রতিবেদক আতিকুর রহমান বলেন, “বাস থেকে নেমে প্রধান সড়কের পাশ দিয়ে ২/৩ মিনিটে হেঁটে অফিসে ঢুকতে হয়। এখানকার ছোট্ট একটু ফুটপাত যেন একটি খোলা টয়লেট। এখান দিয়ে হাঁটতে গেলেই বমি বেরিয়ে আসে!”


সঠিক সংখ্যা জানেনা সিটি কর্পোরেশন

শহরের পাবলিক টয়লেটের সঠিক সংখ্যা জানেনা ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন। এসব কার্যালয়ে খোঁজ নিতে গিয়ে কোনো সঠিক তথ্য পাওয়া যায়নি।

তবে ওয়াটার এইডের একটি সমীক্ষায় বলা হয়েছে, সিটি করপোরেশন নির্মিত মোট ৬৯টি পাবলিক টয়লেটের মধ্যে দুটি ভেঙে ফেলা হয়েছে, বন্ধ হয়ে গেছে ১০টি। সেবা নেই বাকি ১০টিতে। আর এখন টিকে আছে ৪৭টি। সেগুলোর মধ্যে মাত্র পাঁচটি মোটামুটি ব্যবহার উপযোগী।

এ বিষয় ২০১১ সালে একটি গবেষণা পরিচালনা করে সেন্টার ফর আরবান স্টাডিজ ও ওয়াটার এইড। যার ফলাফলে বলা হয়েছে, প্রায় ৮০০ বর্গ কিলোমিটারের ঢাকা শহরে প্রায় এক কোটি ৬০ লাখের বেশি মানুষের মধ্যে পাঁচ লাখ ভাসমান, ১০ লাখ রিকশাচালক, আরো ১০ লাখ অন্যান্য জীবিকার মানুষ, ২০ লাখ নিয়মিত পথচারী এবং ঢাকার বাইরে থেকে আসা ১০ লাখসহ মোট ৫৫ লাখ মানুষের প্রতিদিন চলাচলের সময় টয়লেট ব্যবহারের প্রয়োজন পড়ে।


টয়লেটের পানি বিক্রী করেন ইজারাদার

জানা যায়, দুই সিটি কর্পোরেশন পাবলিক টয়লেটগুলো বেসরকারি পর্যায়ে ইজারা দিয়ে রেখেছে। সেগুলো ব্যবহার করতে ৫-১০ টাকা খরচ করতে হয়। যা দরিদ্রদের জন্য কষ্টসাধ্য। আবার নজদরদারি না থাকায় ইজারাদাররা বেশি টাকা আয়ের জন্য পাবলিক টয়লেটের পানি বিক্রি করে থাকেন। গাড়ি ধোঁয়ার কাজে, কিংবা টোকাই কিংবা ছিন্নমূল মানুষদের কাছে এই পানি বিক্রি করেন তারা। এমনকি টয়লেটগুলো মাদক ব্যবসায়ীদের লেনদেনেরও স্থান হয়ে উঠেছে।

রাজধানীর ব্যস্ততম এলাকা ফার্মগেটের একটি পাবলিক টয়লেট ঘুরে দেখা যায়, ভেতরের মেঝে তুলনামূলক পরিস্কার হলেও কমোডগুলো ভাঙা আর নোংরা। এলাকাজুড়েই মলমূত্রের উৎকট দুর্গন্ধ। প্রায় অন্ধকার পরিবেশ। তবে সেখানকার পানির লাইন থেকে পাইপযোগে বাইরে ড্রামে পানি সংগ্রহ করতে দেখা যায় কয়েকজনকে।

অথচ সেখানকার টোল আদায়কারী মো. হারুণ বেনারকে জানান “পানির অভাবে পরিচ্ছন্ন রাখা কঠিন। তারপরেও এই পরিবেশেই দিনে গড়ে দেড়শ থেকে পৌনে দুইশ মানুষ এখানে আসেন। তবে নারীরা আসেন না বললেই চলে।”


ভিন্ন চিত্র

সিটি করপোরেশনের পাবলিক টয়লেটগুলোর যখন এই বেহাল দশা তখন ভিন্ন চিত্র দেখা যায় ওয়াটার এইডের ব্যবস্থাপনায় চলা গাবতলীর পাবলিক টয়লেটটিতে। আলো-ঝলমলে পরিচ্ছন্ন পরিবেশ, হাত-মুখ ধোঁয়া ও গোসলের ব্যবস্থা, সাবান, টয়লেট পেপার, সুপেয় ও বিশুদ্ধ পানির আলাদা ব্যবস্থা, নারী ও প্রতিবন্ধীদের ব্যবহার উপযোগী টয়লেট, সার্বক্ষণিক পরিচ্ছন্নতাকর্মী, স্বচ্ছ আয়না, নিরাপত্তার জন্য মূল প্রবেশ দ্বারে ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরা, ব্যাগ কিংবা মূল্যবান জিনিসপত্র সাময়িকভাবে রাখার জন্য লকার, কি নেই সেখানে! প্রায় এক বছর ধরে পাবলিক টয়লেটটি ২৪ ঘণ্টব্যাপী সেবা দিয়ে যাচ্ছে।


দেখা দিচ্ছে শারীরিক সমস্যা

সময়মত প্রাকৃতিক প্রয়োজন সারতে না পেরে পা ফুলে যাওয়াসহ শরীরে নানা সমস্যা দেখা দেওয়ার কথা জানান বনানী এলাকার পথচারি টুম্বপা হালদার। চিকিৎসকরাও বলছেন, পরিমানের চেয়ে কম ‘টয়লেট ব্যবহার’ মানবদেহে নানা ধরনের প্রতিক্রিয়া ফেলতে পারে।

জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ আফসানা আলমগীর খান বেনারকে বলেন, “কোন মানুষ যদি দীর্ঘক্ষণব্যাপী প্রাকৃতিক প্রয়োজন চেপে রাখে তাহলে তার শরীরে স্থায়ী বা অস্থায়ী নানা ধরনের রোগ জন্ম নেয়। কিডনি প্রদাহ, পিত্তথলীতে পাথর, মূত্রথলী প্রদাহ, গ্যাসট্রিকসহ নানা ধরনের রোগের আক্রমনের শিকার হয়।”

তবে শহরে পাবলিক টয়লেট না বাড়ার পেছনে নগরবিদরা পরিকল্পনার অভাবকেই দায়ী করছেন। স্থপতি ও নগর পরিকল্পনাবিদ ইকবাল হাবিব বেনারকে বলেন, “রাজধানী ঢাকার জনসংখ্যা বাড়লেও সে অনুপাতে পাবলিক টয়লেট বাড়েনি। সঠিক নগর পরিকল্পনার অভাবেই এই হাল। অন্ততঃ প্রতি এক কিলোমিটার পর পর একটি করে টয়লেট থাকা প্রয়োজন। যাতে করে একজন পথচারি বা ডায়াবেটিক রোগী চলতে গিয়ে টয়লেট সমস্যায় না পড়েন। মোড়ে মোড়ে মোবাইল টয়লেটের ব্যবস্থাও রাখা যেতে পারে।”


সিটি কর্পোরেশনের উদ্যোগ

তবে সিটি কর্পোরেশনের পক্ষ থেকে শহরে টয়লেটের সংখ্যা বাড়াতে ব্যাপক উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে বলে জানিয়েছেন কর্মকর্তারা।  

ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের নির্বাহী কর্মকর্তা বি এম এনামুল হক বলেন, আগামী এক বছরের মধ্যে বেসরকারী সংস্থা ওয়াটার এইডের সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে সিটি কর্পোরেশন উত্তর ঢাকায় ৫০টি এবং দক্ষিণ ঢাকায় ৩৪টি পাবলিক টয়লেট তৈরি করবে। নির্মাণের পর পরবর্তি তিন বছর সেগুলোর সাজসজ্জা, মেরামত ও রক্ষনাবেক্ষণ করবে ওয়াটার এইডই।

এছাড়া শহরে পাবলিক টয়লেটের সমস্যা দূর করতে প্রতিটি পেট্রোল পাম্পে পাবলিক টয়লেট বসানোর ঘোষণা দিয়েছেন ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের নতুন মেয়র সাঈদ খোকন।

রাজধানীর বিভিন্ন ধর্মীয় স্থান, শপিং মলের নিচতলাসহ যেখানে জনসমাগম বেশি হয় সেসব স্থানের টয়লেটগুলোতে জনসাধারণের প্রবেশাধিকার দেওয়ার ব্যাপারেও সিটি কর্পোরেশন নির্দেশনা দেওয়ার কথা ভাবছে বলে জানিয়েছেন উত্তর সিটি কর্পোরেশনের কর্মকর্তা এনামুল হক।

তিনি বলেন, এই উদ্যোগুলো সমন্বিত হলে শীঘ্রই শহরের টয়লেট সমস্যা দূর হবে। এতে করে খোলা স্থানে মলমূত্র ত্যাগের পরিমান কমে আসবে। এবং পরিবেশও দূষণ থেকে রক্ষা পাবে।  

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।