মালয়েশিয়া-ইন্দোনেশিয়া সাগরে ভাসমান মানুষের জন্য আশার আলো দেখালো
2015.05.20

আন্তর্জাতিক উদ্বেগের মুখে মানব পাচারের শিকার হয়ে সমুদ্রে ভাসমান ৭ হাজার মানুষকে সাময়িকভাবে আশ্রয় দিতে রাজি হয়েছে মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়া।
মালয়েশিয়ার রাজধানী কুয়ালা লামপুরে এ সংক্রান্ত এক জরুরি বৈঠকে এ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। বৈঠকে থাইল্যান্ডও অংশ নিয়েছে। তবে অভিবাসীদের আশ্রয় দেয়ার ব্যাপারে থাইল্যান্ডের পক্ষ থেকে কিছু বলা হয়নি। তবে, অভিবাসীদের বিষয় নিয়ে থাইল্যাণ্ড আগামি ২৯ মে ব্যাংককে সম্মেলন করতে যাচ্ছে, এতে আঞ্চলিক ১৭ টি দেশ অংশ নিচ্ছে এবং পর্যবেক্ষক হিসেবে ২টি দেশ ও ৩টি আন্তর্জাতিক সংস্থা উপস্থিত থাকবে, থাই পররাষ্ট্র মন্ত্রনালয়ের প্রেস রিলিজে বলা হয়।
বাংলাদেশ ব্যংককের এই সম্মেলনে অংশ নেবে এ কথা জানিয়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রনালয়ের ডাইরেক্টর জেনারেল আসুদ আহমেদ বেনার নিউজকে বলেন, “মানব পাচার রোধে বাংলাদেশ সেখানে তাদের অবস্থান পূনর্ব্যক্ত করবে, আমরা জোরালো ভাবে জানাবো যে, মায়ানমারকে ভুমিকা পালন করতে হবে যেনো তারা তাদের নাগরিকদের দেশে ফিরিয়ে নেয়ার পরিবেশ সৃষ্টি করে এবং উৎসাহ দেয়”।
অভিবাসীদের সাময়িকভাবে আশ্রয় দেওয়ার এ সিদ্ধান্ত মানব পাচারকে নতুন করে উৎসাহিত করে কিনা তা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়া সরকার।
যদিও তারা পরিষ্কারভাবে জানিয়ে দিয়েছে, এ আশ্রয় পুরোপুরি সাময়িক এবং তারা এর চাইতে বেশি আর কাউকে দেশে ভীড়তে দেবে না।
মালয়েশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী আনিফাহ আমান বলেন, “শুরুতেই আমরা পরিষ্কারভাবে জানিয়ে দিতে চাই যারা শুধুমাত্র গভীর সমুদ্রে ভাসছে আমরা তাদেরই আশ্রয় দেব। তবে এমন ভাবার কোন কারণ নেই যে, তারা (শরণার্থীরা) আসতেই থাকবে আর আমরা প্রত্যেককে আশ্রয় দেব।”
এ মাসে মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়ায় তিন হাজারের বেশি অভিবাসী আশ্রয় নিয়েছে। এছাড়া, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া ও থাইল্যান্ড কর্তৃপক্ষ বেশ কয়েটি নৌযান সমুদ্রে ঠেলে দিয়েছে।
জাতিসংঘ ওই তিন দেশের সরকারের কাছে অসহায় ওইসব শরণার্থীকে আশ্রয় দেয়ার আহ্বান জানিয়েছে।
এর পরিপ্রেক্ষিতে মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়া ওইসব অভিবাসীকে সাময়িকভাবে আশ্রয় দিতে রাজি হয়েছে। সেইসঙ্গে এ সঙ্কট থেকে বেরিয়ে আসার জন্য তারা আন্তর্জাতিক বিশ্বের সহায়তা চেয়েছে।
সমুদ্রে ভাসামান এসব অভিবাসীর অধিকাংশই মিয়ানমারের রোহিঙ্গা মুসলিম এবং বাংলাদেশি।
কুয়ালালামপুরে বৈঠকে মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়ার পক্ষ থেকে একটি যৌথ বিবৃতিতে বলা হয়, “আমরা পুনর্বাসন ও প্রত্যাবাসনের প্রস্তাব দিচ্ছি। এটি এমন একটি প্রক্রিয়া যা আন্তর্জাতিক মহলের সহায়তায় আগামী এক বছরে সম্পন্ন হবে।”
অর্থাৎ, আন্তর্জাতিক সহায়তায় আগামী এক বছরের মধ্যে এসব অভিবাসীকে অন্য কোন দেশে আবাস খুঁজে নিতে হবে।
জাতিসংঘ এ উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়েছে এবং ‘কোন রকম দেরি না করে’ সমুদ্র থেকে অসহায় মানুষগুলোকে উদ্ধারের আহ্বান জানিয়েছে।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী আমান বলেন, অস্থায়ী আশ্রয় শিবির স্থাপন করা হবে, কিন্তু থাইল্যান্ডে কোন শিবির হবে না।
থাই কর্তৃপক্ষ বলেছে, তারা সমুদ্রে অভিবাসীদের ওপর নজর রাখবে এবং যারা অসুস্থ হয়ে তাদের পাড়ে এসছে তাদের চিকিৎসা গ্রহণের অনুমতি দেবে।
দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সাগরে অসহায়ভাবে নৌকায় ভাসতে থাকা হাজারো অভিবাসন-প্রত্যাশীদের সাময়িক আশ্রয় দিতে ইন্দোনেশিয়া ও মালয়েশিয়া সম্মত হওয়ায় বাংলাদেশের সাগরভাসা অসহায় মানুষের আশ্রয় পাওয়ার সুযোগ তৈরি হয়েছে। এটাকে একটি বড় অর্জন হিসেবে দেখা হচ্ছে।
কুয়ালালামপুরে বৈঠকে অংশ নেওয়া তিনটি দেশ ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া ও থাইল্যান্ড সাগরে নৌকায় ভাসতে থাকা হাজারো অভিবাসন-প্রত্যাশীদের তীরে ভিড়তে না দেওয়ায় এই দেশ তিনটি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সমালোচনার মুখে পড়ে।
আঞ্চলিক অভিবাসী সংকট সমাধানে প্রথমবারের মতো সহায়তার প্রস্তাব দিয়েছে মিয়ানমার। এত দিন দেশটি এই সংকটের দায় অস্বীকার করে আসছিল।
মিয়ানমারের রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যম দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক বিবৃতির বরাত দিয়ে জানায়, আঞ্চলিক অভিবাসী সংকটে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের উদ্বেগের সঙ্গে একমত ইয়াঙ্গুন। সমুদ্রে যারা দুর্ভোগ পোহাচ্ছে, তাদের মানবিক সহায়তা দিতে মিয়ানমার প্রস্তুত।
আঞ্চলিক অভিবাসী সংকটের দায় প্রশ্নে মিয়ানমার যে কিছুটা নমনীয় হয়েছে, দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এই বিবৃতিটি সেটাই ইঙ্গিত করছে।
সম্প্রতি মানব পাচারকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর হয় থাইল্যান্ড সরকার। এরপর প্রায় তিন হাজার মিয়ানমারের রোহিঙ্গা ও বাংলাদেশি অভিবাসন-প্রত্যাশীকে পাচারকারীরা জরাজীর্ণ ও ভিড়ে ঠাসা নৌকায় রেখে পালিয়ে যায়। একপর্যায়ে ওই অভিবাসন-প্রত্যাশীদের তীরে ভিড়তে না দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া ও থাইল্যান্ড। এতে তারা ক্ষুধা-পিপাসায় কাতর হয়ে এক দেশের জলসীমা থেকে আরেক দেশের জলসীমায় ঘুরতে বাধ্য হয়। এর মধ্যে আজ বুধবার ইন্দোনেশিয়ার আচেহ প্রদেশের উপকূল থেকে ৪২৬ জন অভিবাসন-প্রত্যাশীকে উদ্ধার করা হয়েছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক এবং শরনার্থী ও অভিবাসী গবেষণা ইউনিটের চেয়ারপার্সন তাসনিম সিদ্দিকী বেনার নিউজকে বলেন, “এই সমস্যার সমাধান ইচ্ছে করলেই রাতারাতি সম্ভব না, এটা কয়েক বছর সময় লাগবে। এটা এখন বাস্তবতা যে অবৈধ পথে অবিভাসীর জোয়ার শুরু হবার মূল কারণ কাজের খোঁজে বৈধ পথে যাবার উপায় খুব কঠিন হয়ে পড়েছে। ২০১২ সাল থেকে মালয়েশিয়া বাংলাদেশি শ্রমিক নেয়া কার্যত বন্ধ করে দেবার পর থেকেই অবৈধ পথে যাত্রার চিত্রটি শোচনীয় রূপ নিয়েছে”।
অভিবাসী কর্মী উন্নয়ন কর্মসূচীর নির্বাহী পরিচালক ওমর ফারুক চৌধুরী বেনারকে বলেন, “বাংলাদেশ, মালয়শিয়া, থাইল্যান্ড ও মিয়ানমারকে নিয়ে একটি জয়েন্ট কমিশন গঠন করে এই অব্যাহত সংকটের একটি স্থায়ী সমাধানের পথ বের করতে হবে। এই কমিশনের কাজ হতে হবে বাংলাদেশ ও মিয়ানমার থেকে লোকজনকে বৈধভাবে মালয়শিয়া ও থাইল্যান্ডে কাজের সংস্থান করা ও লোকজনকে সেই পথে উদ্বুদ্ধ করা। কয়েক দশকের এই সংকট কাটিয়ে উঠতে যৌথ উদ্যোগ নেয়া ছাড়া উপায় নেই”।