এবার সাগর থেকে ১৪০০ অভিবাসী উদ্ধার, আরো কয়েক হাজার ভাসমান অবস্থায়
2015.05.11

এবার মালয়েশিয়ার উপকূলে থেকে উদ্ধার হল নারী ও শিশুসহ এক হাজার ৪০০ অবৈধ অভিবাসী, যাদের ৫৫৫ জনই বাংলাদেশি বলে জানিয়েছে দেশটির কর্তৃপক্ষ। বাকিদের মধ্যে ৪৬৩ জন রোহিঙ্গা বলেও নিশ্চিত করেছে তারা। উপকূলে আরও অভিবাসী আসতে পারেন বলে ধারণা করা হচ্ছে।
সোমবার সকালে মালয়েশিয়ার লংকাবি দ্বীপের সমুদ্র সৈকতের কাছে তিনটি বড় নৌকা থেকে ওই অভিবাসীদের আটক করে স্থানীয় কোস্টগার্ড ও পুলিশ। রোববারও ইন্দোনেশিয়ার উত্তরাঞ্চলীয় আচেহ প্রদেশের সমুদ্র উপকূলে এক নৌযান থেকে প্রায় ৬০০ জন বাংলাদেশি ও রোহিঙ্গা অভিবাসীকে উদ্ধার করা হয়।
আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমগুলোতে মালয়েশিয়ার লংকাবি পুলিশ প্রধান হারিথ কম আবদুল্লাহকে উদ্ধৃত করে বলা হয়, সোমবার তিনটি নৌকা থেকে উদ্ধার হওয়া অবৈধ অভিবাসীর মধ্যে ৫৫৫ জনই বাংলাদেশি। আর ৪৬৩ জন রোহিঙ্গা এবং বাকিরা এ অঞ্চলেরই কোনো দেশের বাসিন্দা। এদের মধ্যে ৯৯ জন নারী ও ৫৪ জন শিশুও রয়েছে।
অবৈধভাবে মালয়েশিয়ায় প্রবেশের দায়ে আটকৃতদের শিগগির অভিবাসন অধিদফতরের কাছে হস্তান্তর করা হবে বলেও জানান আবদুল্লাহ।
এদিকে থাইল্যান্ড সীমান্ত ও জঙ্গল থেকে কয়েক দফায় উদ্ধার হওয়া বাংলাদোশিদের সংখ্যা দাড়িয়েছে ১২৪ জনে। এদের মধ্যে ১৫ জনের পরিচয় নিশ্চিত করেছে দেশটিতে অবস্থিত বাংলাদেশ দূতাবাস।
আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবরে দেখা যায়, কয়েকটি মাছ ধরা ট্রলারে করে পাচারকারীরা মালয়েশিয়া নিয়ে যাবার কথা বলে ইন্দোনেশিয়ার আচেহ’র উপকূলে কয়েকশ বাংলাদেশি ও রোহিঙ্গা পৌছিয়ে দিয়ে পালিয়ে যায়।আচেহ’র পুলিশ তাদেরকে আটক করে স্থানীয় স্টেডিয়ামে আশ্রয় দেয়, তাদের ভাগ্য কি হবে কর্তৃপক্ষ সিদ্ধান্ত নেয় নি।
এদিকে, মিয়ানমার সরকার জানিয়েছে যে, তাদের উপকূল থেকে কেউ থাইল্যান্ড বা মালয়শিয়ায় যাচ্ছে না। বরং বাংলাদেশকে রোহিঙ্গারা রুট হিসেবে ব্যবহার করছে।
এপি’র আরেক খবরে বলা হচ্ছে, কয়েক হাজার বাংলাদেশি ও রোহিঙ্গাদের নিয়ে বেশ কিছু ট্রলার সমুদ্রে ভাসমান অবস্থায় রয়েছে। থাইল্যান্ড ও মালয়শিয়ায় ধরপাকড়ের কারণে তারা নামার কোনো সুযোগ পাচ্ছে না। এদিকে তাদের ট্রলারের তেল ফুড়িয়ে যাচ্ছে, খাবার ও পানির সংকটে মারাও যাচ্ছে অনেকে। যারা মারা যাচ্ছে তাদেরকে সাগরে ফেলে দেয়া হচ্ছে।
ইন্দোনেশিয়ার নেভি কয়েকটি নৌকায় পানি ও খাবার দিয়ে তাদেরকে মালয়েশিয়া যাবার পথ দেখিয়ে দিয়েছে।
দফায় দফায় বিভিন্ন দেশের সীমান্ত থেকে সাগর পথে অবৈধভাবে যাওয়া বাংলাদেশি উদ্ধারের ঘটনায় উদ্বিগ্ন বাংলাদেশের প্রশাসন। অবৈধভাবে যাওয়ার এই পকেট রুট বা সাগর পথে নিরাপত্তা জোরদার করাসহ মানবপাচারকারীদের ধরতে দফায় দফায় অভিযান চালাচ্ছে প্রসাশন। একইসঙ্গে ওইসব এলাকার জনগণের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টির কাজও চালানো হচ্ছে।
সোমবারেও কক্সবাজারের টেকনাফ উপজেলায় তিনজন তালিকাভুক্ত মানবপচারকারীকে গ্রেপ্তার করেছে বলে জানিয়েছে স্থানীয় পুলিশ। গ্রেপ্তার হওয়া ব্যক্তিরা হলেন উপজেলার সাবরাং ইউনিয়নের খাইর হোসেন (৪৫), আলী হোসেন (৩০) ও আবদুর রহমান (৩৫)। তাদের বিরুদ্ধে মানবপাচারের মামলা রয়েছে।
এদিকে মালয়েশিয়া সীমান্তে উদ্ধার হওয়া বা্ংলাদেশিদের বিষয়ে এখনো কোন তথ্য নেই বলে জানিয়েছে পররাষ্ট্র ও প্রবাসী কল্যান ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণ।
“গণমাধ্যম মারফত আমরা জানতে পেরেছি মালয়েশিয়া উপকূলে পাঁচ শতাধিক বাংলাদেশি আটক হয়েছেন। আমরা দূতাবাসের মাধ্যমে সেটা নিশ্চিত হওয়ার চেষ্টা করছি। ”- এভাবেই ব্যাখা দেন প্রবাসী কল্যান সচিব খন্দকার ইফতেখার হায়দার চৌধুরী।
এসব অবৈধপথে যাওয়া শ্রমিকদের জন্য বিশ্বে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি দারুণভাবে ক্ষুন্ন হচ্ছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, “সম্প্রতি ঘটে যাওয়া কিছু ঘটনার পর আমরা কক্সবাজারের যেসব ‘পকেট’ রুট দিয়ে মানব পাচার হচ্ছে সেসসব রুটে নিরাপত্তা জোরদার করেছি। স্থানীয় জেলা প্রসাশককেও জনসচেতনতা বাড়াতে নির্দেশ দিয়েছি।
তিনি বলেন, “প্রবাসী কল্যান মন্ত্রণালয় বৈধ শ্রমিকদের নিয়ে কাজ করে। বিভিন্ন দেশে আমরা বৈধভাবে শ্রমিক পাঠাইা। সেখানে গিয়ে কোন কর্মী অপকর্মে লিপ্ত হলে যেমন দেশের ভাবমূর্তি নষ্ট হয়, সাগর পথে বিদেশ যাওয়া বাংলাদেশিদের কারণেও একইভাবে দেশের সম্মান নষ্ট হয়। তখন বৈধভাবে শ্রমিক পাঠানোর বাজার ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে পড়ে। তাই এই অবৈধভাবে সাগর পথে বিদেশে যাওয়া ঠেকাতে হবে।”
কয়েকজন মানব পাচারকারীর পুলিশের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে নিহত হওয়া, আরো কিছু সংখ্যক আটক হওয়া সবই পাচারকারীদের বিরুদ্ধে সরকারের কঠোর অবস্থানের নমুনা বলে জানান ইফতেখার চৌধুরী।
স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আপসাদুজ্জামান খাঁন কামাল জানিয়েছেন পাচারকারীদের তালিকা তৈরি করছে প্রশাসন। পাচারের সংখ্যা কমে আসছে বলেও তিনি বিবিসির এক অনুষ্ঠানে দাবি করেন। তবে জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক সংস্থা ইউএনএইচসিআর’র দিচ্ছে ভিন্ন তথ্য। সংস্থাটি বলছে চলতি বছরের প্রথম তিন মাসে প্রায় ২৫ হাজার বাংলাদেশি ও রোহিঙ্গা মানবপাচারকারীদের খপ্পরে পড়ে মালয়েশিয়া বা ইন্দোনেশিয়ায় পাড়ি জমিয়েছে, অথবা লাশ হয়েছে। যা গত বছরের একই সময়ের তুলনায় দ্বিগুন।
সোমবার মালয়েশিয়ান কর্তৃপক্ষের এ খবরের পাশাপাশি ইন্দোনেশিয়াও জানিয়েছে, এদিন দেশটির উত্তর-পশ্চিম উপকূলের আচেহ প্রদেশের জলসীমায় পৌঁছানো একটি বড় নৌকা থেকে বাংলাদেশিসহ প্রায় ৪০০ অভিবাসীকে উদ্ধার করে স্থানীয় কোস্টকার্ড ও পুলিশ। প্রদেশটির অনুসন্ধান ও উদ্ধারকারী বিভাগের প্রধান বুদিওয়ান সংবাদমাধ্যমকে এ তথ্য নিশ্চিত করলেও এদের মধ্যে কতোজন রোহিঙ্গা ও কতোজন বাংলাদেশি রয়েছেন তা নিশ্চিত করতে পারেননি।
সম্প্রতি মানবপাচারকারীদের হাতে জিম্মি হয়ে বাংলাদেশিসহ অভিবাসীদের প্রাণ হারানোর ঘটনায় পুরো দক্ষিণ এশিয়ায় তোলপাড় চলছে। বিদেশে চাকরির প্রলোভন দেখিয়ে জনসাধারণের কাছ থেকে অর্থ হাতিয়ে নেওয়া এই দালালদের দৌরাত্ম্য ঠেকাতে এরই মধ্যে কড়া পদক্ষেপ নিতে শুরু করেছে বিভিন্ন দেশ। কিন্তু প্রশাসনের কড়া পদক্ষেপের মধ্যেই থাইল্যান্ড, ইন্দোনেশিয়া ও মালয়েশিযার উপকূলে দফায় দফায় অভিবাসী উদ্ধারের খবর আসছে।
এদিকে থাইল্যান্ডে পাচার হয়ে যাওয়া বাংলাদেশিদের ফিরিয়ে আনার প্রক্রিয়া চলছে বলে জানিয়েছেন পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম। এছাড়া মানবপাচার রোধে করণীয় ঠিক করতে চলতি সপ্তাহে আন্তঃমন্ত্রণালয় বৈঠক বসবে বলেও তিনি জানান।
শাহরিয়ার আলম আরো বলেন, “থাইল্যান্ডে সীমান্তে আটক হওয়া ১৫ জন বাংলাদেশির পরিচয় নিশ্চিত হওয়া গেছে। বাকিদের পরিচয় জানতে সেখানকার বাংলাদেশ দূতাবাস কাজ করে যাচ্ছে।”