আরব দেশে মানবপাচারের শিকার বাংলাদেশিদের অবর্ননীয় কাহিনী!
2015.04.03

অর্থের বিনিময়ে মধ্যপ্রাচ্যে আরব দেশে একটি কাজের আশায় পাচারকারীদের হাতে পড়ে হতভাগ্য মোহাম্মদ ইলিয়াস (২৫) ইরানের বন্দর আব্বাসে অমানবিক দিক কাটায়। সংযুক্ত আরব আমিরাতে দিনে ১৪ ডলারে নির্মাণ শ্রমিকের কাজে নিয়োগের আশায় সে স্থানীয় দালালের হাতে আড়াই লাখ টাকা (৩,২১৫ ডলার) তুলে দেয়।
সংযুক্ত আরব আমিরাতের কিছু দালাল তাকে সহ কয়েকজনকে ওমান হয়ে বন্দর আব্বাসে পাঠিয়ে দেয়। প্রথম পাচারকারী এক পাকিস্তানী তাদেরকে আমিরাত থেকে ওমান পৌছে দেয়।সারা রাত স্পীড বোটে সাগর পারি দিয়ে বন্দর আব্বাসে পৌছায়।
ইলিয়াস বেনার নিউজকে বলেন, “আমাদেরকে জোর করে ২৬ ঘন্টা হাটিয়ে নিয়ে বিচ্ছিন্ন একটি বাড়িতে রাখে।সেই বাড়ির আশে পাশে মানুষের মাথার খুলি ও কংকাল দেখতে পাই আমরা। এটা ছিলো এক লোমহর্ষক ঘটনা”।
“ আমি একজন দালালকে জিজ্ঞাশা করি, এই মাথার খুলিগুলো কাদের, সে জবাব দেয়, এগুলো বাংলাদেশিদের যারা আমাদের কথা শুনে নাই, তাদের এই পরিনতি হয়েছে”। ইলিয়াস শুনতে পায়, একজন বাংলাদেশির কাছে দেশে তার পরিবারের ফোন নাম্বার চাওয়া হচ্ছে। সে তা দিতে অস্বীকার করায়, তাকে বলা হলো, “আজকে তোমার নাম্বার মনে নেই, কাল ঠিকই মনে হবে”।
তাদেরকে খাবার দেয়া হয় সেই রাতে। তবে সেই খাবার ছিল নির্যাতনের জন্য। পরদিন তাদের মুক্তির জন্য প্রত্যেকের কাছে ৫ লাখ করে টাকা চাওয়া হয়। তারা লাঠি দিয়ে মারতে শুরু করে।একটা পর্যায়ে ইলিয়াস তার কাঠমিস্ত্রি পিতা মোহাম্মদ মোদাসসেরের ফোন নাম্বার দিয়ে দেয়।“তারা গরম লোহার রড আমার গায়ে চেপে ধরে আমার বাবাকে ফোন দেয়। আমার কান্নাকাটির আওয়াজ শুনে আমার পিতা আড়াই লাখ টাকা (৩,২১৫ ডলার) বাংলাদেশে তাদের একজন এজেন্টের একটা মোবাইল মানি ট্রান্সফার একাউন্টে জমা দেয়”।
তাদের হাতে টাকা পাওয়া নিশ্চিত হলে, তারা তাকে সহ বাকি ৮ জনকে আরেকজন পাচারকারীর হাতে তুলে দেয়।সে বন্দর আব্বাসের আরেকটা ক্যাম্পে নিয়ে গিয়ে প্রত্যেকের কাছে ১০ লাখ টাকা করে দাবি করে।
“আটককারী এই পাকিস্তানি ইলেক্ট্রিক বাকেটে প্রস্রাব করতে বাধ্য করে। কোনো খাবার না দিয়ে দিনভর অত্যাচার চালায়। কোনো এক রাতে আমি সহ বাকি ৮ জন মিলে এয়ার কন্ডিশনার বাক্সটা খুলে ফেলি এবং বাইরে লাফিয়ে পড়ি। ইরানিয়ান পুলিশ আমাদের ৯ জনকে ধরে আটক করে। ৩ মাস আটক থাকার পর আমরা ২০১২ সালের অক্টোবর মাসে ছাড়া পাই”।
এই ঘটনার পরিনতিতে আমার পরিবার নিঃস্ব অবস্থায় ঢাকায় আশ্রয় নেয়, কারন মেহেন্দিগঞ্জে যাদের কাছে টাকা ধার করেছিলেন আমার পিতা তারা আমাদের ভিটা-মাটি থেকে উৎখাত করে।
ইলিয়াস এবং তার সঙ্গিরা ঐসব বাংলাদেশি দালালদের শাস্তির দাবি করছে। তাদের একজন গত ৩১ মার্চ ইরানের বন্দর আব্বাসে ৩৫ বছর ধরে বসবাসকারী পাচারকারী নান্নু মিয়াকে গ্রেফতার করে। কূটনৈতিক মাধ্যমে বাংলাদেশ মিশন রেড এলার্ড জারী করলে নান্নু মিয়াকে গ্রেফতার করা সম্ভব হয়। ইরানিয়ান পুলিশ একজন প্রতাড়িত বাংলাদেশি সাইফুল ইসলামের ভাষানটেক থানায় অভিযোগের ভিত্তিতে নান্নু মিয়াকে ডিপোর্ট করে।
সিআইডির স্পেশাল সুপারিন্টেন্ডেন্ট মতিউর রহমান গত ৩১ মার্চ সাংবাদিকদের জানান, “ নান্নু মিয়া ও তার দলবল এতোদিন ইতালি ও গ্রিসে বাংলাদেশিদের চাকরির প্রলোভন দেখিয়ে টাকা নিতো। এরপর আমিরাত থেকে বেরিয়ে আসার পর সে বাংলাদেশিদের আটক করে টাকা আদায় শুরু করে”।
সিআইডি ইন্সপেক্টর বোরহান উদ্দিন বেনার নিউজকে বলেন, নান্নু পাকিস্তানি ও তুরস্কের পাচারকারীদের সাথে চক্র বেধে বাংলাদেশিদের আটক ও নির্যাতন করে টাকা আদায় করতো।
ঘটনার আরেক শিকার পটুয়াখালির ইসহাক ফারুকী বেনার নিউজকে জানায়, “ওমান থেকে আমাদেরকে জোর করে স্পীড বোটে তুলে বন্দর আব্বাসে নিয়ে আসে। ওদের অত্যাচারে একজন বাংলাদেশি মারা গেলে দালালরা তার লাশ আরব সাগরে ফেলে দেয়”।সে জানায়, বন্দর আব্বাসে তাদের আটককারীরা তাদের কাছে ১০ লাখ করে টাকা চায়। “ আমার পরিবারের কাছে ৯ লাখ টাকা তুলে নিয়ে আমাকে ইরান-পাকিস্তান সীমান্তের মরুভূমির উপর একলা ছেড়ে দেয়”।
অভিবাসী শ্রমিকদের নিয়ে কাজ করছেন ওয়ারবি ডেভেলপমেন্ট ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান সাইফুল হক, তিনি বেনার নিউজকে বলেন, “ নান্নু মিয়ার ধরা পড়ার ঘটনা ভালো খবর, কিন্তু সে একা নয়। আরো অনেক নান্নু মিয়া মধ্যপ্রাচ্যে রয়ে গেছে। পাচারকারীদের ধরে সাজা দেয়ার জন্য বিভিন্ন সরকারের সঙ্গে আমাদের সরকারের সহযোগিতা বাড়াতে হবে। কঠিন একশনের মাধ্যমে পাচারকারী দালালদের ধরতে পারলে বিদেশে বাংলাদেশি শ্রমিকদের দাসত্বের অবস্থায় পড়া ঝুঁকি কমতে পারে”।