কঠোরতায় মানবপাচার বন্ধ বাংলাদেশে

ঢাকা থেকে জেসমিন পাপড়ি
2016.02.01
BD-trafficking গত বছর সমুদ্রে ভাসমান অবস্থায় আটক বাংলাদেশিদের মায়ানমার ফেরত পাঠায় দেশে।
বেনার নিউজ

বঙ্গোপসাগরে অবৈধ অভিবাসী সমস্যা মোকাবিলায় কঠোর অবস্থান নিয়েছে বাংলাদেশ। উপকূলীয় অঞ্চলগুলোতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতায় বন্ধ হয়েছে মানবপাচার। আর এ বিষয়ে সরকারের কর্মতৎপরতা প্রসংশা কুড়িয়েছে দেশে বিদেশে।

সম্প্রতি বাংলাদেশের ঝূঁকিপূর্ণ এলাকাগুলো থেকে মানবপাচারের তেমন কোন ঘটনা যেমন ঘটেনি তেমনই গন্তব্য দেশ মালয়েশিয়া বা থাইল্যান্ডের উপকূলেও মেলেনি কোন বাংলাদেশির সন্ধান।

সরকার বলছে, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অব্যাহত তৎপরতা আর জনসচেতনতার কারণেই মানবপাচার শূণ্যের কোঠায় নামিয়ে আনা সম্ভব হয়েছে। পাচারকারীদের বিরুদ্ধে অভিযান অব্যহত রাখার পাশাপাশি বৈধ পথে অভিবাসনের সুযোগ বাড়ানো হচ্ছে বলেও দাবি করছে সরকার।

এদিকে গত ডিসেম্বরে অভিবাসন সমস্যা নিয়ে থাইল্যান্ডের রাজধানী ব্যাংককে অনুষ্ঠিত হওয়া দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর প্রতিনিধি সম্মেলনে বাংলাদেশে মানবপাচার শূণ্যের কোঠায় নামিয়ে আনার তথ্য তুলে ধরা হলে, বাংলাদেশ বিশেষভাবে প্রসংশিত হয়, জানিয়েছে কূটনৈতিক সূত্র।

প্রসঙ্গত গত বছরের মাঝামাঝিতে মানবপাচারকারীদের বিরুদ্ধে ব্যাপক অভিযান চালায় থাইল্যান্ড।  বাংলাদেশ ও মায়ানমারের হাজার হাজার অভিবাসী ওই পাচারকারী চক্রের কবলে পড়ে থাই, ইন্দোনেশীয় ও মালয়েশিয়ার উপকূলে ভাসতে থাকে। তাদেরকে উদ্ধার করা হলেও ততদিনে অপহরণ ও নির্যাতনের শিকার হয়ে মৃত্যুবরণ করেন অনেকে। ওই  অভিযানে  মালয়েশিয়া সীমান্তের কাছাকাছি গহীন বনের বিভিন্ন বন্দিশিবির থেকে বেশ কয়েকটি কঙ্কাল উদ্ধার করে থাই বাহিনী।

ওই ঘটনা বাংলাদেশ ও মায়ানমার থেকে ভারত মহাসাগরের নৌপথে মানব পাচারের ভয়াবহ চিত্র ফুটিয়ে তোলে।

জানা যায়, কিছুদিন আগেও কক্সবাজার থেকে নৌকায় করে হাজার হাজার বাংলাদেশি নিয়ে মালয়েশিয়া বা থাইল্যান্ডে পৌঁছে দেয়ার উদ্দেশ্যে রওনা হত দালালদের নৌকা। সামান্য টাকায় বিদেশ যাওয়ার লোভে হতদরিদ্র মানুষ জীবন হাতের মুঠোয় নিয়ে সাগর পথে রওনা হত। কিন্তু কিছুদূর যাওয়ার পরেই শুরু হত নির্মম অত্যাচার। দাবি করা হত মোটা অংকের অর্থের। সেই টাকার দাবি মেটাতে না পেরে প্রাণ দিয়েছেন অনেকেই। বিভিন্ন দেশের উপকূলে আটক হওয়া বাংলাদেশিদের ফেরতও এ্নেছে বাংলাদেশ।

তবে সেই চিত্র বদলেছে। ধরা পড়েছে মানবপাচারের সঙ্গে জড়িত অনেকেই, যদিও রাঘব বোয়ালরা ধরাছোঁয়ার বাইরে রয়ে গেছে বলেও অভিযোগ রয়েছে।  

তবে পুলিশ বলছে, পাচারকারদের বিরুদ্ধে অভিযান চলছে। জানা যায়, সর্বশেষ কক্সবাজারের টেকনাফ থেকে চিহ্নিত দুই মানবপাচারকারীকে আটক করেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। এরা হলেন, শাহপরীর দ্বীপ এলাকার মৃত ইমাম হোসেনের পুত্র এনাম উল্লাহ (৪০) ও একই এলাকার মৃত হাজী আজিজুর রহমানের পুত্র আব্দুস শুক্কুর (৩৫)।

টেকনাফ থানার ওসি আতাউর রহমান খোন্দকার বেনারকে বলেন, গোপন সংবাদের ভিত্তিতে অভিযান চালিয়ে চিহ্নিত দুই মানবপাচারকারীকে আটক করা হয়ছে। তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থাও নেওয়া হয়েছে।

এ বিষয়ে কক্সবাজারের পুলিশ সুপার শ্যামল কান্তি নাগ বেনারকে বলেন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতায় শূণ্যের কোঠায় নেমেছে সাগর পথের মানব পাচার। ঝূঁকিপূর্ণ এলাকাগুলোকে সবসময় নজরদারিতে রাখা, অব্যাহতভাবে অভিযান চালানো এবং চিহ্নিত অপরাধীদের আটক করে বিচারের মুখোমুখি করায় তা সম্ভব হয়েছে।

এছাড়া জনসচেতনতাও অন্যতম কারণ বলে মন্তব্য করে তিনি বলেন, ‘মিডিয়ার মাধ্যমে সাগর পথের ভয়াবহতা সম্পর্কে জানতে পেরেছে মানুষ। যার ফলে তারা এ পথে বিদেশ যেতে আর রাজি নয়।’

এছাড়া বৈধ অভিবাসনের সুযোগ বাড়ায় অবৈধ অভিবাসনের পথ বন্ধ হচ্ছে বলে মনে করে সরকার।

এ বিষয়ে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রী নুরুল ইসলাম বিএসসি বেনারকে বলেনন, ‘কিছুদিন আগেও সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, মালয়েশিয়ার মত বড় বড় শ্রম বাজারে গৃহশ্রমিক ছাড়া অন্য বাংলাদেশি কর্মীদের জন্য বন্ধ ছিল। ফলে হতাশ হয়ে পড়ছিল বিদেশ গমনেচ্ছুকরা। তবে এখন পরিস্থিতি কিছুটা হলেও উন্নতি হয়েছে। সৌদি আরবের বাজারে নারী শ্রমিকদের পাশাপাশি পুরুষ শ্রমিকরাও যাওয়ার সুযোগ পাবে। তাও বিনা খরচে’।

তিনি আরো বলেন, মালয়েশিয়ার সঙ্গেও জিটুজি প্লাস চুক্তি স্বাক্ষর হওয়া চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে। শীঘ্রই তা চূড়ান্ত হবে। আশা করি এসব বড় বাজারগুলোতে অধিক সংখ্যক বাংলাদেশি কর্মী প্রবেশাধিকার পাবে। যা অবৈধ অভিবাসন কমাবে বলে আমি মনে করি।

জানা যায়, ব্যাংককে আঞ্চলিক ওই সম্মেলনে জানানো হয়, অবৈধ অভিবাসন বন্ধে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীগুলোকে তৎপরতা বাড়ানোর নির্দেশ দেয় বাংলাদেশ সরকার। পাশাপাশি সচেতনামূলক কার্যক্রমও চলমান। যার প্রেক্ষিতে নৌকায় করে সাগড় পাড়ি দেওয়া সংখ্যা প্রায় ‘শূণ্যের কোঠায়’ নেমে এসেছে। যার প্রমাণ মে মাসের পর থেকে থাই উপকূলে আর কোন বাংলাদেশি ধরা পড়েনি।

এ বিষয়ে থাইল্যান্ডে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত সাইদা মুনা তাসনিম বাংলানিউজকে বলেন, “শুরু থেকেই  অবৈধ অভিবাসনের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্সের ঘোষণা দেয় বাংলাদেশ সরকার। সেই ধারাবাহিকতায় যথাপোযুক্ত উদ্যোগে বন্ধ হয়েছে মানব পাচার”।

এ বিষয়ে আঞ্চলিক সহযোগিতার বাড়ানোর উদ্দেশ্যে ব্যাংককে ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহে সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর অংশগ্রহনে অনুষ্ঠিত বৈঠকে বাংলাদেশ সরকারের নেওয়া পদক্ষেপগুলো সম্পর্কে জানানো হয়। সংশ্লিষ্ট দেশগুলোও জানায় নতুন করে পাচারের শিকার হওয়া কোন বাংলাদেশি নাগরিককে কোন দেশের উপকূলে পাওয়া যায়নি। তারা সরকারের কঠোরতার প্রসংশা করেন।

তবে মানবপাচার প্রতিরোধে সরকারের দায়িত্ব-কর্তব্যের পাশাপাশি  জনসচেতনতা বাড়ানোর বিষয়টিও ওই বৈঠকে বিশেষভাবে গুরুত্ব পায় বলে জানান মুনা তাসনিম।

বর্ষা মৌসুম শেষে শীতের সময়টিতে ভারত মহাসাগরে মানব পাচারকারীদের তৎপরতা বাড়ার আশঙ্কা থাকলেও সেটি শক্তহাতে দমন করতে সক্ষমত হয়েছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, উন্নত জীবনের আশায় বাংলাদেশের কিছু দরিদ্র মানুষ অবৈধ পথে মালয়েশিয়াসহ বিভিন্ন দেশে যাওয়ার চেষ্টা করে।  তবে অবৈধ পথে বিদেশ যাওয়াদের বিরাট অংশ মায়ানমারের রাখাইন রাজ্যে নিপীড়িত রোহিঙ্গা মুসলিমরা। তারা সরকারের বাহিনী দ্বারা অত্যাচারিত হয়ে বিভিন্ন দেশে আশ্রয় নেওয়ার চেষ্টা করে।

তবে সে অভিযোগ স্বীকার করেনি মায়ানমার। তাই এসব দেশের উপকূলে আটক হওয়া রোহিঙ্গাদেরও ফেরত নেয়নি তারা।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।