শহীদের সংখ্যা নিয়ে বিতর্কের অবকাশ নেইঃ ট্রাবুনাল

ঢাকা থেকে শাহরিয়ার শরীফ
2016.02.02
BD-warcrimes মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাচ্ছে নতুন প্রজন্মের সন্তানেরা।
বেনার নিউজ

মহান মুক্তিযুদ্ধে শহীদের সংখ্যা নিয়ে বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার বক্তব্যের পর রাজনৈতিক অঙ্গনে চলমান পাল্টাপাল্টি বক্তব্য এখন আদালতে গড়িয়েছে। গতকাল মঙ্গলবার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল বলে দিয়েছে, এ নিয়ে বিতর্কের অবকাশ নেই।

এদিকে শহীদদের সংখ্যা নিয়ে বিতর্ক ওঠার পর সরকার একটি নতুন আইন প্রণয়নের নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে, যার মূলকথা মুক্তিযুদ্ধ বা মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে কটাক্ষ করা যাবে না। এটা করলে শাস্তি কী হবে, তা এখন পর্যন্ত নির্ধারণ হয়নি।

অন্যদিকে খালেদার বক্তব্যে ‘দেশদ্রোহী’ মনোভাবের পরিচয় পাওয়া যাচ্ছে মর্মে অভিযোগ তুলে ইতিমধ্যে রাষ্ট্রদ্রোহের মামলা করেছেন সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সাবেক সম্পাদক মমতাজউদ্দীন আহমেদ। বক্তব্যের বিষয়ে ব্যাখ্যা চেয়ে ঢাকার একটি আদালত বিএনপি চেয়ারপারসনকে তলব করেছেন।   

মুক্তিযুদ্ধে নিহতের সংখ্যা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করে খালেদা জিয়ার বক্তব্য দেওয়ার ধারাবাহিকতায় দলের অন্য নেতারাও এ নিয়ে কথা বলছেন।

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান বলেছেন, তারা ক্ষমতায় গেলে ‘সঠিক সংখ্যা’ সংগ্রহ করে প্রকৃত শহীদদের তালিকা তৈরি করবেন।

এ ছাড়া খালেদার বক্তব্য সমর্থন করে ‘জরিপ’ চালিয়ে শহীদদের প্রকৃত সংখ্যা নিরূপণের দাবির কথা বলেছেন বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব গয়েশ্বর চন্দ্র রায়।


আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের পর্যবেক্ষণ

গতকাল মঙ্গলবার নেত্রকোনার রাজাকার মো. ওবায়দুল হক ওরফে আবু তাহের ও আতাউর রহমান ননীর যুদ্ধাপরাধ মামলায় মৃত্যুদন্ডের রায় দেন ট্রাইব্যুনাল। এর পর্যবেক্ষণে বলা হয়, বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধে ৩০ লাখ মানুষের শহীদ হওয়া প্রতিষ্ঠিত ইতিহাস।

“ত্রিশ লাখ শহীদের বিষয়ে যে বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে, তা নিয়ে আদালত বলেছেন, ত্রিশ লাখ শহীদ নিয়ে কোনো ধরনের বিতর্কের অবকাশ নাই। এই ত্রিশ লাখ মানুষের আত্মদানেই স্বাধীন বাংলাদেশ,” বেনারকে জানান ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর জেয়াদ আল মালুম।

বিচারপতি আনোয়ারুল হকের নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের ট্রাইব্যুনাল যে রায় দিয়েছে, তাতে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে অথবা গুলি করে ওই দুই যুদ্ধাপরাধীর দণ্ড কার্যকর করতে বলা হয়েছে।

ট্রাইব্যুনাল বলেছেন, পাক দখলদার বাহিনীর কাছ থেকে দেশকে মুক্ত করতে বাঙালি জাতি ও মুক্তিযোদ্ধারা যুদ্ধ করেছেন। এটি ঐতিহাসিক সত্য।

ওই যুদ্ধে ৩০ লাখ মানুষ শহীদ হয়েছেন। লাখ লাখ নারী সম্ভ্রম হারিয়েছেন। এক কোটি মানুষ ভারতে শরণার্থী হিসেবে আশ্রয় নিয়ে বাধ্য হয়েছেন। এই প্রতিষ্ঠিত ইতিহাস নিঃসন্দেহে জাতির পবিত্র আবেগ ও মুক্তিযুদ্ধের অহংকারের সঙ্গে মিশে আছে।


বিতর্ক যেভাবে শুরু

গত ২১ ডিসেম্বর রাজধানীতে মুক্তিযোদ্ধা সমাবেশে খালেদা জিয়া মুক্তিযুদ্ধে শহীদের সংখ্যা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, “আজকে বলা হয় এত লক্ষ লোক শহীদ হয়েছেন। এটা নিয়েও অনেক বিতর্ক আছে যে আসলে কত লক্ষ লোক মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হয়েছেন। নানা বই-কিতাবে নানা রকম তথ্য আছে।”

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নাম উল্লেখ না করে খালেদা জিয়া দাবি করেন, তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতা চাননি। তিনি পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হতে চেয়েছিলেন। জিয়াউর রহমান স্বাধীনতার ঘোষণা না দিলে মুক্তিযুদ্ধ হতো না।

যদিও বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ও সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি খোন্দকার মাহবুব হোসেনের দাবি, খালেদার ওই বক্তব্য রাষ্ট্রদ্রোহ আইনের ‘সংজ্ঞায় পড়ে না’।

তবে শহীদের সংখ্যা নিয়ে সংশয় থাকলেও খালেদা জিয়া তিনবার প্রধানমন্ত্রী থাকাকালে দেওয়া স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবসসহ বিভিন্ন দিবসের বাণী ও বক্তৃতায় ‘৩০ লাখ’ সংখ্যাটি উল্লেখ করেন অসংখ্যবার। এই সংখ্যাটি তিনি কোথায় পেয়েছিলেন, সেই প্রশ্ন ইতিমধ্যে উঠেছে।

অন্যদিকে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নেতারা বলে আসছেন, খালেদা জিয়ার ‘পাকিস্তানপন্থী মনোভাবই’ তার ওই মন্তব্যের কারণ। এই ইস্যুতে তাঁরা খালেদার বিরুদ্ধে আক্রমণাত্মক বক্তব্য দিচ্ছেন।


নতুন আইন প্রণয়নের উদ্যোগ

খালেদা জিয়া ও গয়েশ্বরের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহের মামলা করতে এবং স্বাধীনতার ইতিহাস বিকৃতি রোধে কঠোর আইন করতেও সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়ে আসছেন বিশিষ্টজন, মুক্তিযুদ্ধে শহীদ পরিবারের সদস্য, বীরাঙ্গনা ও বিভিন্ন সংগঠন।

একাত্তরের ঘাতক-দালাল নির্মূল কমিটি সম্প্রতি সংবাদ সম্মেলনে করে অবিলম্বে ‘ইউরোপের হলোকস্ট ডিনাইয়াল অ্যাক্ট’ অনুসারে ‘মুক্তিযুদ্ধ অস্বীকার অপরাধ আইন’ প্রণয়নের দাবি জানায়।

“যারা মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে কথা বলবে, যারা শহীদদের বিরুদ্ধে কথা বলবে; যারা একাত্তরের অত্যাচার-অবিচারকারী, খুনি, গণহত্যাকারীদের পক্ষে কথা বলবে, তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য আইনের খসড়া তৈরির কাজ চলছে,” জানান আইনমন্ত্রী আনিসুল হক।

আইন তৈরি ও আইনি মতামত দেওয়ার প্রতিষ্ঠান আইন কমিশন ইতিমধ্যে নতুন ওই আইনের একটি খসড়া তৈরির কাজ শুরু করেছে। এ মাসের মধ্যে খসড়াটি তৈরি করে তা আইন ও মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ে পাঠানোর প্রস্তুতি নিয়েছে কমিশন।

“দেশি–বিদেশি শক্তি পরিকল্পিতভাবে মুক্তিযুদ্ধ, বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযোদ্ধাদের সম্পর্কে ইতিহাস বিকৃতি করছে। দেশে অসংখ্য দল ও অগণিত মত থাকতে পারে, কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের গর্বিত ইতিহাস কেউ বিকৃত করলে আইন করে কঠোর শাস্তি দিতে হব,” জানান সেক্টর কমান্ডারস ফোরামের মহাসচিব ও সাংবাদিক হারুন হাবীব।

তিনি বলেন, “আমরা অনেক আগে থেকে এই আইন করার দাবি জানাচ্ছি এবং এটা যত তাড়াতাড়ি হবে ততই তা জাতির জন্য মঙ্গলজনক।”

এর আগে বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে কটূক্তির অভিযোগে হাইকোর্টের নির্দেশে বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানের বক্তব্য প্রচার ও প্রকাশ করছে না গণমাধ্যম। তিনি লন্ডনে অবস্থান করে বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে বিভিন্ন বক্তব্য দিচ্ছিলেন।

গত বছরের ৭ জানুয়ারি এ–সংক্রান্ত আদেশে আদালত বলেন, তারেক রহমানের বক্তব্য প্রচার করা যাবে না। এ নির্দেশনা বাস্তবায়নের দায়িত্ব দেওয়া হয় তথ্য ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে। তখন থেকে বাংলাদেশের কোনো গণমাধ্যম তারেকের বক্তব্য প্রচার করছে না।  

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।