ইন্দোনেশিয়ায় ভিড়েছে ৮০০ ‘বাংলাদেশি, রোহিঙ্গা’
2015.05.15

মালয়েশিয়া থেকে ফিরিয়ে দেওয়ার পর ইন্দোনেশিয়ার আচেহ উপকূলে গিয়ে ডুবতে থাকা এক নৌকা থেকে প্রায় আটশ মানুষকে উদ্ধার করা হয়েছে, যারা পাচারের শিকার বাংলাদেশি ও মিয়ানমারের রোহিঙ্গা বলে দাবি করা হচ্ছে।
স্থানীয় সময় শুক্রবার ভোর ৫টার দিকে সুমাত্রার পূর্ব উপকূলের জেলেরা তাদের উদ্ধার করে তীরে নিয়ে যায় বলে জানিয়েছে বার্তা সংস্থা রয়টার্স।
আচেহর লাংসা শহরের ত্রাণ ও উদ্ধার বিভাগের কর্মকর্তা খাইরুল নোভাকে উদ্ধৃত করে রয়টার্স জানায়, “সর্বশেষ পাওয়া খবর অনুযায়ী ওই নৌকায় ৭৯৪ জন মানুষ ছিল। তাদের উদ্ধার করে প্রাথমিকভাবে বন্দর সংলগ্ন একটি ওয়্যারহাউজে রাখা হয়েছে।”
স্থানীয় কর্মকর্তাদের তথ্য অনুসারে এদের মধ্যে ২১০ জন মায়ানমারের নাগরিক। আর ৩৯৫ জন বাংলাদেশি।
‘নৌকাটির গন্তব্য মালয়েশিয়া ছিল’ লাংসা শহরের পুলিশ প্রধান সুনারিয়াকে উদ্ধৃত করে এমনটি জানিয়েছে মালয়েশিয়ার স্টার অনলাইন।
কিন্তু সে দেশের নৌবাহিনী নৌকাটিকে ইন্দোনেশিয়ার জলসীমার দিকে ঠেলে দেয়। বুধবার মালয়েশিয়ার পেনাং ও লাংকাওয়ি উপকূল থেকে এ ধরনের দুটি নৌকাকে গভীর সাগরের দিকে ঠেলে দিয়েছে বলে জানায় স্থানীয় সংবাদ মাধ্যমগুলো। দ্বিতীয় নৌকাটিও ইন্দোনেশিয়ার জলসীমায় কোথাও রয়েছে বলে ধারণা করছে স্থানীয় কর্মকর্তারা।
এই নৌকা ফেরত পাঠানোর ঘটনা থাইল্যান্ড উপকূলেও ঘটেছে। বিবিসি জানিয়েছে, প্রায় ৩০০ রোহিঙ্গাসহ একটি নৌকার ইঞ্জিন নষ্ট করে দিয়ে পাচারকারীরা পালিয়ে যাওয়ার পর থাই নৌবাহিনী ইঞ্জিন সারিয়ে খাবার ও পানি দিয়ে নৌকাটি আবার গভীর সাগরে ঠেলে দিয়েছে।
এপি’র খবরে বলা হয়, নৌকার চালক ও পাচারকারীরা এক পর্যায়ে ইঞ্জিন নস্ট করে দিয়ে স্পীডবোট যোগে পালিয়ে গেলে বাংলাদেশী ও রোহিঙ্গা অভিবাসীদের মধ্যে মারপিট শুরু হয়। লাঠি ও ছুড়িকাঘাতে কয়েক ডজনের মৃত্যু হয়। পানি ও খাবার সঙ্কট দেখা দেয়ায় না খেয়েও অনেকে মারা যায়। লাশ পানিতে ফেলে দেয়া হয়।
রোহিংগা নারী মানু এপিকে বলেন, “ আমার ২০ বছরের ভাই সহ বেশ কয়েকজন দাঙ্গায় মারা যায়। চালক পালিয়ে গেলে তারা মনে করে যে সে আমাদের দেশ থেকেই এসেছিলো”।
এই সাগরে ঠেলে দিয়ে এসব অভিবাসীদের জীবনকে আরো ঝুঁকির মুখে ফেলার সমালোচনা করেছে জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক কমিশনার জাইদ রাদ আল হোসেইন। তাদের জীবন রক্ষার দিকেই বেশি মনোযোগ দেয়ার আহবান জানিয়েছেন তিনি।
তিনি অভিযোগ করেন ‘মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া এবং থাইল্যান্ড এই অভিবাসীদের বহনকারী নৌকা সাগরে ঠেলে দেয়ার নীতি নিয়েছে। এর ফলে অনেক মানুষের জীবন বিপন্ন হচ্ছে।”
মাঝ সাগরে চরম অনিশ্চয়তার মধ্যে ভাসতে থাকা প্রায় ছয় হাজার রোহিঙ্গা মুসলিম এবং বাংলাদেশির জীবন রক্ষায় দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার তিনটি দেশের সরকারের প্রতি দ্রুত ব্যবস্থা নেয়া আহ্বান জানিয়েছেন জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক কমিশনার।
আন্দামান সাগরের উপকূলে ভাসতে থাকা রোহিঙ্গা ও বাংলাদেশিদের বাঁচাতে এ অঞ্চলের দেশগুলোকে সমন্বিত চেষ্টা চালিয়ে যাওয়ার আহ্বান জানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রও। মানবপাচার রুখতে এ ব্যাপারে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে একটি 'আঞ্চলিক সমাধানে' পৌঁছানোরও তাগিদ দিয়েছে দেশটি।
অনুসন্ধানে জানা যায়, মায়ানমারে জাতিগত বৈষম্যের শিকার রোহিঙ্গারা দেশ ছেড়ে পালাতে চায়, সেই সুযোগ নিচ্ছে পাচারকারীরা। তাদের সঙ্গে বাংলাদেশের নাগরিকদেরও মালয়েশিয়াতে চাকরির প্রলোভন দেখিয়ে মাছ ধরার ট্রলারে করে সাগর পাড়ি দিয়ে পাচার করছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, মিয়ানমার ও বাংলাদেশ থেকে এই অবৈধ অভিবাসীদের নৌকায় তুলে পাচারকারীরা প্রথমে থাইল্যান্ডে নিয়ে যাচ্ছে। সেখানে জঙ্গলের মধ্যে তাদের কিছুদিন রেখে সুযোগ বুঝে আবারও নৌকায় করে মালয়েশিয়া বা ইন্দোনেশিয়া উপকূলে নেওয়া হচ্ছে।
এদিকে সমুদ্রপথে মানব পাচারের বিষয়ে বিভিন্ন পক্ষ থেকে সতর্ক করা হলেও যথাসময়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়নি বাংলাদেশ সরকার। এমনকি সরকারের মানব পাচার প্রতিরোধ ও দমনে জাতীয় কর্মপরিকল্পনায়ই স্থান পায়নি সুমদ্রপথে মানব পাচারের বিষয়টি। ফলে বিদেশ গমনেচ্ছু কর্মীদের জীবনঝুঁকি তৈরির পাশাপাশি আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
সম্প্রতি থাইল্যান্ডের শংখলা প্রদেশের জঙ্গল থেকে বাংলাদেশিদের উদ্ধারের ঘটনায় মানব পাচারের বীভৎস রূপ সামনে আসলেও মূলত: দীর্ঘ দিন ধরেই সাগর পথে মানব পাচার হয়ে আসছে। এর আগে ২০১৩ সালের ৩ ফেব্রুয়ারি শ্রীলঙ্কান নৌবাহিনী মাছ ধরার নৌকা থেকে ১৩৮ জনকে মুমূর্ষু অবস্থায় উদ্ধার করলে বিষয়টি প্রকটভাবে নজরে আসে।
বিষয়টি স্বীকার করে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন বলেন, নৌকায় করে মানব পাচার শুধু এবছরেই হচ্ছে না। দীর্ঘ কয়েক বছর ধরেই হয়ে আসছে। তবে এবার এটি রেকর্ড পরিমান কারণ, মিডিয়ায় প্রচার বেশি হয়েছে।
মালয়েশিয়া ও থাইল্যান্ডে বাংলাদেশ দূতাবাসসহ অভিবাসনবিষয়ক গবেষণা সংস্থাগুলোও মানব পাচার নিয়ে কয়েক বছর ধরে সরকারকে সতর্ক করে আসছে। মানব পাচার প্রতিরোধ ও দমনে ২০০৮ ও ২০১২ সালে নেওয়া দুটি জাতীয় কর্মপরিকল্পনা একটিতেও সমুদ্রপথে মানব পাচারের বিষয়টি ছিল না।
২০১৫-১৭ সালের খসড়া কর্মপরিকল্পনায়ও এ বিষয়টি স্থান পায়নি। আবার ২০১২ সালে মানব পাচার প্রতিরোধ ও দমন আইন পাস হওয়ার পর এ আইনের অধীনে জাতীয় মানব পাচার দমন সংস্থা ও বিধিমালা, মানব পাচার প্রতিরোধ ও দমন বিধিমালা এবং মানব পাচার প্রতিরোধ তহবিল ও বিধিমালা করার কথা থাকলেও গত তিন বছরে সেসব কাজ শেষ হয়নি।
তবে ‘বিধিমালাগুলোর খসড়া আইন মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে বলে জানিয়েছেন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব (রাজনৈতিক) মোস্তাফিজুর রহমান।
মানব পাচার বন্ধে ২০১৩ সালে বৈদেশিক কর্মসংস্থান ও অভিবাসী আইন নামে করা হয় আরেকটি আইন। তবুও বন্ধ হচ্ছেনা পাচার।
পাচার বিষয়ে করণীয় জানতে চাইলে প্রবাসী কল্যান মন্ত্রী বেনারকে বলেন, আমরা বৈধ শ্রমিকদের নিয়ে কাজ করি। পাচার কবন্ধ করার দায়িত্ব স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের।
তবে দায় না এড়িয়ে স্বরাষ্ট্র প্রতি মন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল বলেছেন, সমুদ্রপথে পাচার বন্ধে প্রসাশন কাজ শুরু করেছে। সর্বোচ্চ গুরুত্বের সঙ্গে কাজ চলছে। এছাড়া সাগরে ভাসামান বাংলাদেশিদের ব্যপারেও তথ্য অনুযায়ী ব্যবস্থা নিচ্ছি। তাদের ব্যাপারে আরো তথ্য থাকলে প্রসাশনকে জানানোর অনুরোধও জানিয়েছন মন্ত্রী।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন মুখপাত্র বলছেন, আগামী ২৯ মে ব্যংককে অনুষ্ঠিতব্য মানব পাচার প্রতিরোধের উচ্চ পর্যায়ের এক সম্মেলনে বাংলাদেশ অংশ নেবে, এতে বাংলাদেশের অবস্থান সম্পর্কে পররাষ্ট্র মন্ত্রনালয় কয়েকদিনের মধ্যে একটি প্রেস কন্ফারেন্স করে জানাবে।
পররাষ্ট্র মন্ত্রী মাহমুদ আলী বৃহস্পতিবারা রাতে মালয়েশিয়া গেছেন। দেশটির সঙ্গে চতুর্থ পররাষ্ট্রমন্ত্রী পর্যায়ে যৌথ কমিশনের বৈঠকে বাংলাদেশের প্রতিনিধি দলের নেতৃত্ব দেবেন এএইচ মাহমুদ আলী।ওই বৈঠকে সমুদ্রপথে অবৈধভাবে মানবপাচার বন্ধের জন্য যৌথ উদ্যোগের বিষয়টি বিশেষভাবে গুরুত্ব পাবে।
বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠনের তথ্য অনুযায়ী, ছয় হাজারেরও বেশি অসুস্থ ও ক্ষুধার্ত অবৈধ অভিবাসী সমুদ্রে ভাসমান অবস্থায় উদ্ধারের অপেক্ষায় আছেন।